দিদি তৃষ্ণা আর আমি, আমরা ত্রিমূর্তি ছিলাম। যখন ছোট ছিলাম; তখন এক সাথে খেলতাম, এক সাথে আড্ডা দিতাম আমরা। অবশ্য সবদিন নয়। মাঝে মাঝে।
সব দিন নয় তার কারণ, তৃষ্ণাদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দেড় বা দু কিলোমিটার দূরে। তবুও ওরা প্রায়ই আসতো আমাদের বাড়িতে। আমরাও ওদের বাড়িতে যেতাম। ওদের বাড়ি যাওয়ার মূল আকর্ষণ ছিলো, ওদের বাড়ির পুকুর।
বেশ বড় পার বাঁধানো এক পুকুর। আর পুকুরের চারপাশে বড় বড় আম গাছ, পেয়ারা গাছ আর নারকেল গাছ।
পুকুরে, ইঁট আর পাথর দিয়ে বাঁধানো, বেশ সুন্দর এক ঘাটও ছিলো। আর সেই ঘাটের ডানদিকে, বড় এক আম গাছ ছিলো। সেই আম গাছের বড় একটা শাখা, পুকুরের দিকে ঝুঁকে ছিলো। পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার পক্ষে, বেশ উপযুক্ত ছিলো সেই শাখা। ডাইভিং পুলে যেমন ডাইভিং বোর্ড থাকে, ঠিক তেমনি- সেই শাখা ছিলো আমাদের ডাইভিং বোর্ড।
সেই ডালে চড়ে, পুকুরে ঝাঁপ দিতাম আমরা। রীতিমত প্রতিযোগিতা করে ঝাঁপ দিতাম। কখনো কখনো গাছের শাখা ধরে ঝুলে, দোল খেতাম। তারপর দুলতে দুলতে ঝাঁপিয়ে পড়তাম পুকুরের বুকে। ঊহঃ কি আনন্দ হতো তখন!
কখনো কখনো জলে ডুবে, লুকোচুরিও খেলতাম। ডুবে ডুবে, এক অপরকে খুঁজতাম আমরা। সেই সব খেলার মধ্যে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ ছিলো। সেই রোমাঞ্চ, জীবনে আর কখনো অনুভব করি নি।
আমাদেরও বড় এক পুকুর আছে। কিন্তু তার অংশীদার অনেক। তা হোক, সেখানেও কিন্তু একই রকম হৈচৈ করতাম আমরা।
আসলে, আমাদের পরিবারের সঙ্গে তৃষ্ণাদের পরিবারের বন্ধুত্ব বেশ পুরানো। তৃষ্ণার দাদু ছিলেন আমার দাদুর ক্লাসমেট। সেই সূত্রে, কাকু ছিলেন আমার বাবার বন্ধু। যদিও অসমবয়সী।
বাবা যখন কলকাতার কলেজে ম্যাথেটিক্স পড়াতো, কাকু তখন কলেজের ছাত্র। ছাত্রাবস্থায় কাকু, আমার বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতেন। আমার মা, কাকুকে রান্না করে খাওয়াতেন। কাকু তখনও মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হন নি। আর বিয়েও করেন নি।
বাবা মারা যাওয়ার পর, তৃষ্ণাদের পরিবারই ছিলো আমাদের নিকটতম বন্ধু। আমাদের সাহস। কাজেই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সেই পারিবারিক বন্ধন আরও বেড়েছে।
অবশেষে আমাদের গাড়ি, বাড়ির সামনে থামলো। গাড়ি থামতেই, হটাৎ দিদি দৌড়ে এলো। ঝড়ের গতিতে। বেশ অবাক হলাম আমি। ভাবলাম, একি! আমরা পৌঁছনোর আগেই, ও পৌঁছে গেছে!
গাড়ি থেকে নামতেই, দিদি তৃষ্ণাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর তৃষ্ণাকে ও বললো-
'বাহঃ ঠিক সময়ে পৌঁছে গেছিস। পুকুরে সাঁতার কাটবো আজ! '
তৃষ্ণা কোন উত্তর না করে, দুষ্টু হাসি হাসলো। ওর সেই দুষ্টু হাসির অর্থ, 'তাই? '
ভাবলাম, কি অদ্ভুত! তাই না? গাড়িতে আসতে আসতে, ঠিক এই কথাই ভাবছিলাম। যে কতদিন আমরা হৈচৈ করে সাঁতার কাটি নি!
অন্তত দশ বছর হয়ে গেলো, শেষবার আমরা একসাথে সাঁতার কেটেছিলাম। সেদিন আমার জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিলো। সেই আনন্দে, অন্তত দুঘন্টা হৈচৈ করেছিলাম পুকুরে।
কাকু কাকীমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম আমি। তৃষ্ণাকে সঙ্গে নিয়ে, দিদি আগেই ঢুকে গেছে।
ঘরে ঢুকেই মনে হলো, কোত্থেকে যেন মাছ ভাজার গন্ধ আসছে। বুঝলাম, ভিতরে মা রান্না করছে।
কাকু বসার ঘরের চেয়ারে বসলেন, কিন্তু কাকীমা রান্না ঘরে ছুটে গেলেন। আমি কাকুকে বললাম-
কাকু, আপনি বসুন। আমি একটু আসছি।
ভিতরে গিয়ে দেখি, সবাই রান্না ঘরে। দিদিকে আমি বললাম-
'দিদি, তুই কাকুকে জল দে। আমি ঠাম্মার সঙ্গে দেখা করে আসি।'
তৃষ্ণা আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
'তুমি যাবে, আমি যাবো না? '
আমি কিছু বলার আগেই মা তৃষ্ণাকে বললো-
'যা, তুইও দেখা করে আয়।'
ঠাম্মার ঘর লাগোয়া বড় এক বারান্দা। দেখি, সেই বারান্দায় ঠাম্মা বসে রয়েছে। সামনে, ঠাম্মার পান খাওয়ার সরঞ্জাম। তা দেখে, মনে মনে হাসলাম আমি। ভাবলাম, বামুন যেমন তার পৈতে ত্যাগ করতে পারে না, ঠাম্মা তেমনি তার পান খাওয়ার সরঞ্জাম ত্যাগ করতে পারে না।
ঠাম্মাকে দেখে, ছুটে গেলো তৃষ্ণা। তারপর ঠাম্মাকে জড়িয়ে ও জিজ্ঞেস করলো-
'কেমন আছেন ঠাম্মা? '
ঠাম্মা কোন উত্তর করলো না। কেবল তৃষ্ণার চিবুক ধরে হাসলো। ঠাম্মার পান খাওয়া গালে, ফোকলা দাঁতের হাসি।
ঠাম্মাকে প্রণাম করলাম আমরা। ঠাম্মা তৃষ্ণাকে জিজ্ঞেস করলো-
'কিরে, পান খাবি? '
তৃষ্ণা জিজ্ঞেস করলো-
'মিষ্টি পান? '
ঠাম্মা কোন উত্তর না করে, পান সাজতে শুরু করলো। আমি ঠাম্মার হাতের দিকে চেয়ে রইলাম। দেখলাম, ঠাম্মার হাত মাঝে মাঝে কাঁপছে। কিন্তু ঠাম্মা তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করলো না। বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর বুঝলাম, ঠাম্মার হাতের কাঁপুনিটা বাড়ে নি। আগে যেমন ছিলো, ঠিক তেমনই আছে।
আসলে, ঠাম্মার পার্কিনসন ডিজিজ রয়েছে। কিন্তু ঠাম্মা সেজন্য ওষুধ খেতে চায় না। আমার ভয় ছিলো, ওষুধ না খেয়ে, ঠাম্মার রোগ হয়তো বাড়বে। কিন্তু আজ একটু ভরসা পেলাম।
পান সাজা শেষে, দুটো পান আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলো ঠাম্মা। তৃষ্ণা জিজ্ঞেস করলো -
'বাণীদির জন্য বানাবেন না? '
ঠাম্মা আবার ফোকলা হাসি হাসলো। তারপর বললো-
'বাণী তো এই মাত্র খেয়ে গেলো! '
কথাটা বলেই, আরও একটা পান সাজতে শুরু করলো ঠাম্মা।
মুহূর্তকাল অপেক্ষা করার পর, তৃষ্ণা ঠাম্মাকে বললো-
'পুকুরে সাঁতার কাটবো আমরা। আপনি নামবেন না? '
ঠাম্মা পান সাজা শেষ করে, তৃষ্ণার চিবুক ছুঁলো। তারপর বললো-
'আমার কি আর সে বয়স আছে রে মা? '
পান চিবোতে চিবোতে তৃষ্ণা বললো-
'এখন আসছি ঠাম্মা। বিকেলে আপনার সাথে গল্প করবো। '
ঠাম্মা হাঁটুর উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। আমি ঠাম্মাকে সাহায্য করলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম-
উঠলে কেন?
'শ্রী আর চৈতি এসেছে। একটু দেখা করে আসি।'
তোমাকে যেতে হবে না। ওনারা আসবেন তোমার কাছে।
ঠাম্মাকে ধরে আবার বসিয়ে দিলাম আমি। ঠাম্মা বললো-
'তবে পাঠিয়ে দে ওদেরকে।'
ঠাম্মার কাছে বিদায় নিয়ে বসার ঘরে ফিরে এলাম আমরা।
তৃষ্ণা ওর বাবাকে বললো-
'বাপি যাও, ঠাম্মার সাথে দেখা করে এসো।'
কাকু তৃষ্ণাকে জিজ্ঞেস করলেন-
'কিরে, পান খাচ্ছিস নাকি তুই? '
কাকীমা হাসতে হাসতে বললেন-
'বুড়ীর কাছে গেলে, পান না খাইয়ে ছাড়বে তোমাকে? '
একটু থেমে কাকীমা কাকুকে বললেন-
'চলো, দেখা করে আসি জেঠিমার সাথে।'
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem