ঝিনুকের সন্ধানে ৩ (Trishna) Poem by Arun Maji

ঝিনুকের সন্ধানে ৩ (Trishna)

ঘরে ফিরতে ফিরতে, সন্ধ্যে ছটা বেজে গেলো।

ঘরে ঢুকতেই, তৃষ্ণা অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলো আমাকে। আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম-
ব্যাপার কি?

একটু অধৈর্যের সুরে ও জিজ্ঞেস করলো-
'এত দেরী করে বাড়ি ফিরলে? '

কি করবো? প্রথম দিন। তাই একটু দেরী হলো।

'তোমার ছুটি হয় কখন? '

পাঁচটার সময়।

প্রতিদিন পাঁচটার পর আসবে তুমি?

কাকীমা রান্না ঘরে ছিলেন। উনি তৃষ্ণার উদ্দেশে বললেন-
'পাঁচটা তো অনেক ভালো রে। অন্য ডাক্তাররা তো আটটা পর্যন্ত কাজ করে।'

তৃষ্ণা আর কথা বাড়ালো না। ধীর পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো ও। তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে ও বললো-
'জানো, ইউনিফর্মে দারুন লাগছে তোমাকে।'

কাকীমা তৃষ্ণার উদ্দেশে জিজ্ঞেস করলেন-
'কেন? আগে ওকে ইউনিফর্মে দেখিস নি? '

তৃষ্ণা
'আগে দেখলাম কোথায়? আজই তো প্রথম দেখলাম।'

কাকীমা
'সে কি রে, তোর বর এত বছর চাকরী করে মেজর হয়ে গেলো। আর তাকে এখনো ইউনিফর্মে দেখলি না? '

তৃষ্ণা
'দেখবো কি করে? ও তো এতদিন জঙ্গলে জঙ্গলে দিন কাটিয়েছে।'

কাকু বোধহয় বারান্দায় ছিলেন। উনি ড্রয়িং রুমের দিকে এগোতে এগোতে বললেন-
'দাঁড়া, তোদের দুজনের ফটো তুলে দিই আজ।'

তৃষ্ণা আনন্দে প্রায় লাফাতে শুরু করলো। লাফাতে লাফাতে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো ও। বললো-
'প্লিজ, তুলে দাও বাপি।'

এবার ও আমার দিকে চেয়ে বললো-
'শোনো, ইউনিফর্ম খুলো না। আমি একটু সেজে আসছি।'

তৃষ্ণা বেডরুমের দিকে রওনা দিলো। কাকীমা তৃষ্ণার উদ্দেশে চীৎকার করে বললেন-
'কিরে, তুই সাজবি, ও সাজবে না? সারাদিন কাজ করে এলো, ও তো এখন বিধ্বস্ত।'

তৃষ্ণা এবার হুকুমের স্বরে আমাকে বললো-
'এসো তাহলে, বাথরুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও।'

কাকু হাসতে হাসতে কাকীমাকে জিজ্ঞেস করলেন-
'ওরা ছবি তুলবে, তুমি তুলবে না? '

কাকীমা এতক্ষণ রান্না করছিলেন। উনি বললেন-
'ডালটা বানিয়ে নিই। তারপর আসছি।'

বেডরুমে ঢুকেই, বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলো তৃষ্ণা। তারপর বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে করতে ও বললো-
'ইউনিফর্ম খুলে রেডি হও তুমি। ততক্ষণে চট করে স্নান করে নিই আমি।'

ইউনিফর্ম খুলে রেডি হয়ে চেয়ারে বসলাম আমি। ভেতর থেকে তৃষ্ণা জিজ্ঞেস করলো আমাকে-
'কিগো, কেমন কাটলো প্রথম দিন? '

খুব স্ট্রেসফুল।

'স্ট্রেস! কেন? '

খুব ব্যস্ত হাসপাতাল। সেই সঙ্গে প্রথম দিন আজ।

'হুঁ, ঠান্ডা থেকো। মাথা গরম করো না।'

মিনিট তিনেক পর, তৃষ্ণা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। আমার উদ্দেশে ও বললো-
'যাও, তুমিও স্নান করে নাও। ভালো লাগবে তোমার।'

তৃষ্ণা সাজতে শুরু করলো। আর আমি, বাথরুমে ঢুকলাম।  

বাথরুমে ঢুকেই শাওয়ারের ট্যাপ খুলে দিলাম। মাথায় ঠান্ডা জল পড়তেই ভাবলাম- বাব্বাঃ বাঁচা গেলো। সারাদিন যে কি ধকল গেলো!

হটাৎ ঘর থেকে তৃষ্ণা আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
'কিগো, সন্ধ্যে ছটার সময় যদি ফিরবে, তো এক্সারসাইজ করবে কখন? '

হুঁ, সেটাই তো কথা!

'জিম নেই এখানে? '

আছে। ফোর্ট উইলিয়ামে।

'সন্ধ্যের পর জিমে যাওয়া বড় ঝক্কি।'
 
তো, সকাল ছটার সময় দৌড়তে চলো।

'তাহলে তো সকাল সাড়ে পাঁচটার সময় উঠতে হবে। পারবে? '

কেন পারবো না? এতদিন তো তাই করেছি।

'তাহলে তো রাত নটার সময় ঘুমুতে হবে।'

হুঁ, সেই বরং ভালো। স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, তৃষ্ণা প্রায় তৈরী। ওর পরণে লাল শাড়ি। সঙ্গে কালো ব্লাউজ। আর সেই কালো ব্লাউজের হাতার উপর, লাল রঙের ফুলের কাজ। বেশ সুন্দর মোহিনী লাগছে ওকে।

ওর দিকে চেয়ে দেখতেই, মিষ্টি হাসি হাসলো ও। তারপর কপালে লাল টিপ পরতে পরতে ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
'কি, কিছু তো বললে না? '

হাসলাম আমি। বললাম-
খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।

'আমার কথা নয়। শাড়িটার কথা তো কিছু বললে না? '

শাড়ির কথা ঠিক কি বলবো বুঝতে পারলাম না। ভারতীয়দের কাছে সব চীনা মানুষকে যেমন একই রকম লাগে, ঠিক তেমনি সব লাল শাড়িই আমার কাছে একইরকম লাগে। তবে এটা জানি যে, তৃষ্ণা লাল শাড়ি ভালোবাসে।

আমাকে ভাবতে দেখে ও জিজ্ঞেস করলো-
'কি, বলতে পারলে না তো? '

আমি কোন উত্তর না করে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। শাড়ির ভাঁজ ঠিক করতে করতে তৃষ্ণা বললো-
'এটা তোমার দেওয়া প্রথম শাড়ি।'

আমি হাসলাম। মনে পড়ে গেলো, আজ থেকে দশ বছর আগে, ওষুধ দোকানে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম আমি। আর সেই টাকা দিয়ে, এই শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম ওকে।

তৃষ্ণার দামি দামি আরও অনেক শাড়ি আছে। তবুও কিন্তু বিশেষ বিশেষ দিনে, ও এই শাড়িটাই পরে।  আশ্চর্য! তাই না? অর্থের চেয়েও মূল্যবান হলো, ভালোবাসার স্মৃতি। ভালোবাসার মূল্য অর্থ দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না।

তৃষ্ণা এবার আমাকে তাড়া দিলো। বললো-
'রেডি হয়ে নাও। বাপি অপেক্ষা করছে।'

কথাটা বলতে বলতে ও একটা নতুন গেঞ্জি বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। তারপর ও বললো-
'শোনো, আমি ড্রয়িং রুমে যাচ্ছি। তুমি রেডি হয়ে এসো।'

তৃষ্ণা চলে গেলো। আলমারিতে আরও এক সেট নতুন ইউনিফর্ম ছিলো আমার। সেটা পরলাম। তারপর চুল আঁচড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি।

বাইরে বেরোতেই কাকু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-
'কিগো, জুতো পরবে না? জুতো ছাড়া কখনো ইউনিফর্ম মানায় না।'

কাকু এরপর তৃষ্ণার দিকে চেয়ে বললেন-
'তৃষ্ণা, তুইও জুতো পরে নে।'

আমার সঙ্গে সঙ্গে, তৃষ্ণাও জুতো পরলো।

জুতো পরার পর, দেওয়ালের দিকে পিঠ করে দাঁড়ালাম আমরা। তৃষ্ণা ওর হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি ওর হাত ধরলাম।

কাকু বেশ কতকগুলো ফটো তুললেন। তারপর উনি কাকীমার দিকে চেয়ে বললেন-
'এসো, তুমিও দাঁড়াও ওদের সাথে।'

কাকীমাকে মাঝখানে রেখে, আরও কতকগুলো ফটো তুললাম আমরা।

তৃষ্ণা ওর বাবাকে বললো-
'বাপি, তুমি আসবে না? '

কাকীমা বললেন-
'সেই তো! মেয়ে জামাইয়ের সাথে তুমি ফটো তুলবে না? '

এবার কাকীমা ফটোগ্রাফার সাজলেন। কাকুকে মাঝখানে রেখে আরও কতকগুলো ফটো তুললেন উনি।

ফটো তুলা শেষে, আমি তৃষ্ণাকে বললাম-
তোমরা বসো, আমি জামাকাপড় ছেড়ে আসি।

তৃষ্ণা হটাৎ চীৎকার করে বললো-
'এই যা, ভুলেই গেছি! বারান্দায় ফটো তুলবো আমরা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম-
বারান্দায় মানে?

তৃষ্ণা
'ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ফটো তুলবো আমরা।'

কাকু হাসলেন। তৃষ্ণাকে বললেন-
'দাঁড়িয়ে দেখ। কিন্তু কম আলোতে ফটো কেমন হবে, তা বলা মুশকিল।'

তৃষ্ণা ওর বাবাকে বললো-
'চেষ্টা তো করে দেখি।'

তৃষ্ণা প্রায় বারান্দায় ছুটে গেলো। আমরাও পর পিছু পিছু গেলাম। বারান্দায় পৌঁছে তৃষ্ণা বললো-
'আর্মি এত সুন্দর জায়গায় ফ্ল্যাট  দিয়েছে, তো কিছু স্মৃতি রাখবো না? '

কাকু আরও বেশ কতকগুলো ফটো তুললেন।

অবশেষে, তৃষ্ণা হাসতে হাসতে আমাকে বললো-
 'তুমি চেঞ্জ করো। আমি এখন এই কাপড়েই থাকবো।'

ঘরের দিকে রওনা দিলাম আমি। যেতে যেতে ভাবলাম, ছবি কেবল ছবি নয়। ছবি সুন্দর এক স্মৃতি। সুন্দর এক সাক্ষী। ভালোবাসার সাক্ষী। বন্ধনের সাক্ষী।

একদিন আমাদের চুল পড়ে যাবে। মুখের চামড়া ঝুলে যাবে। চোখ ঝাপসা হয়ে যাবে। সেদিন কেবল বেঁচে থাকবে, আজকের উদ্ধত যৌবনের স্মৃতি। আজকের হাসি মুখের স্মৃতি।

দুঃখ অবসাদ ভরা বার্ধক্যে, তা অমূল্য নয় কি?  

© অরুণ মাজী

ঝিনুকের সন্ধানে ৩ (Trishna)
Wednesday, January 4, 2023
Topic(s) of this poem: bangladesh,bangla
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success