১.
গাড়ি গেটের কাছে পৌঁছতেই, রক্ষী ছুটে এলেন।
প্রথমে আমার গাড়ির মধ্যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর করলেন উনি। তারপর আমাকে স্যালুট ঠুকে উনি বললেন-
'জয় হিন্দ সাহাব।'
আমি প্রতি-স্যালুট করে বললাম-
জয় হিন্দ।
গাড়ির কাঁচ নামিয়ে, আমার ID কার্ড দেখালাম ওনাকে। উনি সেটা পরীক্ষা করে ফিরিয়ে দিলেন আমাকে।
গেট খুললেন উনি। আমি ভিতরে ঢুকলাম।
তারপর গেট থেকে সোজা পার্কিং এলাকাতে গেলাম। সেখানে গাড়ি পার্ক করে, গাড়ি থেকে নামলাম। গাড়ি থেকে নেমেই, সামনে চেয়ে দেখলাম।
কমান্ড হাসপাতাল। আর্মির অনেকগুলো বড় হাসপাতালের মধ্যে, আলিপুর কমান্ড হাসপাতাল একটা।
ভারতের খুব কম হাসপাতাল এত পুরানো। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, ১৮৩৫ সালে। আর এই কমান্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৮৭০ সালে। যদিও ভারতের প্রাচীনতম হাসপাতাল হলো- L'Ecole de Médecine de Pondichéry. যা বর্তমানে, Jawaharlal Institute of Postgraduate Medical Education & Research (JIPMER) নামে পরিচিত। JIPMERএর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, ১৮২৩ সালে। অতীত নাম দেখলেই বোঝা যায়, ফরাসীরা এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আগে কমান্ড হাসপাতাল ছিলো, কলকাতা রেসকোর্স এলাকায়। তখন এর নাম ছিলো 'ব্রিটিশ মেডিক্যাল হসপিটাল'। তখন এর বেড সংখ্যা ছিলো মাত্র ৬০টা। কিন্তু আজকে যে কমান্ড হাসপাতাল আমরা দেখি, তার সূচনা হয়েছিলো ১৯৬৮ সালে। এই আলিপুরে।
মনে পরে গেলো, দশ বছর আগের কথা। একদিন আমি আর তৃষ্ণা, হাসপাতালের সামনের পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। পথ হাঁটতে হাঁটতে, হটাৎই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম এখানে। তারপর হাঁ করে চেয়েছিলাম, এই হাসপাতালের দিকে। এমনকি হাসপাতালের গেট দিয়ে ভিতরে উঁকিও মেরেছিলাম। তা দেখতে পেয়ে, রক্ষী ছুটে এসেছিলেন। আমাকে মৃদু ভর্ৎসনা করে, গেট থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন উনি।
তাড়া খেয়ে গেট ছেড়ে যাওয়ার সময়ও, ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিলাম এই হাসপাতালের দিকে। ভেবেছিলাম, উহঃ কি সুন্দর হাসপাতাল! কি পরিষ্কার পরিছন্ন! সুন্দর লন। সুন্দর বাগান। সুন্দর সাজে সজ্জিত রক্ষী ইত্যাদি।
তৃষ্ণা হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিলো-
'ঊহঃ তুই একটা যা তা অমল! '
আমি হেসে বলেছিলাম-
হাসপাতালটা খুব সুন্দর! তাই না?
তৃষ্ণা
'হুঁ, খুব সুন্দর। চাইলে তুইও এখানে ডাক্তারি করতে পারবি।'
হাসপাতালের গার্ডগুলোও খুব সুন্দর পোশাক পরে। তাই না?
'ওগুলো ওদের সেরেমোনিয়াল ড্রেস।'
সেরেমোনিয়াল ড্রেস মানে?
'বিভিন্ন উপলক্ষে, আর্মির বিভিন্ন ড্রেস হয়। সেরেমোনিয়াল ড্রেস তাদের একটা। '
আর বেশি কথা বাড়াই নি সেদিন। আসলে, আর্মি সম্পর্কে আগে কিছুই জানতাম না। কিন্তু তৃষ্ণা একটু আধটু জানতো। ওর মামাদাদু ছিলেন, আর্মির ব্রিগেডিয়ার। আর্মির ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন উনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, তৃষ্ণা যখন ছোট ছিলো, তখনই ওর মামাদাদু মারা যান। হটাৎ।
ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম। দেখি, সকাল সাড়ে সাতটা।
হাসপাতালে ঢুকলাম আমি। ঢুকেই রেজিস্ট্রার অফিসে গেলাম। আমাকে দেখেই, রেজিস্ট্রারের ওয়েটার হাসলেন। তারপর আমাকে স্যালুট করলেন উনি। আমিও ওনাকে প্রতি- স্যালুট করলাম। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম-
রেজিস্ট্রার আছেন?
'হ্যাঁ, সাহাব। উনি ভিতরে।'
রেজিস্ট্রারের অফিসে ঢুকলাম। দেখি, উনি কারও সাথে ফোনে কথা বলছেন। আমি ওনাকে স্যালুট করলাম। উনি ডান হাত তুলে স্যালুট গ্রহণ করলেন। তারপর আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করলেন।
চেয়ারে বসলাম আমি। মিনিট খানেক পর উনি ওনার কথা শেষ করলেন। তারপর আমার উদ্দেশে বললেন-
'মেজর বোস..'
স্যার।
'শোনো, এখনো সবাই আসে নি। তুমি পাশের ঘরে বসে চা খাও। আটটার সময় MI রুমে নিয়ে যাবো তোমাকে।'
চেয়ার ছেড়ে পাশের ঘরে এলাম আমি। এই ঘর হলো, অফিসাদের আড্ডা মারার জায়গা। এখানে বড় বড় সোফা রাখা রয়েছে। আর রয়েছে চায়ের ব্যবস্থা। আগেও এঘরে এসেছি। বসে, চা পান করেছি।
ঘরে ঢুকে, এক কাপ চা বানালাম। তারপর চা আর বিস্কুট নিয়ে সোফায় বসলাম।
চা পান করছি, এমন সময় এক ব্রিগেডিয়ার ঘরে ঢুকলেন। ওনাকে দেখে, সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। বললাম-
গুড মর্নিং স্যার!
'গুড মর্নিং। তোমাকে তো আগে কখনো দেখিনি! '
কথাগুলো বলতে বলতে, উনি ওনার জন্য চা বানাতে শুরু করলেন। আমি বললাম-
আজ এখানে প্রথম দিন আমার।
'হুঁ।'
চা বানানো শেষে, কাপ হাতে উনি আমার পাশে এসে বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন-
'কোথা থেকে আসছো? '
কাশ্মীর থেকে।
'কার্গিল যুদ্ধে ছিলে? '
হ্যাঁ স্যার।
'কতদিন? '
চার বছর।
'চার বছর! বলো কি? তুমি পাক্কা চক্রবর্তী! '
আমি হেসে উঠলাম। কিন্তু কোন মন্তব্য করলাম না।
আসলে, আর্মিতে অদ্ভুত এক জোক্স চালু আছে। আর্মিতে একদল অফিসার আছেন, যারা কেবল কঠিন কঠিন ফিল্ড পোস্টিং করে বেড়ান। তারা দূরে দূরে চক্কর মারেন বলে, তাদেরকে বলা হয় চক্রবর্তী।
আর একদল অফিসার আছেন, যারা কেবল বিভিন্ন হেডকোয়ার্টারে আরামের পোস্টিং করে বেড়ান। তারা সবার মধ্যমনি হয়ে থাকেন বলে, তাদেরকে বলা হয় মধ্যবর্তী।
ব্রিগেডিয়ার চা পান শেষ করলেন। তারপর সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন উনি। আমার উদ্দেশে উনি বললেন-
'ভেরি ওয়েলকাম। আমি এখন আসছি। পরে দেখা হবে।'
উনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম। দেখি, সকাল আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি।
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর আবার রেজিস্ট্রারের অফিসে ঢুকলাম। আমাকে দেখেই, উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। তারপর আমাকে বললেন-
এসো, MI রুমটা বুঝিয়ে দিই তোমাকে।
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem