পরদিন ঘুম ভাঙলো, বুকের উপর ভারী কিছু একটা অনুভব করে। চোখ মেলে চেয়ে দেখি, তৃষ্ণা আমার বুকের উপর ঘুমুচ্ছে।
মনে মনে হাসলাম আমি। অবশ্য, এ তেমন নতুন কিছু নয়। তৃষ্ণা প্রায়ই আমার বুকের উপর ঘুমোয়।
মাঝে মাঝে বুকের উপর একটু চাপ লাগে, কিন্তু তা সয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি, তৃষ্ণা বুকের উপর ঘুমালে, আমার বেশ ভালোই লাগে। বুকটা বেশ পূর্ণ লাগে। নিজেকে বেশ সক্ষম মনে হয়।
তৃষ্ণা আমাকে এত ভালোবাসে, তা ভেবে নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে হয়। ও আমাকে এত ভরসা করে, তা ভেবে নিজেকে বীর মনে হয়। সত্যিকারের পুরুষ মনে হয়।
পুরুষ হওয়া এত সহজ কথা নয়। যে পুরুষ জীবনের দুঃখ কষ্টকে সইতে পারে না, সে পুরুষ কিসের? যে পুরুষ অসহ্যকে সহ্য করতে পারে না, সে পুরুষ কিসের? যে পুরুষ নারীর ভরসা হতে পারে না, সে পুরুষ কিসের?
তৃষ্ণা বলে, আমার বুকের উপর না ঘুমালে, ওর নাকি ঘুম ভালো হয় না। আমি হাসি। পূর্ণতার হাসি। তৃপ্তির হাসি।
আসলে, নারী যেমন পুরুষের মুখ থেকে তার প্রশংসা শুনতে চায়; পুরুষও তেমনি নারীর মুখ থেকে তার প্রশংসা শুনতে চায়। প্রশংসা কার না ভালো লাগে?
আগেই বলেছি, রাতে, আমাদের ঘরের পূর্ব দিকের জানালা খোলাই থাকে। তৃষ্ণার পিঠের উপর হাত রেখে, সেই খোলা জানালার দিকে চেয়ে দেখলাম আমি।
দেখি, সূর্য সবে উঠতে শুরু করেছে। সূর্যের অবয়ব এখনো স্পষ্ট নয়। তবুও উদীয়মান সূর্যের সোনালী আভা, পূর্ব আকাশ ঢেকে ফেলেছে।
হটাৎ দেখি, দূরে, সূর্যের অবয়বের উপর দিয়ে, একঝাঁক পাখি উড়ে গেলো। বেশ দ্রুত গতিতে। তারপর আরও এক ঝাঁক। তারও পর, আরও এক ঝাঁক। ঊহঃ ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। আর সঙ্গে, তাদের কিচিরমিচির কলরব।
ভাবলাম, আহাঃ কি আনন্দ ওদের! রাত শেষে, নতুন একদিন। নতুন এক যাত্রা। সেই নতুন যাত্রার আনন্দে, পাখিগুলো ছুটে যাচ্ছে। হল্লা করতে করতে ছুটে যাচ্ছে।
মানুষের সঙ্গে পাখির পার্থক্য কোথায়? সবারই তো একই স্বপ্ন। একই কর্ম। দিনের বেলা জীবিকা খোঁজা। রাতের বেলা বিশ্রাম নেওয়া।
মানুষের মন বড় বিভেদ-অন্বেষী। তাই না? কেবল বিভেদ খুঁজে সে। ধনী গরীব। কালো ফর্সা। পুরুষ নারী। হিন্দু মুসলমান। স্বজাতি বজ্জাতি ইত্যাদি। কিন্তু চারিদিকে যে এত সাদৃশ্য, সেগুলো তো আমরা দেখি না। চারিদিকে যে এত নিবিড় সংযোগ, তা তো আমরা দেখি না।
এই তো চোখের সামনে দেখলাম, পাখির সঙ্গে আমার কি গভীর সাদৃশ্য! কি গভীর সংযোগ! আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম, তো ওরাও ঘুম থেকে জেগে উঠলো। আমি এবার আমার কর্ম শুরু করবো। তো ওরাও ওদের কর্ম শুরু করলো।
সূর্যের সঙ্গে ওদের যা সম্পর্ক, আমার সঙ্গেও সেই একই সম্পর্ক। বাতাসের সঙ্গে ওদের যা সম্পর্ক, আমার সঙ্গেও সেই একই সম্পর্ক। বৃক্ষের সঙ্গে ওদের যা সম্পর্ক, আমার সঙ্গেও সেই একই সম্পর্ক। রাতের সঙ্গে ওদের যা সম্পর্ক, আমার সঙ্গেও সেই একই সম্পর্ক। তো পাখির সঙ্গে সংযোগ নেই আমার? সংযোগ যদি নেই, তো এই গভীর সাদৃশ্য এলো কোথা থেকে?
মানুষ বিভেদ দেখে বলেই, মানুষ এত যন্ত্রণায় ভুগে। মানুষ যদি নিবিড় সংযোগ দেখতো, তো সে অনেক বেশি সুখী হতো। তার কারণ, সে তখন অন্যকে আত্মার আত্মীয় ভাবতো। সে তখন বেশি ভালোবাসা দিতো। বেশি ভালোবাসা পেতো।
অন্যকে শত্রু ভাবলে, নিজের পৃথিবী ছোট হয়ে যায়। নিজের আত্মীয় বন্ধুবান্ধব অনেক কমে যায়। নিজের আনন্দের উৎস অনেক কমে যায়। অর্থাৎ, যারা যত বেশি বিভেদ দেখে, তারা জীবনে তত কম আনন্দ পায়।
সূর্যের অবয়ব থেকে, আমার চোখ একটু নীচে নেমে এলো। দেখি, দিগন্তের পটভূমিতে আমাদের প্রতিবেশী গ্রাম। ক্যানভাসে আঁকা, ছবির মত ফুটে উঠেছে।
ভাবলাম, অনেকদিন যাই নি ওই গ্রামে। এখন ছুটিতে আছি, তো নিশ্চয় একদিন যাবো। আগে কত গেছি ওই গ্রামে। মাঠের মাঝ দিয়ে ছুটতে ছুটতে গেছি ওই গ্রামে। ওই গ্রামও আমার আত্মীয়। আমার আনন্দের উৎস।
এবার আমাদের বাড়ির নীচে, পুকুরের দিকে নজর গেলো। দেখি, পুকুরের জলের উপর সূর্যের প্রতিবিম্ব ভাসছে। পুরোটা নয়। একটুখানি।
পুকুরের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম আমি। দেখি, হটাৎ একটা মাছরাঙা পাখি, জলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ঝাঁপিয়ে পড়েই দ্রুত গতিতে উড়ে গেলো সে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো, আমাকে আজ বাজারে যেতে হবে। মা বলেছে, দিদি বাড়ির জন্য দুটো বড় মাছ কিনতে হবে। কিন্তু বাজারে যাওয়ার আগে, একটু পড়াশুনা করা দরকার। অর্থাৎ, এখনই আমাকে উঠতে হবে।
তৃষ্ণার কপাল স্পর্শ করলাম। কিন্তু ও কোন সাড়া দিলো না। বুঝলাম, ও আরও একটু ঘুমাবে।
অথচ আমাকে এখনই উঠতে হবে। সকালে একটু পড়াশুনা না করলে, নিজেকে অপরাধী মনে হয় আমার। নিজেকে অপূর্ণ মনে হয় আমার।
অতি সন্তর্পণে, তৃষ্ণাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তারপর বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গেলাম। বারান্দার জানালাগুলো ভালো করে খুলে, বাথরুমে ঢুকলাম। বাথরুমে মুখ হাত ধুয়ে আবার বারান্দায় ফিরে এলাম।
বারান্দায় মাদুর পেতে, পড়তে শুরু করলাম। পূর্বদিকে মুখ করে। এ আমার অনেকদিনের অভ্যাস। মানে, সেই ছোটবেলা থেকে। নিজের অজান্তেই, এ এক সংস্কার হয়ে গেছে। মনে হয়, উদীয়মান সূর্যের দিকে চেয়ে না পড়লে, মনের মধ্যে তেজ আসে না।
সবে পড়তে শুরু করেছি, তো এমন সময় নীচ থেকে মায়ের গলার আওয়াজ ভেসে এলো-
'অমল, উঠেছিস? '
হ্যাঁ, মা।
'তুই পড়তে থাক। আমি চা নিয়ে আসছি।'
আগেই বলেছি, আমি ঘুম থেকে উঠলেই মা জানতে পারে। আমি ঘুম থেকে উঠে এখন যে পড়তে বসেছি, তাও মা বুঝতে পেরেছে। আসলে, আমার সব কর্মই বুঝতে পারে মা।
একটু পর মা এলো। নিঃশব্দে। মাদুরের উপর চা আর বিস্কুট রেখে, মা চলে গেলো আবার। এবারও নিঃশব্দে।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, আবার পড়ায় মন দিলাম আমি। মনে মনে ভাবলাম, হাতে মাত্র চার ঘন্টা সময়। তার এক সেকেন্ডও নষ্ট করা যাবে না।
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem