রাস্তায় বেরোতেই, অনেকেই আমাদের দিকে চেয়ে দেখলো। কেউ কেউ ড্যাবড্যাব করে। কেউ কেউ আড়চোখে। কেউ এই দুইয়ের মাঝামাঝি। কেউ কেউ আবার আমাদের দিকে চেয়ে হাসলো। কেউ দেখিয়ে হাসলো। কেউ লুকিয়ে হাসলো।
আসলে, এ পাড়ার বেশিভাগ লোকজনই তৃষ্ণার বেশ পরিচিত। এদের কেউ কেউ, তৃষ্ণাকে ওর কুশল জিজ্ঞেস করলো। ওর মা বাবার খোঁজ নিলো, ইত্যাদি।
সামনে হাঁটতে হাঁটতে, হটাৎই লাফিয়ে উঠলো তৃষ্ণা। সামনের একটি যুবতী মেয়েকে দেখে ও বললো-
'আঁখি, তুই? '
মনে হলো, আঁখিদেবী তৃষ্ণারই বয়সী। ওনার পরণে কুর্তা আর পাজামা। আর কপালে সুন্দর লাল টিপ।
আঁখি প্রথমে আমাকে আড়চোখে দেখলেন। তারপর কালো চোখে আড়াআড়ি হাসলেন। অবশেষে তৃষ্ণাকে বুকে জড়িয়ে উনি বললেন-
'ঊহঃ কতিদন পর তোর সাথে দেখা! '
তৃষ্ণা
'হুঁ, সেই কবে দেখেছিলাম তোকে! '
কেন জানি না, এই সংলাপ শুনলেই আমার deja vu অভিজ্ঞতা হয়। কলকাতার পথ হাঁটছে, অথচ দুই বাঙালী নারীর এই সংলাপ শুনে নি, এমন বাঙালী মঙ্গল হয়তো গ্রহে আছে। কিন্তু পৃথিবী নামাঙ্কিত এই নীল গ্রহে নেই।
আসলে, সমস্যাটা অন্য জায়গায়। এই 'কতদিন'-টি ঠিক কতদিন, তা বোঝা বড় দুঃসাধ্য। কেউ কেউ, কয়েকদিন আগে যার সাথে পান্তাভাত খেয়েছে; তাকে দেখে বলে- 'ঊহঃ কতিদন পর তোর সাথে দেখা! ' কেউ কেউ, ত্রিশ বছর আগে যার সাথে স্কুলে পড়েছে; তাকে দেখে বলে- 'ঊহঃ কতিদন পর তোর সাথে দেখা। আসলে, বাঙালী কাব্য আর রাজনীতির গালি যতটা ভালোবাসে, অংক ততটা ভালোবাসে না। বোধহয় অঙ্কে কাঁচা হওয়ার জন্যই, বাঙালী এখনো পরিমাণকে ঠিকমত কোয়ালিফাই করতে শিখে নি।
আঁখিদেবী এবার আমাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর উনি তৃষ্ণাকে জিজ্ঞেস করলেন -
'এটা কি তোর বর? '
তৃষ্ণা সলজ্জ হাসি হাসলো। বললো-
'হ্যাঁ। ওর নাম অমল।'
হেসে ওনাকে নমস্কার করলাম আমি। তৃষ্ণা হাসতে হাসতে আমাকে বললো-
'নমস্কার করতে হবে না। আঁখি আমার কলেজের বন্ধু। '
দুষ্টু হাসি হেসে, এবার দুষ্টু মন্তব্য করলেন আঁখিদেবী। বললেন-
'যে ছেলেরা একটু হ্যান্ডসাম, তারা ফচকে হয়। কিন্তু যারা বেশি হ্যান্ডসাম, তারা বড় রাশভারী হয়।'
তৃষ্ণা হেসে ফেললো। ও বললো-
'রাশভারি নয়। ও একটু লাজুক।'
এবার আঁখিদেবী তৃষ্ণার হাত ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
'এখন কি করিস তুই? তোর বর থাকে কোথায়? '
তৃষ্ণা
'কলকাতায় নতুন পোস্টিং এসেছে ও।'
আঁখি
'পোস্টিং মানে? '
তৃষ্ণা
'আগে কাশ্মীরে ছিলো। এখন কমান্ড হাসপাতালে পোস্টিং পেয়েছে।'
চোখ দুটো বড় বড় করে আঁখিদেবী বললেন-
'তোর বড় আর্মির ডাক্তার? হুঁ, এজন্যই এত রাশভারী ও।'
তৃষ্ণা আঁখিদেবীকে জিজ্ঞেস করলো-
'তোর খবর কি? '
আঁখি
'খবর আর কি? এই চলছে! চাকরি আর সংসার।'
তৃষ্ণা
'তোরা কি এ পাড়াতেই থাকিস? '
আঁখি
'হ্যাঁ। পার্কের ওপারে শশুর বাড়ি আমার।'
তৃষ্ণা
'আসিস একদিন আমাদের বাড়িতে। আমরা সেই একই বাড়িতে রয়েছি।'
আঁখি
'হুঁ, আসবো। তোরাও আসিস আমাদের বাড়িতে।'
তৃষ্ণা
'আগে আমাদের বাড়ি আয়। তারপর একদিন আসবো তোদের বাড়িতে। '
আঁখি
'ঠিক আছে। এক ছুটির দিনে আসবো।'
অবশেষে, তৃষ্ণা আঁখিদেবীর কাঁধে হাত রেখে বললো-
'আজ আসি রে। একটু তাড়া আছে। মা অপেক্ষা করছে।'
আঁখি
'ঠিক আছে।'
আঁখি দেবী দু পা এগিয়ে গেলেন। তারপর পিছন ফিরে উনি বললেন-
'জানিস তৃষ্ণা? তোকে কিন্তু দারুন লাগছে। আর তোর বরকেও।'
তৃষ্ণা হাসলো। বললো-
'যাহঃ ফাজলামি করিস না। বাড়িতে আয় গল্প করবো।'
আঁখিদেবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বাজারের পথে এগিয়ে গেলাম আমরা।
এখন সন্ধ্যে পেরিয়ে সবে রাত হয়েছে। বাজার ভিড়ে ঠাসা। এমন ভিড় যে সোজাসুজি হাঁটা যায় না। গুঁতোগুঁতি করে হাঁটতে হয়। অন্যের সাথে ঘষাঘষি করে হাঁটতে হয়। অন্যের ঘামের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে হাঁটতে হয়। কখনো কখনো আবার মধ্য বয়স্কা নারীর আপাত কারণহীন গালি শুনতে শুনতে হাঁটতে হয়।
সেজন্য অবশ্য, ঐ নারীকে দোষ দেওয়া যায় না। আসলে, এদেশে, নেতাদের পরম ভক্তরা চায় না, তাদের নেতাদেরকে কেউ দোষারোপ করুক। বা গালি করুক। তা যদি কেউ করে, তো নেতাদের ভক্তরা লাঠি শাবল আর দড়ি নিয়ে, রে রে করে ছুটে আসে তার ঘরে।
ভক্তরা, তার ঘর ভাঙচুর করে। তার স্ত্রী আর বোনকে ধর্ষণ করে। তার বৃদ্ধ বাবা মায়ের হাত পা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। অবশেষে, সেই সমালোচককে তারা গলায় দড়ি বেঁধে কাঁটা যুক্ত বাবলা গাছে ঝুলিয়ে দেয়। তারপর খবরে কাগজে তারা খবর করে, লোকটি অবসাদে আত্মহত্যা করেছে।
এরপর নেতাদের দক্ষ আর সৎ পুলিশবাহিনী আসে। কিন্তু তদন্তের আগেই, তারা আত্মহত্যার সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করে দেয়। আর দেশের মিডিয়া হটাৎই সেসব ভুলে যায়। মিডিয়ার ভাবখানা এমন হয়, যেন কদিন আগে কিছুই ঘটে নি।
তো এই অবস্থায়, ওই মধ্যবয়স্কা নারী, আর কাকে গালি দেবে? ঈশ্বরকে গালি করলে, ঈশ্বর ভক্তরা তেড়ে আসে। নেতাদেরকে গালি করলে, নেতার ভক্তরা তেড়ে আসে। প্রশাসনকে গালি করলে, প্রশাসন গাঁজার কেস ঠুকে, তাকে লক আপে ঢুকিয়ে দেয়। গরীব বরের বাপ ঠাকুরদাকে গালি করলে, তার বর অপমান বোধ করে।তো ওই মধ্যবয়স্কা নারী, আর কাকে গালি দেবে?
শক্ত ক্ষমতাশালীরা চরম অপরাধ করলেও, মানুষ তাদেরকে গালি করতে পারে না। কারণ, শক্তের ভক্তরা তখন তাদের উপর অত্যাচার করবে। অতএব সাধারণ মানুষ সহজ পথ বেছে নেয়। তা হলো, দুর্বলকে গালি করা। দুর্বলকে প্রহার করা। নেতারা হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করছে, কিন্তু মানুষ তাদেরকে গালি করতে পারছে না। কিন্তু ন বছরের পথ-শিশু যদি খিদের জ্বালায় এক পিস রুটি চুরি করে, তো সাধারণ মানুষ সেই শিশুটিকে গণপ্রহার করে খুন করে।
আসলে, এদেশে ফুটপাথ বলে কিছু নেই। যেটুকু আছে, সেটুকু হকাররা বেদখল করে রেখেছে। তো এমন ভিড়ে ঠাসা সংকীর্ণ ফুটপাথে, বিপদ ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তো ঐ নারীটি অন্যের ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। রাস্তার পাথরে পড়ে, ওনার মাথা ফেটে যেতে পারতো। আমি ওনাকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করলাম। যেহেতু এমন এক পুণ্য করলাম আমি, সেহেতু নারী কণ্ঠের অমৃত মধুর গালি আমার প্রাপ্য ঘটলো। ঈশ্বর সত্যিই মঙ্গলময়! A true champion of justice!
তৃষ্ণা হাসতে হাসতে আমাকে বললো-
'Don't feel bad. They know not what they doing.'
আহাঃ তৃষ্ণা কণ্ঠে খ্রিস্টবাণী! অতএব আমি খুশি। আমি ধন্য।
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem