P1
আমি এক চিহ্নিত প্রস্তরখণ্ড ১
সৌম্যেন চট্টোপাধ্যায়
অন্তঃপুরে মৃত পাখিদের ডানার নির্জন কঙ্কাল মাটির
সরল ত্রিসন্ধ্যা ছুঁয়ে শুয়ে আছে— এখানে আমার মহাকাশ
আমারই হাজার বিস্তারের বিগত শিকড় রাত্রির পাথরে
লীন হয়ে গেছে। ক্ষতচিহ্নগুলি দেখেছি সৌধের মতো শূন্যে
ছড়িয়ে রয়েছে— সৃজনের দহনের শিখার নিঃস্বতা নিয়ে।
বামনী গাঁয়ের পাহাড়ি অরণ্যে স্থির ও কঠিন মাটি আজও
কাঁপে ছো শিল্পীর রাখালিয়া নাচে। চিন্তামণির গম্ভীর মুড়া
নাগড়া ও বাঁশি হাতে এখনো শূন্যের দেশে ঘুরপাক খায়
মুখোশের বিস্তর জঠরে। নিভৃত রাত্রিতে ভাতের সংকেতে
শীতার্ত সংসার দাউ দাউ জ্বলে। বল্গা হরিণের পোশাকের
ভাস্কর্য নির্বাক ছবি হয়, তুঙ্গমুহূর্তে তবুও বিমূর্তের
জন্ম দেয়। শব্দের ভেতর নিঃশব্দ অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার আগুন
অনার্যের ঘনিষ্ঠ প্রান্তরে বহু ব্যতিক্রমী সভ্যতা মৃত্যুকে
স্পর্শ করে প্রাক - ক্যামব্রিয়ান শিলার কাঁকুরে মাটির স্তরে
বজ্রভূমে নিজেকে গেঁথেছে সেনোজোয়িকের সময়ের গাত্রে।
দেহাতীত সিন্ধুবালা মালাবতী ঝুমুরের জীবাশ্ম জাগিয়ে
রেখে ভোররাতে গেয়ে চলে রামকৃষ্ণ জগৎ কবির গান।
কালমি গ্রামের অনন্ত উঠোন কাঁদে; প্রহ্লাদ গোঁসাই সেই
সুরে গায়- ব্রজেশ্বরী দয়া কর - দাও পদযুগলের রেনু
কর কিঙ্করীর কিঙ্করী, না হয় কর ব্রজবনের শূকরী
নষ্ট হোক আমার প্রপঞ্চ তনু — এসবে আমার মুখচ্ছবি
আত্মপ্রতিকৃতি মানভূমের বিষাদী ভাসমান জলে ভাসে।
অন্ধকার আকাশের তলায় সকল দেহজ প্রত্যঙ্গ গুলি
মুক্তক বিশ্বের আলোর কণিকা হয়ে উড়ে যেতে চেয়েছিল
উদার হাওয়ায়। মহাশূন্যে ক্ষণজন্মা জলপ্রপাতের দীর্ঘ
ক্ষীণ সুর প্রাণে আসে— হৃদয়ে আকুল হয়ে ধরতে চেয়েছি
যাকে প্রিয় রামনিধি তুমি সেই তুমি সেই কিশোরী রূপাই
কুমারীর জল, কুলুকুলু বয়ে যাও শুকনো বুকের পথে
বিশীর্ণ বালুকা নুড়ি পাথরের খাতে বহু আষাঢ়ের শেষে।
প্রাগ - আর্য জাতির নিঃশ্চুপ চৌখুপী প্রত্ন দেউলঘাটা তার
ভাঙাচোরা ছায়া গোরানদী জলে দেখে। চুনসুরখির গাঁথা
চূড়া ঝরে পড়ে কাঁসাই সাহারজোড়ে। ধ্বংসস্তূপে দৃশ্যমান
তীর্থঙ্কর তেলকূপী পঞ্চকোটে সৌষ পাহাড়িয়া বীরহোড়
শবর বেদিয়া ঘাসী ভূমিজের স্বেদ শব্দগুঁড়ো খুঁজেছিল
মানুষের কণ্ঠস্বরে। মানভূমের সমুদ্র আঁধারের মৌন
ইতিহাসে সেই নীলাভ গুঞ্জন একাকী অজানা কোন এক
বহুদূর মৃত্যুলোকের তৃষিত বাঁশির মন্থর ধ্বনিস্বর
পর্বত সংকুল শিলার শরীরী স্নায়ুতটে সমাহিত হয়ে
নির্জনে উৎকীর্ণ করে ধূসর স্মৃতির শিলালিপি যন্ত্রণার
গভীরতা, অভিশপ্ত নির্বাসন আরো কোন এক দর্শনের
জন্ম দেয় যেখানে সংকীর্ণ চেতনার অন্তর্লীন বেদনার
স্তর মৃত্যুপথের তীব্রতা অতিক্রম করে এই বজ্রভূম।
রামনিধি রামনিধি সমস্ত শব্দের ভার স্তব্ধ করে দাও—
বহু ব্যর্থতার পর এই উন্মুক্ত আকাশতলে দাঁড়িয়েছি
কন্ঠনালী চেপে তোমার বাঁশির সুরস্বাদে আমাকে জাগাও
আমার শরীর জন্মহীন এক ভাষা; তুমি সুর দাও এই
নৈঃশব্দ্যের কোলে আমাকে জাগাও দেহে আদি মুদ্রা গেঁথে দিয়ে
তোমার সুরের সঞ্চারী অন্তরা স্থায়ীটুকু বেঁধেছে জন্মের
মায়াবী অস্তিত্ব। এখানে ঐতরা মহিদাসের অমৃতময়
জীবনের জন্ম দিয়েছিল কোন এক গোত্রহীন রুদ্রক্ষণে।
নাভি থেকে বহু শিকড় নিরীহ গোধূলি বেলার মালভূমি
ছুঁয়ে অজ্ঞাত রূপালী জোড়ের মাতৃত্বে অন্তর্গত হয়ে দেখে
মাতৃগর্ভে অদৃশ্য আলোর আকাঙ্ক্ষারা বসন্তের অরুণাভ
পলাশের বনের মতন; তারই টানে জন্মভ্রূণ ফিরে ফিরে
আসে স্বপ্নভূমে। সেই অন্তঃস্রোতে বেঁচে থাকে প্রাণ দুপুরের
বহুরূপী রৌদ্ররসের তরঙ্গে। পাবড়া পাহাড়ি পথে প্রত্ন
মন্দিরে অশ্বত্থ শাখা মেলে ঝুমুরের মধ্যযুগীয় প্রান্তরে।
পাতার আড়ালে ধূসর বিবর্ণ ইতিহাস উড়ে যায় ছেঁড়া
মেঘের মতন। এই ভূখণ্ডের খণ্ডহীন ঘন নীরবতা
পাথুরে পাঁজর ভেদ করে ওঠে। নামগোত্রহীন মানুষের
রিক্ত কালোছায়ার রক্তিল স্মৃতিক্ষত অতলে তলিয়ে গেছে।
সামনে অহল্যাবাঈ সড়ক, প্রাচীন বেদনার জনপদ,
হরিমন্দিরের পাতকুয়ো, পিতৃপুরুষের গন্ধ, ভিটেমাটি,
বনবুড়ি, ক্রমশ একাকী লুপ্ত হয় বহুমাত্রিক অস্তিত্বে।
সৃষ্টির সন্ধ্যার কৃষ্ণ স্রোতে তারা মৃত্যু ও ধ্বংসের মুখোমুখি।
প্রিয় রামনিধি, আমার বিগত বিশ্বাসের এই গ্রামে শান্ত
প্রত্নগর্ভ থেকে জন্মভূমির শিকড় ছিঁড়ে মৃত্যু মায়া চক্রে
আমি এক চিহ্নিত প্রস্তরখন্ড; বাঁশি জানে সেই অভিমান!
রাখালি দেহের বাকলে কালের কান্না, লুণ্ঠিত নক্ষত্র সুর
জন্মান্তরে জন্ম দিয়ে গেলো অঙ্কুরিত পরাস্ত রক্তের পলি।
পৃথিবীতে পরাজিত মৃত্যুর মতন বহুদূর অন্ধকার
কোথাও তো নেই। জীবনের প্রগাঢ় স্থানাঙ্ক সতত অস্পষ্ট
হলে শরীরের বায়ু অবিরল টের পায় নিঃসঙ্গতা আর
মৃত্যুশব্দ যা গোপনে প্রচ্ছন্ন ছায়ার মতো অনর্গল ফাঁপা
হাড়ের ভেতর আমাদের ডেকে নেয় চেতনার খররৌদ্রে।
ধমনীতে স্রোতশীল এই সেই গ্রামদেবতার দেহাতীত
দেহরূপ ও সুপরিচিত ফসলের ঝরে পড়া দীর্ঘক্ষেত—
নদী - খাল - বিল - ডোবা - মাঠ বিস্ময়ের পর বিস্ময় জাগায়।
P2
মনেপড়ে একদিন এখানের সাঁওতালি সন্ধ্যার জঠরে
অতীতের জনগোষ্ঠী দেখেছিল মাথার উপর ঋতুবতী
প্রেয়সীর ছায়াপথ, পাহাড়ি দুখের বৃহস্পতি, মৃগশিরা —
সূর্যাস্তের চিতার শরীরে মন্থর রোদনে জীবাশ্মের খেলা—
আর তারা দেখেছিল কালপুরুষের ভেতর রাষ্ট্রের নগ্ন
বড়শিতে বিঁধে থাকা বুনো বিষের অচেনা নখত্রমণ্ডল।
ডাহুকের গ্রামে মৃতবৎসা মায়ের সন্তান প্রীতির মতন
স্মৃতির আকাঙ্ক্ষা আজ ধূ - ধূ মৃত আত্মার কবিতা হয়ে ওঠে।
প্রাকৃত প্রবাহে আলুলায়িত আদিম অন্ধকারে জীবনের
ফাল্গুনে নারীর গর্ভে জন্মছন্দ গেঁথেছিলো মহুয়ার গন্ধে।
ঘর বেঁধেছিলো পাথরের খিলানে, রক্তের শাশ্বত স্বভাবে।
অজস্র তপস্যামন্ত্র পাহাড়ি জোড়ের সংকীর্ণ জলজ দেহে
বয়ে যায়। তিতিরের উদাসীন ডাক পড়ে থাকে মৃত মাঠে।
নিঃশব্দে শিকড় থেকে উঠে আসে অন্ধকারের অনন্ত জ্যোতি।
এই বাঁশঝাড়, কুলঝোপ, পলাশের আঁকাবাঁকা রুক্ষ বন
আদিবাসী বুকের ভেতর এক অজানা গভীর গোধূলিকে
জাগিয়ে জন্মের প্রখর নিস্তব্ধ ইথারের গূঢ় ইতিহাস
সময়কে ডুবিয়ে রেখেছে। তবু অবিরত সেই ঘুঘুবনে
আলোর কঙ্কাল আর পোড়া মাটির পাথুরে জননীর হাড়
রক্তরেনু অনস্তিত্বের সকল কাঠামোতে নিজস্ব বীজের
জন্মাধীন গন্ধে বেদনার অবশিষ্ট কিছু ছায়া রেখে গেছে।
প্রাচীন শিশিরে ভেজা সন্ধ্যার চড়ুই পাখিগুলি শূন্যতার
P3
ওইপার থেকে উড়ে আসে। এমনি সে অদৃশ্য আত্মীয়;
শরীরের জলরঙ পৃথিবীতে ডেকেছে যাদের বারবার।
তাদের ধূসর ডানার বিস্তারে দূরের টিলার রোদ্দুরের
ক্লান্তি গেঁথে আছে। রুগ্ন পোড়া কঙ্কালের অশ্রু নিরীহ রাত্রির
উপত্যকা দিয়ে নেমে আসে। বীজের ভেতর অঘ্রান গ্রন্থির
প্রাণের প্রণয়চিহ্ন দেহকোষে আঁকা বিষাদ পথের স্পষ্ট
ইতিবৃত্ত সীমানা ছাড়িয়ে স্থবির রঙের গোপন গহবর
দিয়ে মিশে যেতে চেয়েছিলো রাষ্ট্রের সমস্ত সম্ভবে, বিকল্প
জীবনের মূল মুহূর্তের শক্ত অন্তপুরের বধির গাত্রে।
তারপর কল্পনা উৎসের দিকে যেতে গিয়ে দেখেছে স্মৃতির
ভেতর নরক ও ঈশ্বর পাশাপাশি নিজস্ব কবরে শুয়ে
আছে নিরুত্তাপ। দু - পাশের দুই হলুদ পৃথিবী মুখোমুখি
তাদের সহস্র আঙ্গুলের খুলির জন্মের প্রত্ন ছাপ নিয়ে
হেঁটে যায় সূর্যাস্তে জন্মান্ধ বিধবা মা পাখির শবের দেশে।
নুড়ি পাথরের কাঁকুড়ে আহ্বান রাত্রির কঠিন সাদাহিম
বাতাসে সকল পথের বক্রতা ছুঁয়ে ভেসে ওঠে চিরচেনা
শ্মশানের এলোমেলো নদীর অন্তরে। চিতার যে ছাই নম্র
প্রত্যাশায় সৃষ্টির ব্যথার শব্দে বেঁচে আছে তাদের ধোঁয়াটে
যুদ্ধক্ষেত্র গোপন অসুখে দামোদর - কংসাবতীর অনার্য
বুড়ি জলচরে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে বিচ্ছিন্ন দৃশ্যের জন্ম দেয়।
মনভাঙ্গা নিশ্বাসের প্রতিধ্বনি স্বর্গ নরকের আদিগন্ত
অজ্ঞাত মৈথুনে নির্বংশের পশ্চিমে নিশ্চিহ্ন হয়ে উড়ে যায়
শুকনো খয়েরি শালপাতার মতন। সুবর্ণরেখার রুক্ষ
কিনারে আবার তারা সংসার পেতেছে গিরিবর্তের নিস্পৃহ
জটাজালে। বিস্তীর্ণ খরার অরণ্য অঞ্চলে করুন স্বপ্নের
P4
প্রান্তদেশে বারংবার নেমে আসে আদিম জাতির মারাংবুরু।
পরেশনাথের স্বান্তনার সুদীর্ঘ স্নেহের পৃথিবীর রসে
সিক্ত হয়ে অনন্ত আকাশে ঘুরে ঘুরে আভাস্বর শালিধান
দিয়েছিলো গোধূলি বেলার বৃষ্টিযুগে। মুছে গেছে সেই সত্য।
নেগ্রেটো - অষ্ট্রিকদের দীর্ঘশ্বাস আত্মকথা বিকিয়ে গিয়েছে।
বহুদূর অন্ধকারে কন্ঠস্বর মিলিয়ে যাবার আগে তারা
তাদের জন্মের যন্ত্রণার নিঃস্ব অনন্ত দু - হাতে সন্তানকে
ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছে। আরো ঘনীভূত হয় নিষাদের
আড়ষ্ঠ জন্মের মর্মমূলে বঞ্চনার বিপন্ন বিশ্বের কথা।
প্রতিরাতে বেদনার অন্ধকূপে সময়ের কোলে আত্মজের
জন্ম দিয়ে কার্তিকের হিম হাহাকারে উঠোনে ধানের স্বপ্নে
শতছিন্ন কাঁথার আড়ালে নিজেকে ঢেকেছে পাহাড়ের গায়ে।
শতাব্দীর প্রিয় রোদ অপচয় করে তাদের বাঁচিয়ে রাখে
রাষ্ট্রের সময়। প্রতিদিন আলোর দৃশ্যকে এভাবে নিহত
হতে হয় একটি সুদীর্ঘ সূর্যমুখী অট্টালিকার মিনারে।
কুয়াশার পারে দেখেছে তাদের পূর্বপুরুষের প্রতিবিম্বে
শূন্যতা তাড়িত জীবনের আত্মহত্যার পিচ্চল গঠনের
অন্তর্বর্তী মাটি জ্যোৎস্না রাতের সীমান্তে তরল মৃত্যুর বনে
কেঁদেছে একাকী। তমাল তলের বিস্তৃত বুকের উষ্ণ ছোঁয়া
নিয়ে শালবৃক্ষগুলি মহাকাশ থেকে গভীর রাতের স্তব্ধ
নরম পলাশ ফুলে গৃহস্থের শালিকের মুখে ভাষা দিয়ে
তাদেরকে নিজেদের অনিবার্য সামান্য অস্তিত্বে টেনে আনে।
পৌষের পুরোনো পাখিরা তাদের আকাল শোকের শৈশবের
ঘরে ফিরে ঘুমন্ত মায়ের কৃষ্ণস্তনবৃন্তের বিভঙ্গ দেহ
রেখায় তিষ্ণার্ত মুখ রেখে পৃথিবীর নোনো অশ্রু পান করে।
P5
সেইদিন আসন্ন গোধূলি সন্ধ্যার শিয়রে ফসলের শিস
খুদকুড়ো আর তর্পনের জল নিয়ে শুষ্ক ভূমির কাছেই
বেঁচে থাকা সমাধী গম্বুজ তাদের প্রাণের আত্মজের সাথে
মায়াময় বৃদ্ধ যোগরেখা রেখে যায় ঋজুপালিকার দেহে।
দূরের নক্ষত্র পর্ণকুটিরের কাছে এলে ধামসা মাদল
অটুট বাঁধনে জন্মান্তর বাঁশির করুন স্থবির বিশ্বাসে
কোনো এক ছিন্ন পথে একত্রিত সহবাসে শূন্যে মুক্ত হয়।
আদিম শিলার চোখের কোটরে এই শ্যাওলা গ্রহের বেলা
চলে যায় স্বেদঝরা শরীরের মর্মর ধ্বনির ভাঙ্গাগানে।
আমার মাটির গোপন ভূখণ্ডে প্রাক পূর্ণিমার আলপনা,
অতীত ঋতুর অন্তরঙ্গ ডাক— বহুদূর অরণ্য শিখরে
কাঁদে প্রিয়তর পর্ণশবরীর কাছে; একদিন রক্তসাঁঝে
যে কাঠকুড়ানি তাকে ভরেছিলো কাঁচা শালফুলের সুগন্ধে।
মৃদুভাষী তার আত্মার গোপন অবসাদে বিগত জন্মের
ছিন্নমূল রূঢ় হাহাকার, পাহাড়ি বাতাস প্রবীণ মধ্যাহ্নে
সমাধির ঘ্রাণ থেকে তুলে আনে সমিধের সেই আলোলিপি
যেখানে নির্ভুল দু - হাত মায়াবী যুবকের প্রত্ন গেরস্থালি
ভরেছিলো অন্তহীন মেঠোপথের প্রেমিক রোদ্দুরের শব্দে।
যৌবন হারানো প্রতিটি বিচ্ছিন্ন নদী রক্তের বন্ধনে ভেসে
পৃথিবীর সচ্ছলতা নিয়ে স্রোতে সংঘবদ্ধ হতে চেয়েছিলো।
আজ নাভিমূলে মন্থর আলোর মৃত মেঘ কাঁদে।অন্ধবীজ
কারা দিয়ে গেলো শূন্য করতলে! অনার্যের অশ্রু মুছে দিতে
প্রেরিত আকাশ নিয়ে গেলো কারা! অস্তিত্বের অভ্যন্তরে থেকে
সভ্যতার গর্ভানুর সুর চেয়েছিলো। বিষাদের আদি গ্রন্থি;
P6
নীরব জরায়ু গর্ভে, জন্মভোরের মেরুন আলোয় নিহিত
অমৃত গানের আত্মার অন্তরে; মুখোমুখি হতে চেয়েছিলো
রৌদ্রের ভেতর। প্রপিতামহের ঋজু সুঠাম শরীরে হিম
কুয়াশায় জড়ানো, আবছা সন্ধ্যাগন্ধে ছেঁড়া কাঁথা,
ভাঙ্গাচোরা
দূর তরঙ্গের প্রতিচ্ছবি, হৃদয়ের চেতনায় পণ্য হয় ।
মৃত্যুর রহস্যলতা মনসাকাঁটার বেড়া থেকে উঠে এসে
উঠোনে দাঁড়ায়। মহাকাল ছায়াজালে সময় ও দূরত্বের
বিস্ময় নির্মাণ করে প্রতিমুহূর্তে অতীত হয়। শিকড়ের
স্তব্ধভূমি গাঢ় স্বরে মহুয়ার পাখিদের ডেকে নিলে দেখি
শরীরে আবদ্ধ রক্তদ্বীপ শুকনো পাতার মতো নিঃস্ব হয়ে
খসে যায়। সৃষ্টির গভীরতর শিল্প নিঃশব্দে মাটিতে ঝরে
শতখাতে। লাভাস্রোতে পার্বত্য কঙ্কাল দুঃস্থ প্রেমিকার চূর্ণ
মুখশ্রীর দৃশ্য এঁকে চিরন্তনী আত্মীয়তা দিয়ে বারবার
শব্দহীন উৎসের জটিল অস্তিত্বে ডেকেছে তার হেমন্তের
মেধাবী রাতের ব্যাকুল নক্ষত্র আলোয় নিষিক্ত আত্মপথে।
সেইদিন শ্মশানের মৃতনদী ধরে রাখে অতীত মায়ের
মায়াবী দেহটি। আর পাথরের খিলানে জলের অশরীরী
চোখ চরাচর জুড়ে রুক্ষ তটে পৃথিবীর আদিম বুড়ির
সঙ্গে দুঃখ বিনিময় করে অর্থহীনতার পরপারে বেঁচে
থাকার সফল গল্প শোনে এই সমুজ্জ্বল তীর্থের ভূমিতে।
দহনের ভ্রূণপুঞ্জের বিপন্ন বিকাশ কাঁকুরে শূন্যতার
P7
স্থায়ী অন্ধকারে নিজেকেই নিজে দেখে। সীমা সময় ছড়িয়ে
কংসাবতী ভিটেমাটি পোড়া নির্বাসিত মানুষের শিলাবর্তে
বেঁচে থাকা হৃদয়ের কথা বলে। হারানো গ্রামের অন্ধকার
ধূসর বিষাদ, রূপাই নদীর জলে প্রেতের মতন ভাসে।
নিরুদ্দেশ শব্দের অতীত ছেঁড়াখোঁড়া প্রতিবিম্ব জেগে আছে।
অজস্র বিষন্ন জৈন মঠের মৌনতা পাথুরে মাটির দেশে
আজো ধ্যানমগ্ন ঋষির মতন এখানের জীবনের গূঢ়
মধ্যমণি ছুঁয়ে স্থিতপ্রজ্ঞ। শালের জঙ্গলে প্রপিতামহের
দুখের শিকড়ে কৈবল্যের প্রাগৈতিহাসিক চৈত্রের আকাশ
অতীত বৃষ্টির বিন্দু খোঁজে। এভাবে তাদের রাত্রি গাঢ় হয়।
নাম গোত্রহীন চেতনার এই দেশে বৈশালীনগর কাঁদে।
পাতাহীন অশ্বত্থের তলে শুকনো পাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্থির
দীক্ষিত স্বপ্নের অসমাপ্ত ইচ্ছাগুলির হলুদ আর্তশব্দ
মন্থর সন্ধ্যার বিশীর্ণ বন্দিসে বাজে। বহু স্বাক্ষর বিহীন
শেষরাতে কোনো এক মৃত প্রাক্তন স্রোতের জনপদ তার
জীবনের নোনা ঘাম চেয়ে কেঁদে ওঠে। স্তব্ধ করোটি কঙ্কাল
আকাশের নিচে অতি ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে অভাবী অস্তিত্ব
বাঁধনার অহিরা গানের সমবেত ঘুঙুরের বৃত্তে তারা
নিজেদের জাগিয়েছে পৃথিবীর স্বতঃস্ফূর্ত তরঙ্গের সুরে।
নদী ও নক্ষত্রে অন্তরীক্ষের নিশ্চল বিন্দুতে পল্লীর দেহে
অসংখ্য স্বাদের সূচনার ছবি যারা এঁকেছিল; সেইদিন
তারা শুষ্ক রাত্রির শরীরে ফিরে ফিরে আসে। সপ্তর্ষির হিম
দগ্ধছায়া জন্ম ও মৃত্যুর দু - পাশের শান্ত নিঃসঙ্গ উষ্ণতা
P8
অনুভব করে কার্তিকের কাঙ্গালী আঁধারে মহামৃত্তিকার
দেহে উড়ে গিয়ে এক মাতৃচিহ্নের যুবতী উজ্জ্বল ধ্বনির
সচ্ছল ভেতরে কল্পতরুর জরায়ু গর্ভে জন্ম কথা ভাবে।
প্রস্তরখন্ড 2
অনিবার্য জন্মদাগ ভেসে যায় মানভুমের ঘনিষ্ট দেহে
জৈবিক সন্ধ্যার কান্নামাখা জলে। প্রতিশ্রুতিময় বেঁচে থাকা
ক্রমাগত ভেঙে ভেঙে যায় বহুদূর আকাশের মেঘদেশে।
খেজুর গাছের বুকে জ্যোৎস্না আসে অন্তিম বিশ্বের শব্দছুঁয়ে।
ব্যর্থতার মধ্যরাতে কুয়াশার মৃত জলকণা অন্ধকার
অস্তিত্বে ভাসতে ভাসতে প্রাচীন অশ্রুর ভেতর হেমন্তের
গান গায়। ব্যক্তিগত রাত্রের শূন্যতা ভেঙে আদিম সৃষ্টিতে
নিজেকে জাগায়। উৎসের প্রান্তর ঝরে যায় আদিম গহ্বরে।
বৃত্তের ভেতরে ডাহুক- ঝিঁঝিঁর ক্ষয়- মৃত্যু- বিরোধিতা; চিল
শকুনের দৃষ্টিতে বিপন্ন হয়ে দেখেছে তাদের উপকূলে
প্রকৃতির সীমাহীন বিপরীতে শুয়ে আছে অপদেবতারা।
বসন্ত শেষের শুকনো পলাশ মরে যায় বহু স্বাদ রেখে।
প্রাকৃত বীজের ভেতর নিহিত সুর পাহাড়ের মনে ঘোরে।
নিজস্ব রাত্রির গভীর তরঙ্গে শরীরের পাথুরে প্রকৃতি
চৈত্রের আলোর উজ্জ্বল রোদ্দুরে যেতে চেয়েছিলো একদিন।
বিশ্বাসের স্থির ভূমিতে নির্জনে রাঙ্গা মাটি— মায়াধুলো
হাতে নিয়ে বলে আহা এ আমার জন্মভূমি —দেহগর্ভে বাজে।
ভালোবেসে অঘ্রানের অপরূপ রূপে দেখে শিকড়ের মাটি।
নিরন্ন শিশুর ডাকে বিচ্ছিন্নের সকল যন্ত্রণা নেমে আসে
P10
উদাসীন সন্ধ্যার আকাশে। সূর্যের ডুবন্ত রূপ পড়ে থাকে
প্রান্তরের দেহে। সেইখানে ছায়ার ভেতর তারা চেয়ে থাকে
একমুঠো উচ্ছিষ্টের দিকে। বৃদ্ধ পৃথিবীর বিষন্ন গোধূলি
বারবার দিগন্ত আড়াল করে। স্নেহের সীমান্তে কাঁটাতার;
কে ঘুচাবে এই অন্ধকার! যদিও দধিচি অসংখ্য প্রদীপ
জ্বেলেছিল অস্থি মাংসে এই রূঢ় রুক্ষ মহাশূন্যের অতলে।
বাবলা কাঁটার ফাঁকে সুর্য ডোবা আলো মাটির নুড়িতে মেশে।
গেঁয়ো শেয়ালের ডাকে শব্দের মন্থন বুড়ি পুকুরের জলে
ভেসে গিয়ে শ্মশানসন্ধ্যার ঝোপে নিজস্ব মুদ্রায় মিশে যায়।
মৃত্যুর কুয়াশা স্বাদ জেগে থাকে তারই স্তব্ধ পাতার আড়ালে।
ধূসর ছায়ার অর্ধনারীশ্বর চিরস্থির শূন্যে চিরকাল
স্বাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। বাউল সুরের বাতাসে জন্মের গূঢ়
অভিমান বৃহৎ ভূখণ্ডে প্রাচীন সত্তার আদিস্রোতে আজো
ফিরে যেতে চায়। একদিন সাঁঝপাখি যজ্ঞিডুমুর গাছের
থেকে উড়ে গিয়ে দেববাতাসের শরীরে স্বচ্ছন্দে মিশে যেতো।
নদীর কিনারে ভাঙ্গা রৌদ্ররেখা আকন্দফুলের শবদেহে
নিজেকে জড়ায়। গোধূলির দামোদর ডাকে তার ধ্বনিজালে।
শীর্ণ পাতাগুলি বিকেলের বিবর্ণ জলের সঙ্গে কথা বলে।
পাতাহীন গাছের কঙ্কাল মুমূর্ষু জোড়ের ধারে পিতৃত্বের
প্রতিশব্দে দাঁড়িয়ে থেকেছে সময়ের চেতনার পরিনত
ইতিহাসে যেখানে জন্মের নাভি জন্মকে মঞ্জুর করেছিলো
একদিন। ফাল্গুনের আত্মা গণতান্ত্রিক রাতের অন্ধকারে
নীরবে বিকিয়ে গেছে পৃথিবীর গলিত শবের শেষদেশে।
ঘ্রাণহীন শীতল জীবন তবু পৃথিবীতে বয়ে আনে প্রেম।
দলমার ভূমিতলে সুবর্ণরেখার প্রতিধ্বনি খেলে যায়
P11
করোটি কঙ্কালে। বিগত হলুদ কোনো শতাব্দীর জন্মভ্রূণে
আদিম বিকার ছিলনা কোথাও। হাজারীবাগের একরোখা
বিমূর্ত সন্ধ্যার ছায়ায় পাখির সঙ্গীতে বিস্তীর্ণ মালভূমি
গভীর ঘুমের ভেতর স্মৃতি ও বিস্মৃতির স্বপ্নে জালাভর্তি
মহুয়ার গন্ধে নিজস্ব দ্বীপের সরল সভ্যতা গেঁথেছিলো
প্রজন্মের গায়ে। অন্ধকার জরায়ুর বলিরেখা ভেদ করে
আদি নাভিমূল থেকে উঠে আসে চায়বাসা -জীবন্ত স্তব্ধতা।
ক্ষয়িষ্ণু পাথর পরিচিত শিলাখন্ডে অসমাপ্ত পর্বসন্ধি
আজ দীর্ঘতম হাড় - ক্রমাগত তার দৃশ্যপট বদলায়।
শালবনে নদীর শরীরী শব্দ জৈন মন্দির চত্বরে ভাসে।
জলের অতলে স্থির তৃতীয় চোখের তীক্ষ্ণ পথে নদীতটে
শ্মশান সংলগ্ন গ্রামদেশ দেখেছিলো বিষন্ন চৈতন্যে ভরা
দেহ ও আত্মার দ্বন্দ্ব। মাঠের ফসলে তখনো মাতৃত্ব খেলে।
ঝর্নার ব্যথিত জল ঘিরে পাথুরে পাতার শালের জঙ্গলে
মুন্ডাদের অশ্রুত শব্দের দুঃখস্রোতে দামোদর বয়ে যায়।
সমূহ নদীতে সময়ের স্বরে পিতৃপুরুষের প্রেত কাঁদে।
রক্তের ভেতর ধুমল পাহাড় তারই তলে পলাশের মৃত
অরুণাভ প্রজাপতিফুল শুয়ে থাকে স্তব্ধ মাটির উপর ।
করতলে কার্তিকের হাহাকার কান্নার অদৃশ্য রক্তপাত
মৃত্যু আর অপমৃত্যুর নির্জন বেদনা ব্যাকুল করে যায়।
বাস্তুভূমি- ঘরবাড়ি, ফসলের মৃত মাঠ ক্ষুধিত নাভির
অনন্ত প্রান্তরে কাঙালী মায়ের অবিরত পরাভব দেখে।
আকাঙ্ক্ষার শাখা প্রশাখা স্রোতের বিপক্ষে নিশ্চল হয়ে যায়।
ধূসর যুগের অস্পষ্ট রহস্যময় স্পষ্ট ক্ষয় কুয়াশার
আদিম ভিতরে ক্রমাগত নিচু হয়ে ভেঙে পরে ভূখণ্ডের
P12
সত্তার শেকড়ে হিম অন্ধকারের বিবর্ণ শব্দের মতন।
ক্লেদাক্ত রক্তের উৎসমুখে চেতনার মধ্যরাতে সন্তানের
স্বাভাবিক জন্মে দেখেছিলো সচ্ছজলে আলোর কণিকা ভাসে।
শাদা জ্যোৎস্না ঘিরে তামাকের পোড়া গন্ধ ক্ষীণ অক্ষম নদীর
কুয়াশার ঝোপে জমে থাকে। গোপন অশ্রুর অতীত রাতের
জলে আজো শালগ্রামশিলা ভিজে আছে মাদল মেঘের কোলে।
পৃথিবীর প্রথম রাত্রির বুকে সৃষ্টির মরমী সুরে দীর্ঘ
স্নেহের আশ্রয়ে এই সাঁওতালি মাঠে বহু ফসল ফলেছে।
যন্ত্রণার নিঃস্ব রাতে দহনবেলার পশ্চিমের শান্তকথা
ছায়ামাখা প্রান্তরের প্রাচীন গল্পের ভাঙ্গা দেহে সেইলিপি
লেখা আছে। পাহাড়ের কোলে গোধূলি জননী বেদনার রাতে
জন্মবীজ ছড়িয়ে আদিম হেমন্ত রাত্রির পাতার মতন
সমগ্র সত্তায় নিজেকে ছড়ায় গেঁয়ো পৃথিবীর প্রত্নদেহে
যেখানে নক্ষত্র আলোর নিঃসঙ্গ কঙ্কাল গভীর রোদ্দুরের
সহজ দর্শনে বেঁচে থেকে জন্মের ঘনিষ্ট মুহূর্তকে ডাকে।
সময়ের জীবিত নিশ্বাস আত্মকথা পাখির পালকে উড়ে
গিয়ে অবেলার অবসাদ মুছে দেয় আলোজন্মের বিবরে।
বনচাঁড়ালের বনে বুড়ো শিমুলের ডালে মিহি সন্ধ্যা বসে;
তারই তলে জীবনের মরুভূমি নির্জন শ্মশানকলসির
জলে কাঁপে। শূন্যতার সকল মুহূর্ত অশ্বত্থের ডালে বসে
চিরন্তন অস্তিত্বের ব্রহ্মান্ডের রক্তজলে তার চিহ্ন খোঁজে।
হৃদয়ের অসংখ্য শুকনো শিরা উপশিরা বিমূর্ত মৃত্যুর
ছায়াময় সবুজ পাতার বীজরসে তার রূপ রেখে যায়।
মলিন আলোর বিবর্ণ জ্যোৎস্নায় রাখালের প্রাচীন ধুলোর
শব নিরুদ্দেশ হয়। কুয়াশার বিষন্ন মন্দিরে ফাল্গুনের
P13
নিবিড় শরীরে পূর্বপুরুষের নীল অন্ধকার বাঁশবন
থেকে উঠে এসে শ্মশান জোড়ের জল ছুঁয়ে আজো কথা বলে।
বিরহ ভূমির বেদনার নশ্বর সন্তান ফিরে ফিরে আসে
পাহাড়ি রোদ্দুরে তাদের আকাঙ্ক্ষা চৈত্রের চৈতন্য চেয়েছিলো।
ভাঙ্গা চন্ডিমণ্ডপের নিঝুম ধ্বংসের দৃশ্য ক্ষয়ে ক্ষয়ে কাঁদে।
ব্যক্তিগত দুঃখ গুলি ফেলে এসে তারা ঘর বাঁধে শরীরের
ঘ্রাণে। আত্মার সবুজ দ্বীপে পোয়াতি ধানের গর্ভে জেগে থেকে
পশ্চিম আকাশে সুদূরের কণ্ঠস্বরে শতাব্দীর আত্মীয়তা
খুঁজে এই ভূখণ্ডটুকুর শেষ টানে। অনেক ধ্বংসের পর
তারা জেগে আছে। অবসরের একান্ত দিনে ক্লান্তির চূড়ান্ত
ছায়া জীবনের যন্ত্রণা ছুঁয়েছে এই শুষ্ক শূন্য চরাচরে ।
বুড়ি কংসাবতীর ঘুমন্ত দেহে বজ্রভূমির নিঃসঙ্গ জলে
নিষাদের কান্নামাখা মুখ ভাসে। জন্মান্ধ পাখির অশ্রুস্মৃতি
একান্ত নিজস্ব পথে ঝরে; আজন্ম ঘুমিয়ে থাকা এই গ্রামে।
নৈঃশব্দ্য শব্দকে অতিক্রম করে আকাশের দিকে ছুটে যায়।
গভীর গহ্বরে অনন্ত রাত্রির দহন বিস্মিত স্নায়ুগ্রন্থি
জাগিয়ে প্রাকৃত ধুলোর প্রবাহে বহু জন্মের নিবিড় দাগ
রেখে উড়ে যেতে চেয়েছিলো। আত্মজের বুকে চিরকাল তারা
অঘ্রাণের ফসলের প্রতিশ্রুতি রেখে গেছে। আদি আষাঢ়ের
নীল কুয়াশার অন্ধকারে; বিপরীত স্রোতের অন্তরে শেষ
আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে অবিরল দিয়ে গেছে মাটিতে জন্মের স্বাদ।
নীহারিকাছিন্ন ভূখণ্ডের মায়াবী উষ্ণতা সময় সীমানা
পার হয়ে রক্তের অতল গহ্বরের ভিতরে স্থিরতা চেয়ে
পৃথিবীতে কোনো এক বিকল্প বোধের জন্ম দিতে গিয়ে আজো
দিনান্তে পায়ের ছাপ রেখে যায় মাটির মনের চেতনায়।
P14
মহাশূন্যে পৃথিবীর ঋণ রেখে ব্যথিত বিশ্বের জন্মজলে
তারা ফিরে আসে পাহাড়ি পথের বাঁকে হেমন্তের মাতৃত্বের
স্বাদ নিতে। অন্তহীন আত্মনিবেদনে মহাকালের অনন্ত
সত্তা ছুঁয়ে মরুগানে জন্মভূমির আদিম উৎসে ঘুমিয়েছে
প্রান্তিক পল্লীর বহু ঋতুর আঁধারে। হাহাকার বাতাসের
শোক মেখে পাষাণের দেশে নরকের শরীরের অপচ্ছায়া
তাদের জীবনে জীবনের অন্তিম অজ্ঞতা দিয়ে পৃথিবীতে
পীড়নের অভিজ্ঞতা গেঁথেছিলো বেদনার পার্থিব প্রদেশে।
তবু মরণের পরে স্বজনের শান্ত সংসারে ফিরতে চেয়ে
করোটির দগ্ধ কঙ্কাল বিশ্বাসে ভাসিয়েছে আদি দামোদরে।
স্বপ্নের ভিতরে শুয়ে থাকা শৈশব পাতায় পাতায় নির্জনে
নূপুরের শব্দ শোনে। মুরিনদীর শীতের স্রোত প্রতিরাতে
ইথারের মতো ভাসে। বিপুল শূন্যের উপর নক্ষত্র আলো
সহস্র সন্ধ্যার কথা বলে যায়। জ্যোৎস্না রাতে প্রাচীন পাথরে
মন্দিরের শিলালিপি সময়ের শেষচিহ্নে স্থির হতে চায়।
বিমূর্ত অস্তিত্বে মৃত্যুর দুঃসহ ধ্বনি সৃষ্টির সকল শর্তে
দুর্লভ আলোর দিকে নিজেকে নিক্ষিপ্ত করে পৃথিবীর ধুলো -
মাটি-স্রোতে -বেঁচে থেকে পুনরায় জীবনের অভিজ্ঞতা চায়।
দীর্ঘ অক্ষমতা রেখে তবু তারা ভেসে গেছে নিবিড় অন্তিমে।
চেতনার গূঢ় গ্রন্থি দেহাতীত প্রাণস্রোতে ব্যাকুলতা রেখে
নিঃশব্দে রাত্রির বিবর্তনে দামোদরের একান্ত অন্তরঙ্গ
অন্ধকার নদীজলে আকাঙ্ক্ষার আর্দ্র প্রতিবিম্ব রেখে যায়।
পৃথিবীর প্রাচীন হরফে, ধূ ধূ মাঠের মায়াবী বৃত্তে তারা
দেখেছিলো গৃহস্থের শালিক চড়ুই বহু ব্যর্থতার পর
আজো ব্রহ্মান্ডের স্বাদে বেঁচে আছে। পানকৌড়ি জলহাঁস খেলে
P15
পাকা ফসলের গন্ধে। পূষ্যানক্ষত্রের আলো কাঁসাই কুমারী
নদীজলে এলে টুসুগানে পৌষলক্ষী জাগে। কুমারী মনের
আকাঙ্ক্ষা অজলা মাটি থেকে দূর দিগন্তের ভোরে মিশে যায়।
লালমাটি মেঠোপথে পলাশের রাঙ্গাডাঙ্গা আজন্মের স্তব্ধ
অন্ধকারে একাকী বিচ্ছিন্ন হয়ে শেকড়ের শেষ আলোটুকু
ভিক্ষে করে নির্জন অস্পষ্টতার দিকে চলে যায় বহু দগ্ধ
ক্ষতের শূন্যতা নিয়ে।কালের বিষাদী ধ্বনি নিষাদের দেহে
অশ্রু পতনের ছবি আঁকে। তবু অশ্বনদী থেকে উঠে আসে
সূর্যপুত্র কর্ণ। জননীর বুকে এই দৃশ্য বহু রোদ্দুরের
পর আজো গাঢ় হয়ে আছে। সূর্যাস্তে পাখির কঙ্কাল অনার্য
পুকুরের জলে নিজের শাশ্বত মাটিগন্ধে এই ধূ ধূ হৃদয়ের
শিখরভূমিতে সন্তানের জন্ম দিয়েছে সৃষ্টির অফুরন্ত
জ্ঞানের বাতাসে। পাহাড়ি পাখির কোলাহলে নিজেকে নিজেই
স্পর্শ করে বারবার শূন্যতা ভেঙেছে আদিস্বরে বেঁচে থেকে।
তারপর প্রাচীন ছবির মতো নিজেকেই নিজে জাগিয়েছে।
অথৈ শূন্যতার সকল বাসনা মানুষের ঘ্রাণে চিরকাল
জেগে থাকে ক্ষয়ের ভেতর। যদিও দিনান্তে মাদলের শব্দে
একফালি রোদ বিষাদের মুখোমুখি শুয়ে থাকা সময়কে
জাগিয়েছে। অবিশ্রান্ত রক্তের আঘাতে শূন্য মালভূমি জুড়ে
তৃতীয় বিশ্বের নিঃস্ব জঠরে তিতির ডেকে যায়। শ্মশানের
অন্ধকারে পড়ে থাকে লক্ষীর উঠোন-পিপাসিত সন্ধ্যাদ্বীপ।
সমূহ স্মৃতির আলো জীবনের এমন নির্জন পরাভবে
আরো ক্ষয়ে যায় ক্ষয়ের গভীরে। শিলাখণ্ডে মানুষের সত্তা
সময়ের শিকড়ে শিরায় জন্মের নির্ভুল দিগন্তকে ছুঁয়ে
মাটির মেধাকে উর্বর করতে চেয়েছিলো। তাদের স্বপ্নের
P16
ভেতর কাঙ্ক্ষিত শীতার্ত নদীটি বয়ে যায়। মেঘমাখা মাঠ
ভরা ফসলের ক্ষেত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে বুকের গহ্বরে।
তবু মাঝরাতে কোনো এক দেবগন্ধ বাতাসকে ঘিরে রাখে।
হেমন্ত রাত্রির প্রাকৃত কল্লোল মাতৃমুখ অধিকার করে
আদি শূন্যতার কণ্ঠস্বরে ডেকে নেয় নিজের শিশুকে তার
মায়াবী আঁচলে। আধো অন্ধকারে ভাসমান অন্তিম শরীর
তারই অন্তরঙ্গ মায়াজালে আবার মেঘেরপাড়ে জেগে ওঠে।
বেদনার শুষ্কদেহে নাভিমূলের মরমী অধিকারে নদী
বৃক্ষলতা- ধানদূর্বা চেয়েছিলো তারা ম্লান দুঃখের রাত্রিতে।
সূর্যাস্তের গৈরিক সন্ধ্যায় দেশের নিহিত আদি সভ্যতার
ঘনিষ্ট সকালে ভাতের প্রাচীন প্রতিবিম্বটুকু বেঁচে থাকে।
ফুটিফাটা মাঠ-পোড়ো ঘর-বাঁশের ছাউনি- মহুয়ার বন
ছুঁয়ে হেঁটে যায় জলশূন্য নদীপথ। নীরবে একাকী তীব্র
শোকঅশ্রু এমন প্রান্তরে জন্মের সকল দৃশ্য দিনশেষে
গোধূলির দেশে ফসলের ছবি আঁকে। নৈঃশব্দ্যের বেদনায়
তবু পৃথিবীতে প্রাণ আসে আলোকিত প্রদেশের অপেক্ষায়।
পোয়াতি পদ্মের গন্ধে টের পায় হাড়ের ভেতর রাজপথে
অরণ্য ছড়িয়ে আছে। তারপর জেগে ওঠে নিজের শরীরী
তাপের বিশ্বাসে। রুক্ষ শুষ্ক পাথরের ভূমিকে অমর করে
জ্যোৎস্না রাতে। দূর দিগন্তের হাহাকার আশাহত চেতনার
মাটিকে উর্বর করে উদ্ভিদের ঘ্রাণে। ছায়াঘন রোদ্দুরের
করুন হৃদয়ে। দিকচিহ্নহীন শব্দময় ধুলোর আড়ালে
জৈন মন্দিরের নিথর ভাস্কর্য গুলি অবেলার রক্তস্রোতে
দেখেছে অজস্র অভিমান। বিবর্ণ অভ্যাসে স্মৃতি উড়ে যায়
তবু কোনো এক পরাস্ত সন্ধ্যার চেতনায় স্থবিরতা থেকে
P17
মানুষের মন চলে যায় অন্ধকারের অতীত ধারাভাষ্যে।
সেইখানে দিনলিপি সূর্যের পশ্চাৎপটে অজ্ঞাত তরঙ্গে
নিজেকে নিজেই অনুভব করে পৌঢ় হয়। মৃতের ফলকে
শান্ত হাত পাথরের সঙ্গে কথা বলে। জীবনের তীব্রতম
শোকে কুলহারা এই জনপদ জীবনকে নিলামে উঠিয়ে
অনর্গল ভেসে যায় চিতার ধোঁয়ায়। কৃষ্ণতম মৃত্যু পথে
তবুও আগুন রেখে যায় অসম্ভব অন্ধকারের শরীরে।
বিবর্তনে হিম ও রোদ্দুর শুধু অবসাদ এনেছিল ঘরে।
পৃথিবীর প্রত্নঘুম আজো মৃত পাখিদের শব ছুঁয়ে আছে।
নশ্বর শরীর সৃষ্টির উৎসাহে জেগে থেকে দেখেছিলো তার
বিচ্ছিন্ন জীবন শকুনের করতলে গাঢ় হয়ে বসে আছে।
চন্দ্রদগ্ধ চান্ডিলের পশ্চিম আকাশ সুবর্ণরেখার নগ্ন
নদীতটে নেমে এসে ফিরে ফিরে তার বেদনার হাতে তারই
নাভি উপত্যকা থেকে উঠে আসা ডানাভাঙ্গা অন্ধ প্রান্তরের
প্রান্তিক মানুষদের ডাকে। সেদিন নির্জন রাত্রির জননী
কাঁদে একাকিনী। অন্ধ মেঘস্মৃতি থেকে নেমে আসে যন্ত্রণার
কন্নামাখা বহু মুখ। আমাদের ভাঙ্গা গ্রাম যাবতীয় দুঃখে
বেঁচে থেকে তার অক্ষম নদীর জলের ধূসর বাতাসের
শব্দে কবন্ধ আঁধারে আমাকে একাকী অনর্গল বিদ্ধ করে।
পাহাড়ের অন্ধকোলে ছন্নছাড়া রাখাল আমার নিরুদ্দেশ
অন্তিম প্রাণের কাছে ছুটে যেতে চায় আর প্রতিটি জন্মের
জন্মকথা দিগন্তে নির্মাণ করে এক নির্ভুল সত্যের উষ্ণ
P18
ছায়াপথে নিয়ে যায়। ক্রৌঞ্চ পুষ্কর শাল্মলী সপ্তদ্বীপ ঘুরে
সবশেষে দামোদরে আমার শীতার্ত অস্থি মাংসের বৈরাগ্য
আসে। গোধূলি ধুলোটে সেইদিন এই মাধুকরী জীবনের
স্মৃতিকথা প্রশ্নচিহ্ন শরীরী বৃক্ষের থেকে আদিম রাত্রির
পাতার মতন ঝরেছিলো। নিষাদের খামার গোয়ালঘর
বুকে বাজে। মানভুমের অতীত জলের ছড়ানো বৃষ্টিদেশে
আমি ভেসে আছি, বাপ ঠাকুরদাদার রুক্ষ মাটি ভালোবেসে।
সভ্যতার গভীর শিকড়ে দেখেছি রাত্রির ক্লান্ত জলবিন্দু
দু-চোখ ঢেকেছে। দুঃখিত পাহাড়তলে কাদামেখে বীজধান
যারা পুঁতেছিলো রুক্ষ মাটিতে অনেক আষাঢ়ের শেষে তারা
ঘরে ফিরে দেখে অঘ্রানে ধানের গোলা গোধূলির সুপ্রাচীন
অশ্রু ছুঁয়ে আছে। সেদিনের কষ্টকথা রক্তে নূপুরের মতো
বেজেছে- মায়ের হৃদয়ের নিটোল কঙ্কালে। পায়রার দল
উঠোনের সিথানে কেঁদেছে। বিগত শৈশব নির্জন খামারে
চেয়ে থাকে দেহাতীত স্বপ্নে। কুর্মী শবরীর দেশে জাতিস্মর
বেঁচে আছে নিজস্ব ছৌ-শিল্পে আঁকড় বৈচির দেশে। ধানরুয়া
শেষ হলে বর্গা চাষী গান গেয়ে বিড়ি বাঁধে। সদরে অন্দরে
গাঢ় বিশৃঙ্খলা ভুল পথে ভাসিয়েছে শুকনো খরের চালা;
তবু ঋতু বদলের দিনে পুড়ো ভিটেজমি বহু ভালোবেসে
আঁকড়ে ধরেছে শিকড়ের মাটি। পাথর পড়ানো রোদ্দুরের
গ্রামে বীজ বুনে অনার্য রমণী। জনশূন্য টিলার জঙ্গলে
আদিম বসুধা ভাদ্রের ভিতর কৃষ্ণাষ্টমী রাতে পৌরাণিক
পৃথিবীর ভগ্নস্তূপ থেকে গগনচারীর সঙ্গে কথা বলে।
শোকের দুচোখে দেখেছি অনেক ক্ষত জমে আছে আর্কিয়ান
শিলাস্তরে— ঘুমভাঙ্গা নদীর দু-কুলে শ্মশানের অবিরল
P19
কান্না- শান্ত কলরোলে লাচনীর জীবনের ঝুমুর বেজেছে।
ইতিহাস জাগিয়ে সেখানে প্রাকৃত রাত্রির সময় কেঁদেছে।
মেঘভাঙ্গা দুঃখে ভেসে গেছে তার মহুয়ার অনন্ত রোদ্দুর।
দিকচিহ্নহীনপুরে আজো রুক্ষভূমে তার রক্তচিতা জ্বলে।
চিরন্তন শালের জঙ্গলে— যতদূর চোখ যায়- মহাবনে
দেখেছি অনেক পরাজিত মানুষের মুখ পৃথিবীতে ভিড়
করে আছে। নিবিষ্ট শিকড়ে বিষন্ন হাড়ের ব্যথা অবিরত
দুঃস্বপ্নের অন্তর্গত অন্ধকারে শব্দহীন স্থির জেগে আছে।
পাহাড়ের জনপদে বুদ্ধপূর্ণিমার দীর্ঘ রাতে অস্তিত্বের
অভিজ্ঞতা - রূপকথাকাহিনীতে শিকারির বুকে বেঁচে আছে।
বজ্রভূমে আমার অনার্য করতলে আদিম ঈশ্বর কাঁদে।
P -1
প্রস্তরখন্ড ৩
টিলার কাঁকালে জ্যোৎস্না কাঁপে; প্রাচীন আত্মার বিমূর্ত বিষাদ
প্রেতের মতন হাসে- তবু সেই বিস্মৃত আলোতে তিলাবনী
দ্বারিকা ধারার জন্ম দিয়েছিলো চিত্রিত প্রদেশে জীবনের
স্বতস্ফূর্ত ইসারার জন্মাবেগে। প্রান্তরের ভেতরে এখনো
কাদের ছায়ারা কাঁদে! জানিনা কাদের জন্ম অভিমান মাটি
ফুঁড়ে মেশে আমার সৃষ্টির বিস্তৃত রক্তের তরঙ্গের দেহে।
তাদের মিলিত সমবেত গানের বাতাসে আকালের দগ্ধ
ক্ষুধিত খুলির কালের কান্নার দীর্ণ ধ্বনি নিঃশব্দে শুনেছি।
পৃথিবীতে এইভাবে নিরাশার শবদেহে মৃত্যুফুল ফুটে
আছে, সভ্যতার সুগভীর আবরণে ঘুমের চন্দন বনে।
স্তম্ভিত ব্যাকুল জীবনের আবেদন চিরকাল ভেসে গেছে
নিথর নদীর অন্ধকার জলে। তারই রক্তের নিষ্ঠুর দাগ
হেমন্তের দেহে শস্যের প্রার্থনা জানিয়ে অতীত শ্মশানের
দেহে পুড়ে গেছে আমাদেরই কোনো এক নক্ষত্রকে স্বাক্ষী রেখে।
উজ্জ্বল আলোয় জলের সন্তান আসে নিরপেক্ষ পিতৃধামে।
যুবকেরা যুবতীর হাত ধরে পৃথিবীর গন্ধে ভ্রূণ আনে।
সন্তানের পিতা বারবার ভূখণ্ডের অধিকার দিয়ে গেছে
তার আত্মজকে। তবু খড়ের চালের নিচে সরীসৃপ জেগে
থেকে জন্মভূমির মাটির আঙিনাকে সুর্যাস্তে নিশ্চিহ্ন করে।
অবিচল অশ্বত্থের শাখা প্রশাখা পাখির ডাকে নিরন্তর
উদ্বেল হয়েছে শান্ত অঘ্রান রাত্রির হৃদয়ের খুব কাছে ।
স্মরণীয় সমস্ত বিশ্বাস অনাথ শস্যের মাঠ থেকে ডেকে
P -2
বলে গেছে দুঃখের দুয়ার থেকে তুমি কতদূর যেতে চাও!
আমরা তো তারই সহোদর। সাঁওতালি মেয়েটির সন্ধ্যারাত
দেখেছো কি তুমি! তবে কেন যাও আত্মহননের অন্ধকার
প্রান্তরের অন্তহীন পথে! শোকের শব্দেরা মৃত্যুকে ডিঙিয়ে
একদিন ফলবতী হবে তোমারই জ্যোৎস্নার ভাঙ্গা চাষমাঠে।
সময়ের অবিকল দৃশ্য পৃথিবীতে কবে আর বারবার
থমকে থেকেছে! শকুনের পাখসাট মানুষের ধমনীতে
হাড়ে হাড়ে অভ্যন্তরে লীন হয়ে ডেকে গেছে তবু পলাশের
অরুণাভ ফুল বসন্তের মাটিতে মুখের সুন্দর আদল
এঁকে দিয়ে যায়— জ্যোৎস্নার বিশীর্ণ নদী জোড় আমাদের ঘিরে
রাখে তার সংসারের গভীর প্রবাহে যেখানে স্রোতের গায়ে
অন্তরীক্ষ হতে নক্ষত্র নদীর ডাকে পৌঁছে যায় ক্লান্তিহর
চিরস্থীর শূন্যের মরমী মাতৃকুলের উৎসের প্রিয়গর্ভে।
বাস্তুহারা কৃষি জাতকের রক্তরেখা বটপাকুড়ের মাঠে
রমনের নির্জন ছাউনিটুকু চেয়ে ফিরে গেছে স্বরচিত
সমাজের পোড়া মাটি দেহের শ্মশানে— সেই হাড়হাভাতের
গোলপাতা, খড়ের ছাউনি সেসব মনে কি পড়েনা তোমার!
আমরা ক্রমশ সময়ের শান্তির ব্যাপ্তির দিকে হেঁটে যায়।
মহাকালে রৌদ্রলোক একাকী দাঁড়িয়ে আছে, নদীর বিনম্র
পলি, ফসলের সহজ পল্লীতে সুস্থির জ্যোৎস্নায় আমাদের
হাতে পৃথিবীর পরমান্ন তুলে দিতে তার অন্তিম সৌন্দর্যে।
আহা দেখো ওই বৃক্ষে মায়াবী পাখির কলতান শব্দহীন
পাথরের গায়ে লেগে ধ্বনিত হয়েছে বিশ্ব সৃষ্টির স্বভাবে—
মনেপড়ে এখানে অরণ্য বীজ পড়েছিলো এক দুপুরের
P 3
পুরানো মাটির ছায়ার হৃদয়ে? আরোগ্যের অদৃশ্য সান্ত্বনা
পেয়েছি আমরা বহু গাঢ় রাত্রির নিপুণ সুরের রহস্যে।
বেদনার মহৎ চিন্তারা বোধের ভেতর কালের চেতনা
দিয়ে গেছে আমাদের মনে পৃথিবীর নগ্ন দুঃখের বিস্ময়ে।
সূর্যাস্তে নিজের মৃত মুখ দেখে ভেবেছি শ্মশানবুড়ি তার
নদীচরে শীতল সত্যের কাছে বসে আছে আসশ্যাওড়ার
গভীর শরীরে যেখানে রহস্য বহু শতাব্দীর অন্ধকার
ভেঙ্গে শুনিয়েছে প্রাকৃত প্রবাহে স্থায়ী আশ্রয়ের কোনো চিহ্ন
নেই তবু মানুষের মনে সংঘের সংশয় জেগে থাকে স্রোতে।
রূপাই নদীর বুকে চাঁদ ভাসে, তীরের অদূরে বাঁশবন
নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে- তার ছায়া জলে পড়ে- বুঝেছি পৃথিবী
প্রতিক্ষণে অন্তঃসত্বা হয়। এই বয়ে যাওয়ার ভেতর রয়ে
গেছে আমাদেরই কঙ্কালের ইতিহাস— বলে যায় পৃথিবীর
মরমী জলকে নিজের মতন করে ভালোবেসে চলে যেতে।
গোধূলি কল্লোলে জলরেখাগুলি ফসলের মাঠে জেগে থেকে
জেনেছে চিহ্নিত হতাশার প্রতিচ্ছবি তার প্রত্ন পদচ্ছাপ
কিছুকাল মানুষের দেহে রেখে যায় জীবনের বিপরীতে
নির্জন দহনে মানুষের হৃদয়ের মাটিকে জাগাবে বলে।
জীবন বোধের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থেকেছে বহুমুখী রূঢ়
আকাঙ্ক্ষার জলছবি। চেতনার অন্তঃস্থলে অনুভবে দগ্ধ
আত্মক্ষয় থেকে গেলে আমরা বুঝেছি জগতের দেহজলে
পড়ে থাকে আমাদের জীবনের ঋণ। গৈরিক গোধূলি তার
শান্ত স্বরে জ্যোৎস্নাগানে বলে যায় বিমূর্তের অন্ধকারে আরো
P 4
এক জ্ঞান স্থানের সময়ে অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা হয়ে আছে
যেখানে তরঙ্গদেহ মাতৃগর্ভের সকল নির্মানের মূল
নির্দিষ্ট সত্যকে জানে, যা অস্থিরতার বীজে স্থিরতা এনেছে।
মন্দিরের ছায়াচ্ছন্ন মুখশ্রী স্মরণে আসে; পাথরের দেশে
পিতার স্নেহের মতো বটের করুণ ঝুরি মাথার উপর
নেমে আসে তার অক্ষমতা নিয়ে; তবু ঢেকে রাখে বৈশাখের
রোদ্দুরের দুঃসাহস পাতা বীজের আঁধারে। পার্বত্য প্রহরে
বেঁচে থাকে আমাদের অবশিষ্ট বেঁচে থাকা শুষ্ক আঁকাবাঁকা
আলপথে। অন্ধকার থেকে গন্তব্যের দিকে হেঁটে যেতে চায়
পাথুরে খিলানগুলি; আমাদের হারিয়ে যাওয়ার ব্যবধান
ক্রমাগত বেড়ে যায় সময়ের মহাবনে। স্তব্ধ মরুরাত
শতাব্দীর অনেক মুহূর্ত পেরিয়ে আবার গন্ডোয়ানা যুগে
ফিরে এসে সমযাত্রীদের রাজপথে নিজেকে দেখেছে, শান্ত
অনন্তের মহাকাল আজন্ম সন্ধির স্বাক্ষরে খাদ্যের কথা
লিখে গেছে। তবুও এখন ফসলের মাঠে রক্তাক্ত শরীর
পড়ে থাকে আরো কোনো এক চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে গেঁথে দিতে।
কল্লোলিত শিশিরের গান নির্জন পাহাড়ে একাকী মরেছে
ঘুরে অন্ধকার চতুর্দশী টেনে এনে। অনর্গল নৈঃশব্দ্যের
মধ্যে আত্মাস্থিত বেদনায় ছৌ এর মুখোশে শিল্পকে বেঁধেছে।
সেদিন সন্ধ্যার মোহময় মেঘ পাহাড়চূড়ার মরুদেশ
থেকে নেমে এসে তার প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর পথে চলে
যেতে চেয়েছিলো অতলের তলে যেখানে বোধের বিন্দু চেয়ে
থাকে উৎসে—জন্মের নিবিড় দাগে ঘুমন্ত মায়ের মুখ ভাসে
নিরন্তর। মৃত্যুমুখী সকল ক্ষতের ভেতর ছড়িয়ে থাকে
অভিসারী মন। মৃত আঁধারে আত্মীয়দের মৃদু হাত ডাকে;
P 5
পরিস্রুত বেদনায় উদাসীন হয়ে অনুভব করে তীব্র
সময় প্রবাহ জীবনে যে বিবর্তন দিতে চেয়েছিলো -তার
সেই সব অরণ্য পাহাড়ে স্বাভাবিক অধিকার অন্য কেউ
সম্মিলিত ভাবে নিয়ে গেছে- অস্তিত্বকে ছিঁড়ে নিজেকে যথেষ্ট
সাবলীল করার সহজ পথে। মাটির ভেতর মাটি হয়ে
থেকে যায় পাতাকুড়ানির ঘর মধ্যরাত পুরানো সংসার।
প্রাচীন মন্দির থেকে উঠে আসে গাজনের ঘ্রাণ- বটতলা—
পথের দুপাশে বনতুলসীর ঝোঁপ নিজস্ব ধর্মের ভারে
বহুচেনা এইসব গাছ সক্ষম ভঙ্গিতে আজো চেয়ে থাকে।
সূর্যাস্তে নিজেই নিজেকে দেখেছি ধ্বংস ও ক্ষয়ের পর আমি
জেগে আছি এক গোপন চৈতন্যে যেখানে নির্জনে শৈলসানু,
পাখিপুরাণের জ্যোৎস্নানদী, মহাবিশ্বের জঠরে খেলা করে।
দেখছি অতীশ শ্রীজ্ঞান নীরবে পণ্যের মতন চলে যায়
কাল থেকে মহাকালে সমষ্টির স্রোতে জন্মের আগে ও পরে।
বিগত জন্মের প্রত্ন রোদ্দুরে দেখেছে তারা পিতৃপুরুষের
ক্ষয়িষ্ণু কঙ্কাল আজো কাঁদে জ্যোৎস্নার কাঙালী আলোর শরীরে।
পাথরখন্ডের সন্ধ্যাভাষা আদি বিশ্বের মূলের দিকে টানে
যেখানে আদিম তৃষ্ণার নির্জন চর সহজেই আরণ্যক
পৃথিবীর আত্মার সংসার পেয়েছিল ঘুমন্ত দেহের দেশে।
আলোকঋতুর অবিনশ্বর ছায়ার কথা জেনে নিজেদের
বহমান প্রাণে প্রতিভা খুঁজেছে জন্মের জটিলতম ক্ষণে।
গ্রামের পথের পাথরের গায়ে কৃষ্ণদ্বাদশীর চাঁদ কাঁপে
তারই মাঝে আঘাতে আঘাতে জীবন ভেসেছে ক্ষুধার জ্বালায়
মৃত্যুময় অন্ধকারে। মরুগুল্মের মতন অভিজ্ঞতা নিয়ে
সন্তপ্ত অস্তিত্বে বেঁচে থেকে জীবনের সার্থকতা খুঁজেছিলো
P 6
প্রান্তরের এই জনপদ। অনুষ্ণ আদিম চেতনা আসন্ন
দিনের মৃত্যুর ছায়া তীব্র শোকে ঘুমের গভীর থেকে উঠে
এসে দেখে তারা ক্রমাগত পিপাসায় পরাজয়ে বৃত্তাকার
পথে ঘুরে ঘুরে ক্ষয়ে গেছে। প্রাক্তন দেহাতি পৃথিবীর এক
ভৌতিক জ্যোৎস্নার সংক্ষিপ্ত সময়ে শেকড়ের দৃঢ় ইশারার
অভিজ্ঞানে অসহায় গৃহস্থের আদিরূপে তাকিয়ে রয়েছে।
এইভাবে অনার্য মাটির নির্মল সত্তার ধুলোর ভেতরে
হৃদয়ের লেনদেনে আজো শান্ত সুগভীর স্নায়ুর অন্তরে
পোয়াতি গ্রামের স্বপ্ন দেখে। সুদূরের সময়ের অবিরল
ইতিহাস শতাব্দীর বহু ধ্বংসের শরীরে ফিরে ফিরে আসে।
তবুও সুতীব্র বেদনা উৎসের ক্ষুধিত অন্তরে বারবার
বিকশিত হয় এক অখন্ড বিশ্বাসে আর একাকী ব্যথার
দিনে জেগে ওঠে পাথরের বুক ভেঙে মাটির দুর্লভ গর্ভে।
অন্ধ বাউলের মতো দিনশেষের দিগন্তে খুঁজেছে সৃষ্টির
সেই অভিজ্ঞান যেখানে রাত্রির অন্ধ মন্দিরে মানুষ আজো
প্রসন্নতা ভিক্ষা করে, মৃত বিস্মৃত শতাব্দী জাগিয়ে দেখেছে
বেদনার নিজস্ব আগুন পৃথিবীর প্রথম রাত্রির বুকে
ফিরে যেতে চায়। সকল দুঃখের মাঝে বিপন্ন সন্ধ্যার তীব্র
দহনে শূন্যতা ভেঙে রোদ্দুরের নরম প্রশ্রয় চেয়েছিলো।
নদীতটে সভ্যতার মুখরতা অপচয়ে ম্লান হয়ে এলে
নিজেকে নিলামে তোলে— তারপর নিঃসঙ্গ প্রাণের ব্যর্থতার
ফল অনুভবে বুঝেছে দুঃখিত মৈথুনের পর আত্মজের
যে করুণ জন্ম দিয়ে গেছে তারা সংকটের নীরব মুহূর্তে
বারবার একমুঠো ক্লান্ত ছাই হয়ে উড়ে গেছে সেইসব।
P 7
শোকের অন্তরে তাদের প্রাণের ক্ষুধিত কঙ্কাল বস্তুবিশ্বে
তাদের অতীত বিশ্লেষণ করে বুঝেছিলো আজকের পথে
মানুষের হৃদয়ের সকল গহবর সকলের হৃদয়ের
নিজস্ব দুঃখের গহবর ছিলোনা কোনোদিন। প্রান্তরের নিঃস্ব
বিস্তৃত মাঠের অন্ধকার সেই কথা বলে যায়। জীবনের
অস্থির ব্যথার দিনে অসচ্ছলতায় কেন তবে পৃথিবীতে
নরকের আর্তনাদে পণ্য হয়েছি আমরা একে অপরের
কাছে সুচতুর ভাবে একই স্বাদের মাটিতে— দু-হাতে অনেক
অন্ধকার ঘেঁটে করতলে পেয়েছি শরীরী উষ্ণতার বীজ।
ঘুমন্ত বৃক্ষের পাতারা মাটিতে দিগন্ত পোড়ার শব্দ শোনে
শরীরের প্রতিকৃতি শুভ আকাঙ্ক্ষায় শুয়ে আছে হৃদয়ের
এক কোণে। ফসলের হলুদ সন্তান বিমূর্ত মুহূর্তগুলি
স্পর্শ করে জেনেছিলো নিঃশব্দে দু - হাতে গ্রামের শূন্যতা ভরে
দিলে অনন্তের অন্তরে উজ্জ্বল স্নেহের স্বাক্ষর রয়ে গেছে
জীবনের যন্ত্রণার প্রাকৃত বসন্তে—সেইখানে নীরবতা
পাথুরে প্রকৃতি ভেঙে মুখরতা পায়। আকাশের রৌদ্ররসে
বৃদ্ধের দু - চোখ অনুভব করে পার্থিব রুক্ষতা চিরে দেখে
নির্জন পাহাড়ি বটের শিকড়ে শাখায় সে জেগে আছে মূলে
বহুকাল নিঃসীম প্রবাহে— একদিন সে নির্মিত হয়েছিলো
নক্ষত্র ধুলোর লেনদেনে। অশরীরী আত্মার মতন তারা
আজো ঝরে রাঙ্গামাটির কদমতলে। ঘর বাড়ি হাঁড়ি ঘট
ভাঙ্গা প্রত্নস্তূপ থেকে থেঁতলানো কঙ্কালে জীবাশ্মে সুলগ্নের
প্রেমজাত প্রিয়জনের শীতল অভিযোগে আজ তার মৌন
অভিযান সমূহ জ্যোৎস্নার শালবন জুড়ে— হাহাকার থেকে
P 8
শর্বরী জন্মের পাষাণ প্রতিমা তার নিঃস্ব শিরদাঁড়াটুকু
নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে আপন ছায়ার অন্ধকারে ফাল্গুনের
শাণিত শীতল পাথরের চিরস্থির রামগড়ের জঙ্গলে
জলহীন তরুতলে পাতারা কেঁপেছে মাথার শিয়রে ঝর্না
তার জলশঙ্খে অসংখ্য নদীর জন্ম দিয়ে জন্ম বেদনায়
হিম সূর্যাস্তের সকল সময় তার অছিন্ন সন্তানদের
কাছে পেতে চেয়েছিলো আজ সেখানে পাখিরা অজ্ঞাত আড়ালে
করুণ নিশ্বর হয়ে কোথাও হয়তো বেঁচে আছে শব্দহীন
রক্তস্রোতে একাকী বিষন্ন সময়ের অর্জুন শালের দেহে।
চিরন্তন মেঘ অবিশ্রাম ঘুরে ঘুরে এখানের মুহ্যমান
হিম মরুরাতে অন্ধকার শুষ্ক বাতাসের দীর্ঘ কান্না শুনে
বুঝেছিলো পাথরের হৃদয়ের নূপুরের শব্দে বারবার
সাঁওতালপরগণা উপজাত হয়ে আদি শিলাগন্ধস্রোতে
ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে থেকে তারই আশা নিরাশার অন্তহীন খেদে
বিদীর্ণ করেছে বনভূমি। উঁচু নিচু চড়ায়- উৎরায় স্বাক্ষী
হয়ে রয়ে গেছে তাদেরই প্রাণের অপজীর্ণ স্বেদ অস্থি মাংসে।
পৃথিবীতে মানুষ তাদের জন্মের প্রণয়ে জন্মকে স্বার্থক
করতে রাষ্ট্রের বিপ্লবে নিজেকে যুক্ত করে তার পরবর্তী
প্রজন্মের হাতে জীবনের বহু স্বাদ দিতে গিয়ে দেখেছিলো
ক্ষণিক স্ফুলিঙ্গে বিরসা অনেককাল তাদের বাঁচিয়ে রেখে
বুঝিয়ে গিয়েছে প্রতিযুদ্ধের মাধ্যমে বিপ্লবের জন্ম দিয়ে
সন্তানের সুযোগ্য জন্মের শরীরে কালের ঋণ পরিশোধ
করে পৃথিবীর পরিচিত প্রতিবিম্ব নিজের দুয়ারে টেনে
না নিলে প্রাণের প্রচ্ছন্ন চিহ্নের স্বাদ ক্রমাগত আকাঙ্ক্ষার
P 9
আবহমানের দৃশ্য তার নিশ্চিহ্নের দিকে চলে যেতে থাকে।
উৎসবের দগ্ধ দিনে এখানে দুঃখিত জন্মভূমি পঞ্চকোট
রাজসভা পাষাণের নগ্ন প্রতিধ্বনি শোনে। উঁচু নিচু টিলা
বনটিয়া আজ প্রাসাদে প্রাচীন প্রত্নঘ্রাণ নিয়ে টের পায়
ছলছল জলস্রোত ছিলো কোনো একদিন। অধরা ঝুমুর
ভাদু টুসু ধামসা মাদল আড়বাঁশি নিজেকে উজাড় করে
মাতৃমূলে গেঁথে আছে বহু বিস্মৃত পোয়াতি গাঁয়ের বীজের
গভীরে অলক্ষ্যে যেখানে বুকের অতলে প্রাকৃত ইতিহাস
নতজানু হয়ে আছে নরকের মেধাহীন মস্তিষ্কের গর্ভে।
তবুও নতুন আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিতে চেয়ে নির্জনে ভেঙেছে
ধ্বংসের দিনের স্থবিরতা। পাহাড়ি ডুংরির উপল আকীর্ণ
পথে প্রাকপ্রত্নে নিহিত সত্যের হাহাকার প্রত্যাশার জন্ম
দিলে, মৃত্যু মৃত্যুহীন হয়— সূর্যাস্তের গৈরিক গোধূলি সেই
কণ্ঠস্বর জানে— জানে শিকড়ে শিরায় আদিম বৃক্ষের জন্ম
মৃত্যু শেষ ক্ষয় আর ঝুরিনামা রহস্যের নিবিড় সন্ধান।
রাত্রির আতুর গন্ধ দিগন্ত রেখার থেকে নেমে শতখাতে
বয়ে গিয়ে চেতনার রক্তাক্ত শরীরে পার্থিব জন্মের ঘাসে
শ্মশানচুল্লির দগ্ধ অঙ্গার মাটিতে প্রশ্নচিহ্ন রেখে গেছে।
সেঁজুতির আলো নিভে গেছে তবু দুঃস্বপ্নের নদী থেকে উঠে
এসে নাভিকুন্ডে মহাকালের পায়ের ছাপ দেখে আলোকিত
মায়াসুরে ফিরে ফিরে এসেছে বিশ্বের বিস্তৃত বেদনা ছুঁয়ে।
পলাশের বন অন্তিম প্রান্তর অরুণাভ করে চলে যায়
বসন্তের শেষে— অজস্র উড়ন্ত বনটিয়ার সবুজ ঝাঁক
ঈশ্বরপুত্রের দিকে চেয়ে থেকে দেখে জরা মরণের ডাক
P 10
অস্তিত্বের আদি স্বরলিপি মৃত্তিকা জন্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে
আছে। সংঘবদ্ধ মৃত্যুকান্না প্রাগৈতিহাসিক পুকুরের জলে
ধ্বনিত হয়েছে নিরবধি কাল সময়গ্রন্থিকে সাথে নিয়ে।
প্রত্ন অতীতের চৌখুপি দেউল মৃত্যুগন্ধ— ঋজুপালিকার
তটে শালবৃক্ষের মহৎ আকাশতরঙ্গ বাঁচিয়ে রেখেছে
আদিস্বরে একা একা নিজেকে জ্বালিয়ে জলচক্রের আদিম
পুনরাবর্তনে; একদিন যেখানে একাকী প্রাক-মুন্ডা জন
তাদের দেহজ উত্তাপে নির্ঘুম প্রোটো-মেডিটেরেনীয় ক্ষুদ্র
আগুনের জলছবি টেনে এনেছিলো এখানের ভূখণ্ডের
উঠোনের মাটি চুমে জীবনের অনন্ত রক্তিম স্বপ্নসুরে।
এখানে এখন স্মৃতির নির্বাক আকাঙ্ক্ষারা সন্ধ্যার দুঃখিত
মাঠে জেগে থেকে পৌষের প্রচ্ছদে আলপথ শস্যক্ষেত আঁকে।
অরণ্যের পরপারে জন্ম ও মৃত্যুর সংঘাতে শীতের সন্ধ্যা
কেটে যায় শাল মহুয়ার রুক্ষ গাঁয়ে তবুও আশার গভীরে
বেঁচে থাকে নক্ষত্রের নদীজল। ক্ষয়ের গভীরে রয়ে যায়
পৃথিবীর ব্যাপক বিস্তৃতি আর নিঃশব্দে যুদ্ধের বজ্রচিহ্ন।
বিষাদের দেশ মোহময় অন্ধকারে মানুষের মন বিদ্ধ
করে চিরকাল বিষন্ন মাটির করোটির ভিতরে মৃত্যুর
ধ্বনি ভাসিয়েছে। চূড়ান্ত দুঃখের দিনে অরণ্যের কিছু ভাঙ্গা
কোলাহল প্রাণের প্রগাঢ় কথায় তাদের জন্মস্রোতে মিশে
গিয়ে দেখে চিরকাল মানুষের প্রতিভার মেঘ ভেঙে দিয়ে
গেছে করতলে একমুঠো সংহত বিশ্বাস। অতীতের এই
আপৃথিবী ভাঙনের কথা মানুষকে একাকী অচেনা করে
গেছে। নিষাদের দেহ ছুঁয়ে তারই ধূসর ইশারা জেগে থাকে।
P11
লোধ্ররেনুময় সন্ধ্যার অন্তিম আকাশ সৃষ্টির নৈঃশব্দ্যের
মর্মমন্ত্রকথা শান্তভাবে নিজস্ব অভ্যাসে প্রাগৈতিহাসিক
বৃত্তপথে ক্রমশ আত্মস্থ করে সূর্যাস্তের অন্ধকার নিয়ে
দৃঢ় নিঃস্বতার সুরকে বিশীর্ণ হৃদয়ে উৎকীর্ণ করে তারা
জেনেছিলো শরীরী স্রোতের মধ্যে নদীর দহনে বেঁচে আছে
পৃথিবীর সমূহ পথের প্রসারণ। শূন্য দিগন্তের থেকে
তারা দেখে অন্তহীন এক মৃন্ময়ী রূপাঙ্গ অরণ্যদেবীর
বীজের ভেতর নিজেকে কালের মহাক্ষেত্রে ছায়ার আঙ্গিকে
গোপনে রেখেছে। বিমূর্ত বিভঙ্গে ক্ষতচিহ্নগুলি ছায়াহীন
ছায়ার ভেতর এইভাবে রয়ে গিয়ে অজ্ঞাত জীবন থেকে
ক্ষরিত মৃত্যুর অভিজ্ঞতা তাদের উৎসের দিকে নিয়ে যায়।
পুনর্জন্মময় প্রার্থনার পরিসরে দেহাতীত প্রতিবিম্বে
দেখেছি প্রতিটি অনন্ত পথের রেখা অসম্পূর্ণ হয়ে আছে
যেখানে রোগা ও রুগ্ন শিশুর স্বপ্নের হাত ধানের মঞ্জুরি
ছুঁয়ে আকস্মিক জেগে ওঠে। নিজস্ব দু-হাতে সূর্যের সৌভাগ্য
তবু তুলে নিতে চেয়েছিলো শৈশবের প্রোটো-অস্ট্রোলয়েডরা।
অন্তর্গূঢ় বেদনার গোধূলিলগ্নের পুরোনো গুহার গাঢ়
শ্যাওলার স্মৃতির বিস্ময়ে তখনও নেগ্রিটো জীবন তার
কৃষ্ণাঙ্গের শক্ত গ্রীবার চোয়ালে মুখে শঙ্খের মতন তীব্র
ভাষা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে স্থলচেতনার ফসলের ক্ষেত
ভালোবেসে। বিরতি বিহীন এক ইশারায় অজস্র কোষের
সৃষ্টির সহস্র স্পন্দন মাটিতে মহাজীবনের স্বাদে গেঁথে
যাচ্ছিলো নিজেকে ক্রমাগত প্রসারণশীল ঘন মহাবিশ্বে।
P12
হারানো সন্ধ্যার বুলবুলি নাচ আজ প্রথম সৃষ্টির মতো
কাছে আসে। কৃষ্ণের মুরলি ডাকে সখী শ্রীরাধা আসরে আসে।
জন্ম পুরাণের পথে জীর্ণ পাতার স্পন্দনে মৃতক্ষত ছুঁয়ে
সাঁওতাল গ্রামজননীর হাতের মলিন রেখা ভালোবেসে
একদিন ডেকেছিলো তার আঁকাবাঁকা বিদীর্ণ পল্লীর ঘরে।
পর্বত সংকুল এই মালভূমি পৃথিবীর এক বন্ধামাঠে
শুয়ে আছে; - শুয়ে আছে—সম্ভাবনাময় সকল শস্যের দানা;
সম্ভাবনাময় প্রত্নরক্ত গাঁথা দুঃখিত কাঙালি প্রাণশক্তি।
ক্ষয় ক্ষতি শোক জড়িয়ে জটিল বিহারিনাথের অন্ধগ্রাম
নাড়ি বেয়ে নেমে আসে শৈশবের অতল জলের নাভিপদ্মে।
বাউল রাত্রির ভাষা সন্ধ্যার সন্ন্যাসী আলোর গোধূলি চিহ্নে
মিশে গেছে অবসন্ন আলপথে সেইখানে শস্যের সংলাপ
শুনেছি নিষাদী বাতাসের গানে। অস্ফুটে শুনেছি ভাঙ্গাচোরা
অন্ধকারবুড়ির নির্জন স্বর- দেহজলে ধ্বংস জন্মভূমি
আমাকে পোড়ালো তারই শীর্ণ জোড়ে। শিকড়ের সন্ধ্যা শাখা ছিঁড়ে
জঠরের যতদূরে ভেসে আছি জন্মান্ধ দু-চোখ বহুদূর
সেই ঋণ রেখে ভেসে আছে নিজস্ব দূরত্বে। এখানে এখন
মন্দিরের দীর্ঘ আগ্নেয় শিলার মাটিছায়াগন্ধ মৃদঙ্গের
মতো হৃদয়ের এক কোণে বেজে গেছে দুঃখিত রাত্রির সঙ্গে।
ঋষভনাথের শিখরভূমের উষ্ণীষ ইছরি অজয়ের
জলে ভেসে আছে—ভেসে আছে রাঢ়ভূমি তারই প্রত্ন পদতলে।
ষড়ঋতু জুড়ে বেদনা পাথরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বীরজঙ্গা;
সেই গুহামুখ থেকে অহল্যাবাতাসে অভিমানী দামোদর
দামদাক ভাষা নিয়ে নেমেছে জঙ্গলমহল ধবলভূম
P 13
ঘিরে আদি জীবনের জন্মঘ্রাণে বিষাদের মৃত স্তূপ ছুঁয়ে।
এখানে আমার জীবন শোকার্ত পাতার মতন অবিরল
পেতে চেয়েছিলো গোপন জ্যোতির জল নিজেরই দহন পাত্রে।
জরায়ুর দুঃখী গর্ভজাল ভেঙ্গে ভেঙ্গে কত হিমযুগ আর
বৃষ্টিরাত চিরে কৃষ্ণপক্ষে চতুর্দশীর গোপন ক্ষীণ চাঁদে
ভেসে আছি ক্ষতচিহ্নের আতীব্র রক্তরসে। আজ নাভিকুন্ড
ছেয়ে আছে প্রস্তর জীবাশ্ম; যদিও আমরা আমাদের উষ্ণ
রাষ্ট্রস্রোতে মিশে গিয়ে চেয়েছি অভিন্ন মুখ- এখন পাঁজরে
দূরের নদীর শরীরে নূপুর বাজে সূর্যাস্তের ভিন্নগন্ধে।
অযোধ্যা পাহাড় ঘিরে বৈশাখী পূর্ণিমা নেমে আসে- খরপ্রভা
জীবনের সরল বিস্তার বুনো শুয়োরের দিকে ছুটে যায়;
অরণ্য বাকলে জ্যোৎস্না আসে, দিশুম সেন্দরা মন্থর সৃষ্টির
মন্থনের দিকে নিয়ে যায়। শ্যাওলার সহজাত অন্ধকার
নিথর শূন্যতা নিয়ে পাতা খসার অস্তিত্বে পিতৃপ্রবাহের
ছবি আঁকে- সেইখানে ভাঙ্গা মাটির মানুষ মানুষের কাছে
গল্পের আদিম দৃশ্য খোদিত করেছে ঝিঁঝিঁর নিবিড় ডাকে।
জন্মশোক স্মৃতিজল ছুঁয়ে প্রবীণ বৃক্ষের প্রাকৃত কঙ্কালে
চেয়ে থাকে; অন্তরের নির্জনতা নিজের মরমী অন্তর্লীন
বাঁশির একাগ্র সুরে আত্মগত ছায়ার গভীরে ক্ষতগুলি
দেখেছে, শ্মশানভূমিতে কিভাবে চন্দ্রদগ্ধ এক নদী ভাঙ্গা
মলিন আলোর বাঁশবন থেকে নিরুদ্দেশ হয়- চেতনার
সুগভীর স্তরের ভেতর? শেকড়ের স্নেহের স্রোতের ছায়া
কুটিরে ধ্বনিত হয়েছিল যাদের শিরায় তারা আজ মৃত;
সহস্র রাত্রির আঁধার পেরিয়ে প্রান্তরের দুর্বোধ্য পশ্চিমে
P14
চলে গেছে কোন স্বান্তনার- আকাঙ্ক্ষার উজ্জ্বল পথের দিকে?
নদীর কিনারে অচেনা পাখিরা আসে যায় জ্যোৎস্নায় তাদের
প্রতিবিম্ব ভাসে— শতাব্দীর সূর্যাস্তের পর জীবন কি তবে
তায়- সৃষ্টিবীজে ছাইতাপে হৃদয়ের সেই স্পর্শ রেখে যায়?
বিষাদের প্রিয় মুখগুলি অরণ্য প্রদেশে জীবিতের মাটি
হাঁটুভাঙ্গা দুঃখে নিজের সত্তার থেকে বিযুক্ত হয়েছে, তবু
বীরহড় বেঁচে থাকে নিজস্ব উদ্যমে; আত্মবিনাশের থেকে
বহুদূর সঙ্ঘে জীবন ছায়ার অনেক বিশ্বাস ভালোবেসে।
পাহারতলির বনস্থল অন্ধকার সংশয়ের সীমানার
জঙ্গলে গেঁথেছে পৃথিবীর উচ্ছিষ্ট উৎসাহে তাদের নিজস্ব
আনন্দের জনপদ। পত্রশাখা কুসুমের ফুল শব্দহীন
স্বেদবিন্দুগুলি পার্বত্য পথের ধুলোয় শীতের শিশিরের
গন্ধে বটফুল গৃহস্থের তাপে মিশে গিয়ে সংখ্যাহীন বর্ণে
ঋতুর সকল ডানামেলে মধুবনে উড়ে যায় অভিসারে।
অবেলার স্মৃতিগুলি রদবদলের পরিবৃত্তে সেইসব
অনুবিম্বে চেয়ে থেকে আসন্ন অঘ্রানে আগামীর শস্যক্ষেতে
বনভোজনের পুরোনো পার্বণে জন্মকে সার্থক মহীরুহে
পরিনত করে যেতে চায় বিজ্ঞাপনের চতুর অন্তরালে।
শতাব্দীর এই শহরের হিমঋতু ক্রমশ যখন এক
নিভৃত শোকের দিকে আমাদের নিয়ে যায়— ন্যুব্জ করে রাখে
দেখেছি সেদিন পৃথিবীর গুহার মানুষ মহাজাগতিক
পাখির ডানায় ছায়ার আতপে সুযোগ্য সম্বলে বেঁচে আছে
পিপাসার পুত্র কন্যা নিয়ে প্রেমে পূর্ণ হয়ে পরস্পর একই
দেহস্থিত মনিকোষের মহৎ অন্তরে আচ্ছন্ন হয়ে থেকে।
P15
বিশৃঙ্খলা বিগত স্মৃতিতে যে জ্ঞান দিয়েছে তারই প্রান্তরের
একপাশে দেখি আমাদেরই প্রজ্ঞাবান পুরুষ তন্ময় জ্ঞানে
সুস্থির তরঙ্গ ছড়িয়েছে নিজের সন্তানদের দেহরক্তে—
আবাদভূমিকে পঞ্চতীর্থ - পঞ্চগুণের দহন অশ্রু দিয়ে
ভরাট করেছে। যারা চিরকাল রোদ্দুরে কুণ্ঠিত হয়ে ঝুঁকে
নৈঃশব্দ্যের অন্ধকারে নিহতের মতো বেঁচেছে মলিন মুখে
তারা আজ বিচ্ছেদের দিনে সংগ্রামের দৃঢ় কথা বলে জন্ম
মৃত্যুর জীবন ছড়িয়ে দিয়েছে নির্নিমেষ আলোর গভীরে।
জন্মের আদিমতম অস্তিত্বে যুদ্ধের গভীরেই তারা বেঁচে
আছে নিরন্তর সভ্যতার দেহে। পাতাঝরা ধুলোর কঠিন
ভূমির নাভিতে দুর্বোধ্য বেদনা সহে প্রথম দিনের নগ্ন
পৃথিবীকে-পাখির জীবন পেয়ে শতশোকে আজো ভালোবাসে।
অরণ্যভূমির সন্ধ্যার শেকড়ে ও বীজে যে ক্ষত চিহ্নগুলি
আছে তা প্রাকৃত রাখালের নগ্ন হাতের ছোঁয়ায় ঘুমিয়েছে—
জন্মের নিবিড় মাতৃনাড়ির শুশ্রূষা পেয়ে সূর্যাস্তে আবার
অন্তঃসত্বা হয়- বিশ্বলতার বাঁশির রূপসুরে বেজে চলে।
টিলার ভেতর আগ্নেয় শিলার ঘুমহীন মহাকাশ থেকে
এক দীর্ঘ পথের যন্ত্রণাময় ছায়াপথ অভিমানে নেমে
এসে তার সৃষ্টির বিষন্ন হৃদয়ে নদীর জন্ম দিতে চায়
এখানের অবাধ দিগন্তে- নির্জলা পাথরে জলজ ঘাসের
গ্রাম ভিক্ষে করে — সবুজ ব্যাপ্তিতে দীর্ঘ চরাচর এক মুক্ত
উঠোনের স্বপ্ন দেখে। অতীত বর্ষার স্মৃতি বিশুষ্ক বাতাসে
যুবতী কাঁসায় শীলাবতীর উদ্দাম জলস্রোতের শব্দের
ছবি আঁকে।
P1
আমি এক চিহ্নিত প্রস্তরখণ্ড ১
সৌম্যেন চট্টোপাধ্যায়
পাতার আড়ালে ধূসর বিবর্ণ ইতিহাস উড়ে যায় ছেঁড়া
মেঘের মতন। এই ভূখণ্ডের খণ্ডহীন ঘন নীরবতা
পাথুরে পাঁজর ভেদ করে ওঠে। নামগোত্রহীন মানুষের
রিক্ত কালোছায়ার রক্তিল স্মৃতিক্ষত অতলে তলিয়ে গেছে।
সামনে অহল্যাবাঈ সড়ক, প্রাচীন বেদনার জনপদ,
হরিমন্দিরের পাতকুয়ো, পিতৃপুরুষের গন্ধ, ভিটেমাটি,
বনবুড়ি, ক্রমশ একাকী লুপ্ত হয় বহুমাত্রিক অস্তিত্বে।
সৃষ্টির সন্ধ্যার কৃষ্ণ স্রোতে তারা মৃত্যু ও ধ্বংসের মুখোমুখি।
প্রিয় রামনিধি, আমার বিগত বিশ্বাসের এই গ্রামে শান্ত
প্রত্নগর্ভ থেকে জন্মভূমির শিকড় ছিঁড়ে মৃত্যু মায়া চক্রে
আমি এক চিহ্নিত প্রস্তরখন্ড; বাঁশি জানে সেই অভিমান!
রাখালি দেহের বাকলে কালের কান্না, লুণ্ঠিত নক্ষত্র সুর
জন্মান্তরে জন্ম দিয়ে গেলো অঙ্কুরিত পরাস্ত রক্তের পলি।
পৃথিবীতে পরাজিত মৃত্যুর মতন বহুদূর অন্ধকার
কোথাও তো নেই। জীবনের প্রগাঢ় স্থানাঙ্ক সতত অস্পষ্ট
হলে শরীরের বায়ু অবিরল টের পায় নিঃসঙ্গতা আর
মৃত্যুশব্দ যা গোপনে প্রচ্ছন্ন ছায়ার মতো অনর্গল ফাঁপা
হাড়ের ভেতর আমাদের ডেকে নেয় চেতনার খররৌদ্রে।
ধমনীতে স্রোতশীল এই সেই গ্রামদেবতার দেহাতীত
দেহরূপ ও সুপরিচিত ফসলের ঝরে পড়া দীর্ঘক্ষেত—
নদী - খাল - বিল - ডোবা - মাঠ বিস্ময়ের পর বিস্ময় জাগায়।
P2
মনেপড়ে একদিন এখানের সাঁওতালি সন্ধ্যার জঠরে
অতীতের জনগোষ্ঠী দেখেছিল মাথার উপর ঋতুবতী
প্রেয়সীর ছায়াপথ, পাহাড়ি দুখের বৃহস্পতি, মৃগশিরা —
সূর্যাস্তের চিতার শরীরে মন্থর রোদনে জীবাশ্মের খেলা—
আর তারা দেখেছিল কালপুরুষের ভেতর রাষ্ট্রের নগ্ন
বড়শিতে বিঁধে থাকা বুনো বিষের অচেনা নখত্রমণ্ডল।
ডাহুকের গ্রামে মৃতবৎসা মায়ের সন্তান প্রীতির মতন
স্মৃতির আকাঙ্ক্ষা আজ ধূ - ধূ মৃত আত্মার কবিতা হয়ে ওঠে।
প্রাকৃত প্রবাহে আলুলায়িত আদিম অন্ধকারে জীবনের
ফাল্গুনে নারীর গর্ভে জন্মছন্দ গেঁথেছিলো মহুয়ার গন্ধে।
ঘর বেঁধেছিলো পাথরের খিলানে, রক্তের শাশ্বত স্বভাবে।
অজস্র তপস্যামন্ত্র পাহাড়ি জোড়ের সংকীর্ণ জলজ দেহে
বয়ে যায়। তিতিরের উদাসীন ডাক পড়ে থাকে মৃত মাঠে।
নিঃশব্দে শিকড় থেকে উঠে আসে অন্ধকারের অনন্ত জ্যোতি।
এই বাঁশঝাড়, কুলঝোপ, পলাশের আঁকাবাঁকা রুক্ষ বন
আদিবাসী বুকের ভেতর এক অজানা গভীর গোধূলিকে
জাগিয়ে জন্মের প্রখর নিস্তব্ধ ইথারের গূঢ় ইতিহাস
সময়কে ডুবিয়ে রেখেছে। তবু অবিরত সেই ঘুঘুবনে
আলোর কঙ্কাল আর পোড়া মাটির পাথুরে জননীর হাড়
রক্তরেনু অনস্তিত্বের সকল কাঠামোতে নিজস্ব বীজের
জন্মাধীন গন্ধে বেদনার অবশিষ্ট কিছু ছায়া রেখে গেছে।
প্রাচীন শিশিরে ভেজা সন্ধ্যার চড়ুই পাখিগুলি শূন্যতার
P3
ওইপার থেকে উড়ে আসে। এমনি সে অদৃশ্য আত্মীয়;
শরীরের জলরঙ পৃথিবীতে ডেকেছে যাদের বারবার।
তাদের ধূসর ডানার বিস্তারে দূরের টিলার রোদ্দুরের
ক্লান্তি গেঁথে আছে। রুগ্ন পোড়া কঙ্কালের অশ্রু নিরীহ রাত্রির
উপত্যকা দিয়ে নেমে আসে। বীজের ভেতর অঘ্রান গ্রন্থির
প্রাণের প্রণয়চিহ্ন দেহকোষে আঁকা বিষাদ পথের স্পষ্ট
ইতিবৃত্ত সীমানা ছাড়িয়ে স্থবির রঙের গোপন গহবর
দিয়ে মিশে যেতে চেয়েছিলো রাষ্ট্রের সমস্ত সম্ভবে, বিকল্প
জীবনের মূল মুহূর্তের শক্ত অন্তপুরের বধির গাত্রে।
তারপর কল্পনা উৎসের দিকে যেতে গিয়ে দেখেছে স্মৃতির
ভেতর নরক ও ঈশ্বর পাশাপাশি নিজস্ব কবরে শুয়ে
আছে নিরুত্তাপ। দু - পাশের দুই হলুদ পৃথিবী মুখোমুখি
তাদের সহস্র আঙ্গুলের খুলির জন্মের প্রত্ন ছাপ নিয়ে
হেঁটে যায় সূর্যাস্তে জন্মান্ধ বিধবা মা পাখির শবের দেশে।
নুড়ি পাথরের কাঁকুড়ে আহ্বান রাত্রির কঠিন সাদাহিম
বাতাসে সকল পথের বক্রতা ছুঁয়ে ভেসে ওঠে চিরচেনা
শ্মশানের এলোমেলো নদীর অন্তরে। চিতার যে ছাই নম্র
প্রত্যাশায় সৃষ্টির ব্যথার শব্দে বেঁচে আছে তাদের ধোঁয়াটে
যুদ্ধক্ষেত্র গোপন অসুখে দামোদর - কংসাবতীর অনার্য
বুড়ি জলচরে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে বিচ্ছিন্ন দৃশ্যের জন্ম দেয়।
মনভাঙ্গা নিশ্বাসের প্রতিধ্বনি স্বর্গ নরকের আদিগন্ত
অজ্ঞাত মৈথুনে নির্বংশের পশ্চিমে নিশ্চিহ্ন হয়ে উড়ে যায়
শুকনো খয়েরি শালপাতার মতন। সুবর্ণরেখার রুক্ষ
কিনারে আবার তারা সংসার পেতেছে গিরিবর্তের নিস্পৃহ
জটাজালে। বিস্তীর্ণ খরার অরণ্য অঞ্চলে করুন স্বপ্নের
P4
প্রান্তদেশে বারংবার নেমে আসে আদিম জাতির মারাংবুরু।
পরেশনাথের স্বান্তনার সুদীর্ঘ স্নেহের পৃথিবীর রসে
সিক্ত হয়ে অনন্ত আকাশে ঘুরে ঘুরে আভাস্বর শালিধান
দিয়েছিলো গোধূলি বেলার বৃষ্টিযুগে। মুছে গেছে সেই সত্য।
নেগ্রেটো - অষ্ট্রিকদের দীর্ঘশ্বাস আত্মকথা বিকিয়ে গিয়েছে।
বহুদূর অন্ধকারে কন্ঠস্বর মিলিয়ে যাবার আগে তারা
তাদের জন্মের যন্ত্রণার নিঃস্ব অনন্ত দু - হাতে সন্তানকে
ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছে। আরো ঘনীভূত হয় নিষাদের
আড়ষ্ঠ জন্মের মর্মমূলে বঞ্চনার বিপন্ন বিশ্বের কথা।
প্রতিরাতে বেদনার অন্ধকূপে সময়ের কোলে আত্মজের
জন্ম দিয়ে কার্তিকের হিম হাহাকারে উঠোনে ধানের স্বপ্নে
শতছিন্ন কাঁথার আড়ালে নিজেকে ঢেকেছে পাহাড়ের গায়ে।
শতাব্দীর প্রিয় রোদ অপচয় করে তাদের বাঁচিয়ে রাখে
রাষ্ট্রের সময়। প্রতিদিন আলোর দৃশ্যকে এভাবে নিহত
হতে হয় একটি সুদীর্ঘ সূর্যমুখী অট্টালিকার মিনারে।
কুয়াশার পারে দেখেছে তাদের পূর্বপুরুষের প্রতিবিম্বে
শূন্যতা তাড়িত জীবনের আত্মহত্যার পিচ্চল গঠনের
অন্তর্বর্তী মাটি জ্যোৎস্না রাতের সীমান্তে তরল মৃত্যুর বনে
কেঁদেছে একাকী। তমাল তলের বিস্তৃত বুকের উষ্ণ ছোঁয়া
নিয়ে শালবৃক্ষগুলি মহাকাশ থেকে গভীর রাতের স্তব্ধ
নরম পলাশ ফুলে গৃহস্থের শালিকের মুখে ভাষা দিয়ে
তাদেরকে নিজেদের অনিবার্য সামান্য অস্তিত্বে টেনে আনে।
পৌষের পুরোনো পাখিরা তাদের আকাল শোকের শৈশবের
ঘরে ফিরে ঘুমন্ত মায়ের কৃষ্ণস্তনবৃন্তের বিভঙ্গ দেহ
রেখায় তিষ্ণার্ত মুখ রেখে পৃথিবীর নোনো অশ্রু পান করে।
P5
সেইদিন আসন্ন গোধূলি সন্ধ্যার শিয়রে ফসলের শিস
খুদকুড়ো আর তর্পনের জল নিয়ে শুষ্ক ভূমির কাছেই
বেঁচে থাকা সমাধী গম্বুজ তাদের প্রাণের আত্মজের সাথে
মায়াময় বৃদ্ধ যোগরেখা রেখে যায় ঋজুপালিকার দেহে।
দূরের নক্ষত্র পর্ণকুটিরের কাছে এলে ধামসা মাদল
অটুট বাঁধনে জন্মান্তর বাঁশির করুন স্থবির বিশ্বাসে
কোনো এক ছিন্ন পথে একত্রিত সহবাসে শূন্যে মুক্ত হয়।
আদিম শিলার চোখের কোটরে এই শ্যাওলা গ্রহের বেলা
চলে যায় স্বেদঝরা শরীরের মর্মর ধ্বনির ভাঙ্গাগানে।
আমার মাটির গোপন ভূখণ্ডে প্রাক পূর্ণিমার আলপনা,
অতীত ঋতুর অন্তরঙ্গ ডাক— বহুদূর অরণ্য শিখরে
কাঁদে প্রিয়তর পর্ণশবরীর কাছে; একদিন রক্তসাঁঝে
যে কাঠকুড়ানি তাকে ভরেছিলো কাঁচা শালফুলের সুগন্ধে।
মৃদুভাষী তার আত্মার গোপন অবসাদে বিগত জন্মের
ছিন্নমূল রূঢ় হাহাকার, পাহাড়ি বাতাস প্রবীণ মধ্যাহ্নে
সমাধির ঘ্রাণ থেকে তুলে আনে সমিধের সেই আলোলিপি
যেখানে নির্ভুল দু - হাত মায়াবী যুবকের প্রত্ন গেরস্থালি
ভরেছিলো অন্তহীন মেঠোপথের প্রেমিক রোদ্দুরের শব্দে।
যৌবন হারানো প্রতিটি বিচ্ছিন্ন নদী রক্তের বন্ধনে ভেসে
পৃথিবীর সচ্ছলতা নিয়ে স্রোতে সংঘবদ্ধ হতে চেয়েছিলো।
আজ নাভিমূলে মন্থর আলোর মৃত মেঘ কাঁদে।অন্ধবীজ
কারা দিয়ে গেলো শূন্য করতলে! অনার্যের অশ্রু মুছে দিতে
প্রেরিত আকাশ নিয়ে গেলো কারা! অস্তিত্বের অভ্যন্তরে থেকে
সভ্যতার গর্ভানুর সুর চেয়েছিলো। বিষাদের আদি গ্রন্থি;
P6
নীরব জরায়ু গর্ভে, জন্মভোরের মেরুন আলোয় নিহিত
অমৃত গানের আত্মার অন্তরে; মুখোমুখি হতে চেয়েছিলো
রৌদ্রের ভেতর। প্রপিতামহের ঋজু সুঠাম শরীরে হিম
কুয়াশায় জড়ানো, আবছা সন্ধ্যাগন্ধে ছেঁড়া কাঁথা,
ভাঙ্গাচোরা
দূর তরঙ্গের প্রতিচ্ছবি, হৃদয়ের চেতনায় পণ্য হয় ।
মৃত্যুর রহস্যলতা মনসাকাঁটার বেড়া থেকে উঠে এসে
উঠোনে দাঁড়ায়। মহাকাল ছায়াজালে সময় ও দূরত্বের
বিস্ময় নির্মাণ করে প্রতিমুহূর্তে অতীত হয়। শিকড়ের
স্তব্ধভূমি গাঢ় স্বরে মহুয়ার পাখিদের ডেকে নিলে দেখি
শরীরে আবদ্ধ রক্তদ্বীপ শুকনো পাতার মতো নিঃস্ব হয়ে
খসে যায়। সৃষ্টির গভীরতর শিল্প নিঃশব্দে মাটিতে ঝরে
শতখাতে। লাভাস্রোতে পার্বত্য কঙ্কাল দুঃস্থ প্রেমিকার চূর্ণ
মুখশ্রীর দৃশ্য এঁকে চিরন্তনী আত্মীয়তা দিয়ে বারবার
শব্দহীন উৎসের জটিল অস্তিত্বে ডেকেছে তার হেমন্তের
মেধাবী রাতের ব্যাকুল নক্ষত্র আলোয় নিষিক্ত আত্মপথে।
সেইদিন শ্মশানের মৃতনদী ধরে রাখে অতীত মায়ের
মায়াবী দেহটি। আর পাথরের খিলানে জলের অশরীরী
চোখ চরাচর জুড়ে রুক্ষ তটে পৃথিবীর আদিম বুড়ির
সঙ্গে দুঃখ বিনিময় করে অর্থহীনতার পরপারে বেঁচে
থাকার সফল গল্প শোনে এই সমুজ্জ্বল তীর্থের ভূমিতে।
দহনের ভ্রূণপুঞ্জের বিপন্ন বিকাশ কাঁকুরে শূন্যতার
P7
স্থায়ী অন্ধকারে নিজেকেই নিজে দেখে। সীমা সময় ছড়িয়ে
কংসাবতী ভিটেমাটি পোড়া নির্বাসিত মানুষের শিলাবর্তে
বেঁচে থাকা হৃদয়ের কথা বলে। হারানো গ্রামের অন্ধকার
ধূসর বিষাদ, রূপাই নদীর জলে প্রেতের মতন ভাসে।
নিরুদ্দেশ শব্দের অতীত ছেঁড়াখোঁড়া প্রতিবিম্ব জেগে আছে।
অজস্র বিষন্ন জৈন মঠের মৌনতা পাথুরে মাটির দেশে
আজো ধ্যানমগ্ন ঋষির মতন এখানের জীবনের গূঢ়
মধ্যমণি ছুঁয়ে স্থিতপ্রজ্ঞ। শালের জঙ্গলে প্রপিতামহের
দুখের শিকড়ে কৈবল্যের প্রাগৈতিহাসিক চৈত্রের আকাশ
অতীত বৃষ্টির বিন্দু খোঁজে। এভাবে তাদের রাত্রি গাঢ় হয়।
নাম গোত্রহীন চেতনার এই দেশে বৈশালীনগর কাঁদে।
পাতাহীন অশ্বত্থের তলে শুকনো পাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্থির
দীক্ষিত স্বপ্নের অসমাপ্ত ইচ্ছাগুলির হলুদ আর্তশব্দ
মন্থর সন্ধ্যার বিশীর্ণ বন্দিসে বাজে। বহু স্বাক্ষর বিহীন
শেষরাতে কোনো এক মৃত প্রাক্তন স্রোতের জনপদ তার
জীবনের নোনা ঘাম চেয়ে কেঁদে ওঠে। স্তব্ধ করোটি কঙ্কাল
আকাশের নিচে অতি ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে অভাবী অস্তিত্ব
বাঁধনার অহিরা গানের সমবেত ঘুঙুরের বৃত্তে তারা
নিজেদের জাগিয়েছে পৃথিবীর স্বতঃস্ফূর্ত তরঙ্গের সুরে।
নদী ও নক্ষত্রে অন্তরীক্ষের নিশ্চল বিন্দুতে পল্লীর দেহে
অসংখ্য স্বাদের সূচনার ছবি যারা এঁকেছিল; সেইদিন
তারা শুষ্ক রাত্রির শরীরে ফিরে ফিরে আসে। সপ্তর্ষির হিম
দগ্ধছায়া জন্ম ও মৃত্যুর দু - পাশের শান্ত নিঃসঙ্গ উষ্ণতা
P8
অনুভব করে কার্তিকের কাঙ্গালী আঁধারে মহামৃত্তিকার
দেহে উড়ে গিয়ে এক মাতৃচিহ্নের যুবতী উজ্জ্বল ধ্বনির
সচ্ছল ভেতরে কল্পতরুর জরায়ু গর্ভে জন্ম কথা ভাবে।
প্রস্তরখন্ড 2
অনিবার্য জন্মদাগ ভেসে যায় মানভুমের ঘনিষ্ট দেহে
জৈবিক সন্ধ্যার কান্নামাখা জলে। প্রতিশ্রুতিময় বেঁচে থাকা
ক্রমাগত ভেঙে ভেঙে যায় বহুদূর আকাশের মেঘদেশে।
খেজুর গাছের বুকে জ্যোৎস্না আসে অন্তিম বিশ্বের শব্দছুঁয়ে।
ব্যর্থতার মধ্যরাতে কুয়াশার মৃত জলকণা অন্ধকার
অস্তিত্বে ভাসতে ভাসতে প্রাচীন অশ্রুর ভেতর হেমন্তের
গান গায়। ব্যক্তিগত রাত্রের শূন্যতা ভেঙে আদিম সৃষ্টিতে
নিজেকে জাগায়। উৎসের প্রান্তর ঝরে যায় আদিম গহ্বরে।
বৃত্তের ভেতরে ডাহুক- ঝিঁঝিঁর ক্ষয়- মৃত্যু- বিরোধিতা; চিল
শকুনের দৃষ্টিতে বিপন্ন হয়ে দেখেছে তাদের উপকূলে
প্রকৃতির সীমাহীন বিপরীতে শুয়ে আছে অপদেবতারা।
বসন্ত শেষের শুকনো পলাশ মরে যায় বহু স্বাদ রেখে।
প্রাকৃত বীজের ভেতর নিহিত সুর পাহাড়ের মনে ঘোরে।
নিজস্ব রাত্রির গভীর তরঙ্গে শরীরের পাথুরে প্রকৃতি
চৈত্রের আলোর উজ্জ্বল রোদ্দুরে যেতে চেয়েছিলো একদিন।
বিশ্বাসের স্থির ভূমিতে নির্জনে রাঙ্গা মাটি— মায়াধুলো
হাতে নিয়ে বলে আহা এ আমার জন্মভূমি —দেহগর্ভে বাজে।
ভালোবেসে অঘ্রানের অপরূপ রূপে দেখে শিকড়ের মাটি।
নিরন্ন শিশুর ডাকে বিচ্ছিন্নের সকল যন্ত্রণা নেমে আসে
P10
উদাসীন সন্ধ্যার আকাশে। সূর্যের ডুবন্ত রূপ পড়ে থাকে
প্রান্তরের দেহে। সেইখানে ছায়ার ভেতর তারা চেয়ে থাকে
একমুঠো উচ্ছিষ্টের দিকে। বৃদ্ধ পৃথিবীর বিষন্ন গোধূলি
বারবার দিগন্ত আড়াল করে। স্নেহের সীমান্তে কাঁটাতার;
কে ঘুচাবে এই অন্ধকার! যদিও দধিচি অসংখ্য প্রদীপ
জ্বেলেছিল অস্থি মাংসে এই রূঢ় রুক্ষ মহাশূন্যের অতলে।
বাবলা কাঁটার ফাঁকে সুর্য ডোবা আলো মাটির নুড়িতে মেশে।
গেঁয়ো শেয়ালের ডাকে শব্দের মন্থন বুড়ি পুকুরের জলে
ভেসে গিয়ে শ্মশানসন্ধ্যার ঝোপে নিজস্ব মুদ্রায় মিশে যায়।
মৃত্যুর কুয়াশা স্বাদ জেগে থাকে তারই স্তব্ধ পাতার আড়ালে।
ধূসর ছায়ার অর্ধনারীশ্বর চিরস্থির শূন্যে চিরকাল
স্বাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। বাউল সুরের বাতাসে জন্মের গূঢ়
অভিমান বৃহৎ ভূখণ্ডে প্রাচীন সত্তার আদিস্রোতে আজো
ফিরে যেতে চায়। একদিন সাঁঝপাখি যজ্ঞিডুমুর গাছের
থেকে উড়ে গিয়ে দেববাতাসের শরীরে স্বচ্ছন্দে মিশে যেতো।
নদীর কিনারে ভাঙ্গা রৌদ্ররেখা আকন্দফুলের শবদেহে
নিজেকে জড়ায়। গোধূলির দামোদর ডাকে তার ধ্বনিজালে।
শীর্ণ পাতাগুলি বিকেলের বিবর্ণ জলের সঙ্গে কথা বলে।
পাতাহীন গাছের কঙ্কাল মুমূর্ষু জোড়ের ধারে পিতৃত্বের
প্রতিশব্দে দাঁড়িয়ে থেকেছে সময়ের চেতনার পরিনত
ইতিহাসে যেখানে জন্মের নাভি জন্মকে মঞ্জুর করেছিলো
একদিন। ফাল্গুনের আত্মা গণতান্ত্রিক রাতের অন্ধকারে
নীরবে বিকিয়ে গেছে পৃথিবীর গলিত শবের শেষদেশে।
ঘ্রাণহীন শীতল জীবন তবু পৃথিবীতে বয়ে আনে প্রেম।
দলমার ভূমিতলে সুবর্ণরেখার প্রতিধ্বনি খেলে যায়
P11
করোটি কঙ্কালে। বিগত হলুদ কোনো শতাব্দীর জন্মভ্রূণে
আদিম বিকার ছিলনা কোথাও। হাজারীবাগের একরোখা
বিমূর্ত সন্ধ্যার ছায়ায় পাখির সঙ্গীতে বিস্তীর্ণ মালভূমি
গভীর ঘুমের ভেতর স্মৃতি ও বিস্মৃতির স্বপ্নে জালাভর্তি
মহুয়ার গন্ধে নিজস্ব দ্বীপের সরল সভ্যতা গেঁথেছিলো
প্রজন্মের গায়ে। অন্ধকার জরায়ুর বলিরেখা ভেদ করে
আদি নাভিমূল থেকে উঠে আসে চায়বাসা -জীবন্ত স্তব্ধতা।
ক্ষয়িষ্ণু পাথর পরিচিত শিলাখন্ডে অসমাপ্ত পর্বসন্ধি
আজ দীর্ঘতম হাড় - ক্রমাগত তার দৃশ্যপট বদলায়।
শালবনে নদীর শরীরী শব্দ জৈন মন্দির চত্বরে ভাসে।
জলের অতলে স্থির তৃতীয় চোখের তীক্ষ্ণ পথে নদীতটে
শ্মশান সংলগ্ন গ্রামদেশ দেখেছিলো বিষন্ন চৈতন্যে ভরা
দেহ ও আত্মার দ্বন্দ্ব। মাঠের ফসলে তখনো মাতৃত্ব খেলে।
ঝর্নার ব্যথিত জল ঘিরে পাথুরে পাতার শালের জঙ্গলে
মুন্ডাদের অশ্রুত শব্দের দুঃখস্রোতে দামোদর বয়ে যায়।
সমূহ নদীতে সময়ের স্বরে পিতৃপুরুষের প্রেত কাঁদে।
রক্তের ভেতর ধুমল পাহাড় তারই তলে পলাশের মৃত
অরুণাভ প্রজাপতিফুল শুয়ে থাকে স্তব্ধ মাটির উপর ।
করতলে কার্তিকের হাহাকার কান্নার অদৃশ্য রক্তপাত
মৃত্যু আর অপমৃত্যুর নির্জন বেদনা ব্যাকুল করে যায়।
বাস্তুভূমি- ঘরবাড়ি, ফসলের মৃত মাঠ ক্ষুধিত নাভির
অনন্ত প্রান্তরে কাঙালী মায়ের অবিরত পরাভব দেখে।
আকাঙ্ক্ষার শাখা প্রশাখা স্রোতের বিপক্ষে নিশ্চল হয়ে যায়।
ধূসর যুগের অস্পষ্ট রহস্যময় স্পষ্ট ক্ষয় কুয়াশার
আদিম ভিতরে ক্রমাগত নিচু হয়ে ভেঙে পরে ভূখণ্ডের
P12
সত্তার শেকড়ে হিম অন্ধকারের বিবর্ণ শব্দের মতন।
ক্লেদাক্ত রক্তের উৎসমুখে চেতনার মধ্যরাতে সন্তানের
স্বাভাবিক জন্মে দেখেছিলো সচ্ছজলে আলোর কণিকা ভাসে।
শাদা জ্যোৎস্না ঘিরে তামাকের পোড়া গন্ধ ক্ষীণ অক্ষম নদীর
কুয়াশার ঝোপে জমে থাকে। গোপন অশ্রুর অতীত রাতের
জলে আজো শালগ্রামশিলা ভিজে আছে মাদল মেঘের কোলে।
পৃথিবীর প্রথম রাত্রির বুকে সৃষ্টির মরমী সুরে দীর্ঘ
স্নেহের আশ্রয়ে এই সাঁওতালি মাঠে বহু ফসল ফলেছে।
যন্ত্রণার নিঃস্ব রাতে দহনবেলার পশ্চিমের শান্তকথা
ছায়ামাখা প্রান্তরের প্রাচীন গল্পের ভাঙ্গা দেহে সেইলিপি
লেখা আছে। পাহাড়ের কোলে গোধূলি জননী বেদনার রাতে
জন্মবীজ ছড়িয়ে আদিম হেমন্ত রাত্রির পাতার মতন
সমগ্র সত্তায় নিজেকে ছড়ায় গেঁয়ো পৃথিবীর প্রত্নদেহে
যেখানে নক্ষত্র আলোর নিঃসঙ্গ কঙ্কাল গভীর রোদ্দুরের
সহজ দর্শনে বেঁচে থেকে জন্মের ঘনিষ্ট মুহূর্তকে ডাকে।
সময়ের জীবিত নিশ্বাস আত্মকথা পাখির পালকে উড়ে
গিয়ে অবেলার অবসাদ মুছে দেয় আলোজন্মের বিবরে।
বনচাঁড়ালের বনে বুড়ো শিমুলের ডালে মিহি সন্ধ্যা বসে;
তারই তলে জীবনের মরুভূমি নির্জন শ্মশানকলসির
জলে কাঁপে। শূন্যতার সকল মুহূর্ত অশ্বত্থের ডালে বসে
চিরন্তন অস্তিত্বের ব্রহ্মান্ডের রক্তজলে তার চিহ্ন খোঁজে।
হৃদয়ের অসংখ্য শুকনো শিরা উপশিরা বিমূর্ত মৃত্যুর
ছায়াময় সবুজ পাতার বীজরসে তার রূপ রেখে যায়।
মলিন আলোর বিবর্ণ জ্যোৎস্নায় রাখালের প্রাচীন ধুলোর
শব নিরুদ্দেশ হয়। কুয়াশার বিষন্ন মন্দিরে ফাল্গুনের
P13
নিবিড় শরীরে পূর্বপুরুষের নীল অন্ধকার বাঁশবন
থেকে উঠে এসে শ্মশান জোড়ের জল ছুঁয়ে আজো কথা বলে।
বিরহ ভূমির বেদনার নশ্বর সন্তান ফিরে ফিরে আসে
পাহাড়ি রোদ্দুরে তাদের আকাঙ্ক্ষা চৈত্রের চৈতন্য চেয়েছিলো।
ভাঙ্গা চন্ডিমণ্ডপের নিঝুম ধ্বংসের দৃশ্য ক্ষয়ে ক্ষয়ে কাঁদে।
ব্যক্তিগত দুঃখ গুলি ফেলে এসে তারা ঘর বাঁধে শরীরের
ঘ্রাণে। আত্মার সবুজ দ্বীপে পোয়াতি ধানের গর্ভে জেগে থেকে
পশ্চিম আকাশে সুদূরের কণ্ঠস্বরে শতাব্দীর আত্মীয়তা
খুঁজে এই ভূখণ্ডটুকুর শেষ টানে। অনেক ধ্বংসের পর
তারা জেগে আছে। অবসরের একান্ত দিনে ক্লান্তির চূড়ান্ত
ছায়া জীবনের যন্ত্রণা ছুঁয়েছে এই শুষ্ক শূন্য চরাচরে ।
বুড়ি কংসাবতীর ঘুমন্ত দেহে বজ্রভূমির নিঃসঙ্গ জলে
নিষাদের কান্নামাখা মুখ ভাসে। জন্মান্ধ পাখির অশ্রুস্মৃতি
একান্ত নিজস্ব পথে ঝরে; আজন্ম ঘুমিয়ে থাকা এই গ্রামে।
নৈঃশব্দ্য শব্দকে অতিক্রম করে আকাশের দিকে ছুটে যায়।
গভীর গহ্বরে অনন্ত রাত্রির দহন বিস্মিত স্নায়ুগ্রন্থি
জাগিয়ে প্রাকৃত ধুলোর প্রবাহে বহু জন্মের নিবিড় দাগ
রেখে উড়ে যেতে চেয়েছিলো। আত্মজের বুকে চিরকাল তারা
অঘ্রাণের ফসলের প্রতিশ্রুতি রেখে গেছে। আদি আষাঢ়ের
নীল কুয়াশার অন্ধকারে; বিপরীত স্রোতের অন্তরে শেষ
আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে অবিরল দিয়ে গেছে মাটিতে জন্মের স্বাদ।
নীহারিকাছিন্ন ভূখণ্ডের মায়াবী উষ্ণতা সময় সীমানা
পার হয়ে রক্তের অতল গহ্বরের ভিতরে স্থিরতা চেয়ে
পৃথিবীতে কোনো এক বিকল্প বোধের জন্ম দিতে গিয়ে আজো
দিনান্তে পায়ের ছাপ রেখে যায় মাটির মনের চেতনায়।
P14
মহাশূন্যে পৃথিবীর ঋণ রেখে ব্যথিত বিশ্বের জন্মজলে
তারা ফিরে আসে পাহাড়ি পথের বাঁকে হেমন্তের মাতৃত্বের
স্বাদ নিতে। অন্তহীন আত্মনিবেদনে মহাকালের অনন্ত
সত্তা ছুঁয়ে মরুগানে জন্মভূমির আদিম উৎসে ঘুমিয়েছে
প্রান্তিক পল্লীর বহু ঋতুর আঁধারে। হাহাকার বাতাসের
শোক মেখে পাষাণের দেশে নরকের শরীরের অপচ্ছায়া
তাদের জীবনে জীবনের অন্তিম অজ্ঞতা দিয়ে পৃথিবীতে
পীড়নের অভিজ্ঞতা গেঁথেছিলো বেদনার পার্থিব প্রদেশে।
তবু মরণের পরে স্বজনের শান্ত সংসারে ফিরতে চেয়ে
করোটির দগ্ধ কঙ্কাল বিশ্বাসে ভাসিয়েছে আদি দামোদরে।
স্বপ্নের ভিতরে শুয়ে থাকা শৈশব পাতায় পাতায় নির্জনে
নূপুরের শব্দ শোনে। মুরিনদীর শীতের স্রোত প্রতিরাতে
ইথারের মতো ভাসে। বিপুল শূন্যের উপর নক্ষত্র আলো
সহস্র সন্ধ্যার কথা বলে যায়। জ্যোৎস্না রাতে প্রাচীন পাথরে
মন্দিরের শিলালিপি সময়ের শেষচিহ্নে স্থির হতে চায়।
বিমূর্ত অস্তিত্বে মৃত্যুর দুঃসহ ধ্বনি সৃষ্টির সকল শর্তে
দুর্লভ আলোর দিকে নিজেকে নিক্ষিপ্ত করে পৃথিবীর ধুলো -
মাটি-স্রোতে -বেঁচে থেকে পুনরায় জীবনের অভিজ্ঞতা চায়।
দীর্ঘ অক্ষমতা রেখে তবু তারা ভেসে গেছে নিবিড় অন্তিমে।
চেতনার গূঢ় গ্রন্থি দেহাতীত প্রাণস্রোতে ব্যাকুলতা রেখে
নিঃশব্দে রাত্রির বিবর্তনে দামোদরের একান্ত অন্তরঙ্গ
অন্ধকার নদীজলে আকাঙ্ক্ষার আর্দ্র প্রতিবিম্ব রেখে যায়।
পৃথিবীর প্রাচীন হরফে, ধূ ধূ মাঠের মায়াবী বৃত্তে তারা
দেখেছিলো গৃহস্থের শালিক চড়ুই বহু ব্যর্থতার পর
আজো ব্রহ্মান্ডের স্বাদে বেঁচে আছে। পানকৌড়ি জলহাঁস খেলে
P15
পাকা ফসলের গন্ধে। পূষ্যানক্ষত্রের আলো কাঁসাই কুমারী
নদীজলে এলে টুসুগানে পৌষলক্ষী জাগে। কুমারী মনের
আকাঙ্ক্ষা অজলা মাটি থেকে দূর দিগন্তের ভোরে মিশে যায়।
লালমাটি মেঠোপথে পলাশের রাঙ্গাডাঙ্গা আজন্মের স্তব্ধ
অন্ধকারে একাকী বিচ্ছিন্ন হয়ে শেকড়ের শেষ আলোটুকু
ভিক্ষে করে নির্জন অস্পষ্টতার দিকে চলে যায় বহু দগ্ধ
ক্ষতের শূন্যতা নিয়ে।কালের বিষাদী ধ্বনি নিষাদের দেহে
অশ্রু পতনের ছবি আঁকে। তবু অশ্বনদী থেকে উঠে আসে
সূর্যপুত্র কর্ণ। জননীর বুকে এই দৃশ্য বহু রোদ্দুরের
পর আজো গাঢ় হয়ে আছে। সূর্যাস্তে পাখির কঙ্কাল অনার্য
পুকুরের জলে নিজের শাশ্বত মাটিগন্ধে এই ধূ ধূ হৃদয়ের
শিখরভূমিতে সন্তানের জন্ম দিয়েছে সৃষ্টির অফুরন্ত
জ্ঞানের বাতাসে। পাহাড়ি পাখির কোলাহলে নিজেকে নিজেই
স্পর্শ করে বারবার শূন্যতা ভেঙেছে আদিস্বরে বেঁচে থেকে।
তারপর প্রাচীন ছবির মতো নিজেকেই নিজে জাগিয়েছে।
অথৈ শূন্যতার সকল বাসনা মানুষের ঘ্রাণে চিরকাল
জেগে থাকে ক্ষয়ের ভেতর। যদিও দিনান্তে মাদলের শব্দে
একফালি রোদ বিষাদের মুখোমুখি শুয়ে থাকা সময়কে
জাগিয়েছে। অবিশ্রান্ত রক্তের আঘাতে শূন্য মালভূমি জুড়ে
তৃতীয় বিশ্বের নিঃস্ব জঠরে তিতির ডেকে যায়। শ্মশানের
অন্ধকারে পড়ে থাকে লক্ষীর উঠোন-পিপাসিত সন্ধ্যাদ্বীপ।
সমূহ স্মৃতির আলো জীবনের এমন নির্জন পরাভবে
আরো ক্ষয়ে যায় ক্ষয়ের গভীরে। শিলাখণ্ডে মানুষের সত্তা
সময়ের শিকড়ে শিরায় জন্মের নির্ভুল দিগন্তকে ছুঁয়ে
মাটির মেধাকে উর্বর করতে চেয়েছিলো। তাদের স্বপ্নের
P16
ভেতর কাঙ্ক্ষিত শীতার্ত নদীটি বয়ে যায়। মেঘমাখা মাঠ
ভরা ফসলের ক্ষেত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে বুকের গহ্বরে।
তবু মাঝরাতে কোনো এক দেবগন্ধ বাতাসকে ঘিরে রাখে।
হেমন্ত রাত্রির প্রাকৃত কল্লোল মাতৃমুখ অধিকার করে
আদি শূন্যতার কণ্ঠস্বরে ডেকে নেয় নিজের শিশুকে তার
মায়াবী আঁচলে। আধো অন্ধকারে ভাসমান অন্তিম শরীর
তারই অন্তরঙ্গ মায়াজালে আবার মেঘেরপাড়ে জেগে ওঠে।
বেদনার শুষ্কদেহে নাভিমূলের মরমী অধিকারে নদী
বৃক্ষলতা- ধানদূর্বা চেয়েছিলো তারা ম্লান দুঃখের রাত্রিতে।
সূর্যাস্তের গৈরিক সন্ধ্যায় দেশের নিহিত আদি সভ্যতার
ঘনিষ্ট সকালে ভাতের প্রাচীন প্রতিবিম্বটুকু বেঁচে থাকে।
ফুটিফাটা মাঠ-পোড়ো ঘর-বাঁশের ছাউনি- মহুয়ার বন
ছুঁয়ে হেঁটে যায় জলশূন্য নদীপথ। নীরবে একাকী তীব্র
শোকঅশ্রু এমন প্রান্তরে জন্মের সকল দৃশ্য দিনশেষে
গোধূলির দেশে ফসলের ছবি আঁকে। নৈঃশব্দ্যের বেদনায়
তবু পৃথিবীতে প্রাণ আসে আলোকিত প্রদেশের অপেক্ষায়।
পোয়াতি পদ্মের গন্ধে টের পায় হাড়ের ভেতর রাজপথে
অরণ্য ছড়িয়ে আছে। তারপর জেগে ওঠে নিজের শরীরী
তাপের বিশ্বাসে। রুক্ষ শুষ্ক পাথরের ভূমিকে অমর করে
জ্যোৎস্না রাতে। দূর দিগন্তের হাহাকার আশাহত চেতনার
মাটিকে উর্বর করে উদ্ভিদের ঘ্রাণে। ছায়াঘন রোদ্দুরের
করুন হৃদয়ে। দিকচিহ্নহীন শব্দময় ধুলোর আড়ালে
জৈন মন্দিরের নিথর ভাস্কর্য গুলি অবেলার রক্তস্রোতে
দেখেছে অজস্র অভিমান। বিবর্ণ অভ্যাসে স্মৃতি উড়ে যায়
তবু কোনো এক পরাস্ত সন্ধ্যার চেতনায় স্থবিরতা থেকে
P17
মানুষের মন চলে যায় অন্ধকারের অতীত ধারাভাষ্যে।
সেইখানে দিনলিপি সূর্যের পশ্চাৎপটে অজ্ঞাত তরঙ্গে
নিজেকে নিজেই অনুভব করে পৌঢ় হয়। মৃতের ফলকে
শান্ত হাত পাথরের সঙ্গে কথা বলে। জীবনের তীব্রতম
শোকে কুলহারা এই জনপদ জীবনকে নিলামে উঠিয়ে
অনর্গল ভেসে যায় চিতার ধোঁয়ায়। কৃষ্ণতম মৃত্যু পথে
তবুও আগুন রেখে যায় অসম্ভব অন্ধকারের শরীরে।
বিবর্তনে হিম ও রোদ্দুর শুধু অবসাদ এনেছিল ঘরে।
পৃথিবীর প্রত্নঘুম আজো মৃত পাখিদের শব ছুঁয়ে আছে।
নশ্বর শরীর সৃষ্টির উৎসাহে জেগে থেকে দেখেছিলো তার
বিচ্ছিন্ন জীবন শকুনের করতলে গাঢ় হয়ে বসে আছে।
চন্দ্রদগ্ধ চান্ডিলের পশ্চিম আকাশ সুবর্ণরেখার নগ্ন
নদীতটে নেমে এসে ফিরে ফিরে তার বেদনার হাতে তারই
নাভি উপত্যকা থেকে উঠে আসা ডানাভাঙ্গা অন্ধ প্রান্তরের
প্রান্তিক মানুষদের ডাকে। সেদিন নির্জন রাত্রির জননী
কাঁদে একাকিনী। অন্ধ মেঘস্মৃতি থেকে নেমে আসে যন্ত্রণার
কন্নামাখা বহু মুখ। আমাদের ভাঙ্গা গ্রাম যাবতীয় দুঃখে
বেঁচে থেকে তার অক্ষম নদীর জলের ধূসর বাতাসের
শব্দে কবন্ধ আঁধারে আমাকে একাকী অনর্গল বিদ্ধ করে।
পাহাড়ের অন্ধকোলে ছন্নছাড়া রাখাল আমার নিরুদ্দেশ
অন্তিম প্রাণের কাছে ছুটে যেতে চায় আর প্রতিটি জন্মের
জন্মকথা দিগন্তে নির্মাণ করে এক নির্ভুল সত্যের উষ্ণ
P18
ছায়াপথে নিয়ে যায়। ক্রৌঞ্চ পুষ্কর শাল্মলী সপ্তদ্বীপ ঘুরে
সবশেষে দামোদরে আমার শীতার্ত অস্থি মাংসের বৈরাগ্য
আসে। গোধূলি ধুলোটে সেইদিন এই মাধুকরী জীবনের
স্মৃতিকথা প্রশ্নচিহ্ন শরীরী বৃক্ষের থেকে আদিম রাত্রির
পাতার মতন ঝরেছিলো। নিষাদের খামার গোয়ালঘর
বুকে বাজে। মানভুমের অতীত জলের ছড়ানো বৃষ্টিদেশে
আমি ভেসে আছি, বাপ ঠাকুরদাদার রুক্ষ মাটি ভালোবেসে।
সভ্যতার গভীর শিকড়ে দেখেছি রাত্রির ক্লান্ত জলবিন্দু
দু-চোখ ঢেকেছে। দুঃখিত পাহাড়তলে কাদামেখে বীজধান
যারা পুঁতেছিলো রুক্ষ মাটিতে অনেক আষাঢ়ের শেষে তারা
ঘরে ফিরে দেখে অঘ্রানে ধানের গোলা গোধূলির সুপ্রাচীন
অশ্রু ছুঁয়ে আছে। সেদিনের কষ্টকথা রক্তে নূপুরের মতো
বেজেছে- মায়ের হৃদয়ের নিটোল কঙ্কালে। পায়রার দল
উঠোনের সিথানে কেঁদেছে। বিগত শৈশব নির্জন খামারে
চেয়ে থাকে দেহাতীত স্বপ্নে। কুর্মী শবরীর দেশে জাতিস্মর
বেঁচে আছে নিজস্ব ছৌ-শিল্পে আঁকড় বৈচির দেশে। ধানরুয়া
শেষ হলে বর্গা চাষী গান গেয়ে বিড়ি বাঁধে। সদরে অন্দরে
গাঢ় বিশৃঙ্খলা ভুল পথে ভাসিয়েছে শুকনো খরের চালা;
তবু ঋতু বদলের দিনে পুড়ো ভিটেজমি বহু ভালোবেসে
আঁকড়ে ধরেছে শিকড়ের মাটি। পাথর পড়ানো রোদ্দুরের
গ্রামে বীজ বুনে অনার্য রমণী। জনশূন্য টিলার জঙ্গলে
আদিম বসুধা ভাদ্রের ভিতর কৃষ্ণাষ্টমী রাতে পৌরাণিক
পৃথিবীর ভগ্নস্তূপ থেকে গগনচারীর সঙ্গে কথা বলে।
শোকের দুচোখে দেখেছি অনেক ক্ষত জমে আছে আর্কিয়ান
শিলাস্তরে— ঘুমভাঙ্গা নদীর দু-কুলে শ্মশানের অবিরল
P19
কান্না- শান্ত কলরোলে লাচনীর জীবনের ঝুমুর বেজেছে।
ইতিহাস জাগিয়ে সেখানে প্রাকৃত রাত্রির সময় কেঁদেছে।
মেঘভাঙ্গা দুঃখে ভেসে গেছে তার মহুয়ার অনন্ত রোদ্দুর।
দিকচিহ্নহীনপুরে আজো রুক্ষভূমে তার রক্তচিতা জ্বলে।
চিরন্তন শালের জঙ্গলে— যতদূর চোখ যায়- মহাবনে
দেখেছি অনেক পরাজিত মানুষের মুখ পৃথিবীতে ভিড়
করে আছে। নিবিষ্ট শিকড়ে বিষন্ন হাড়ের ব্যথা অবিরত
দুঃস্বপ্নের অন্তর্গত অন্ধকারে শব্দহীন স্থির জেগে আছে।
পাহাড়ের জনপদে বুদ্ধপূর্ণিমার দীর্ঘ রাতে অস্তিত্বের
অভিজ্ঞতা - রূপকথাকাহিনীতে শিকারির বুকে বেঁচে আছে।
বজ্রভূমে আমার অনার্য করতলে আদিম ঈশ্বর কাঁদে।
P -1
প্রস্তরখন্ড ৩
টিলার কাঁকালে জ্যোৎস্না কাঁপে; প্রাচীন আত্মার বিমূর্ত বিষাদ
প্রেতের মতন হাসে- তবু সেই বিস্মৃত আলোতে তিলাবনী
দ্বারিকা ধারার জন্ম দিয়েছিলো চিত্রিত প্রদেশে জীবনের
স্বতস্ফূর্ত ইসারার জন্মাবেগে। প্রান্তরের ভেতরে এখনো
কাদের ছায়ারা কাঁদে! জানিনা কাদের জন্ম অভিমান মাটি
ফুঁড়ে মেশে আমার সৃষ্টির বিস্তৃত রক্তের তরঙ্গের দেহে।
তাদের মিলিত সমবেত গানের বাতাসে আকালের দগ্ধ
ক্ষুধিত খুলির কালের কান্নার দীর্ণ ধ্বনি নিঃশব্দে শুনেছি।
পৃথিবীতে এইভাবে নিরাশার শবদেহে মৃত্যুফুল ফুটে
আছে, সভ্যতার সুগভীর আবরণে ঘুমের চন্দন বনে।
স্তম্ভিত ব্যাকুল জীবনের আবেদন চিরকাল ভেসে গেছে
নিথর নদীর অন্ধকার জলে। তারই রক্তের নিষ্ঠুর দাগ
হেমন্তের দেহে শস্যের প্রার্থনা জানিয়ে অতীত শ্মশানের
দেহে পুড়ে গেছে আমাদেরই কোনো এক নক্ষত্রকে স্বাক্ষী রেখে।
উজ্জ্বল আলোয় জলের সন্তান আসে নিরপেক্ষ পিতৃধামে।
যুবকেরা যুবতীর হাত ধরে পৃথিবীর গন্ধে ভ্রূণ আনে।
সন্তানের পিতা বারবার ভূখণ্ডের অধিকার দিয়ে গেছে
তার আত্মজকে। তবু খড়ের চালের নিচে সরীসৃপ জেগে
থেকে জন্মভূমির মাটির আঙিনাকে সুর্যাস্তে নিশ্চিহ্ন করে।
অবিচল অশ্বত্থের শাখা প্রশাখা পাখির ডাকে নিরন্তর
উদ্বেল হয়েছে শান্ত অঘ্রান রাত্রির হৃদয়ের খুব কাছে ।
স্মরণীয় সমস্ত বিশ্বাস অনাথ শস্যের মাঠ থেকে ডেকে
P -2
বলে গেছে দুঃখের দুয়ার থেকে তুমি কতদূর যেতে চাও!
আমরা তো তারই সহোদর। সাঁওতালি মেয়েটির সন্ধ্যারাত
দেখেছো কি তুমি! তবে কেন যাও আত্মহননের অন্ধকার
প্রান্তরের অন্তহীন পথে! শোকের শব্দেরা মৃত্যুকে ডিঙিয়ে
একদিন ফলবতী হবে তোমারই জ্যোৎস্নার ভাঙ্গা চাষমাঠে।
সময়ের অবিকল দৃশ্য পৃথিবীতে কবে আর বারবার
থমকে থেকেছে! শকুনের পাখসাট মানুষের ধমনীতে
হাড়ে হাড়ে অভ্যন্তরে লীন হয়ে ডেকে গেছে তবু পলাশের
অরুণাভ ফুল বসন্তের মাটিতে মুখের সুন্দর আদল
এঁকে দিয়ে যায়— জ্যোৎস্নার বিশীর্ণ নদী জোড় আমাদের ঘিরে
রাখে তার সংসারের গভীর প্রবাহে যেখানে স্রোতের গায়ে
অন্তরীক্ষ হতে নক্ষত্র নদীর ডাকে পৌঁছে যায় ক্লান্তিহর
চিরস্থীর শূন্যের মরমী মাতৃকুলের উৎসের প্রিয়গর্ভে।
বাস্তুহারা কৃষি জাতকের রক্তরেখা বটপাকুড়ের মাঠে
রমনের নির্জন ছাউনিটুকু চেয়ে ফিরে গেছে স্বরচিত
সমাজের পোড়া মাটি দেহের শ্মশানে— সেই হাড়হাভাতের
গোলপাতা, খড়ের ছাউনি সেসব মনে কি পড়েনা তোমার!
আমরা ক্রমশ সময়ের শান্তির ব্যাপ্তির দিকে হেঁটে যায়।
মহাকালে রৌদ্রলোক একাকী দাঁড়িয়ে আছে, নদীর বিনম্র
পলি, ফসলের সহজ পল্লীতে সুস্থির জ্যোৎস্নায় আমাদের
হাতে পৃথিবীর পরমান্ন তুলে দিতে তার অন্তিম সৌন্দর্যে।
আহা দেখো ওই বৃক্ষে মায়াবী পাখির কলতান শব্দহীন
পাথরের গায়ে লেগে ধ্বনিত হয়েছে বিশ্ব সৃষ্টির স্বভাবে—
মনেপড়ে এখানে অরণ্য বীজ পড়েছিলো এক দুপুরের
P 3
পুরানো মাটির ছায়ার হৃদয়ে? আরোগ্যের অদৃশ্য সান্ত্বনা
পেয়েছি আমরা বহু গাঢ় রাত্রির নিপুণ সুরের রহস্যে।
বেদনার মহৎ চিন্তারা বোধের ভেতর কালের চেতনা
দিয়ে গেছে আমাদের মনে পৃথিবীর নগ্ন দুঃখের বিস্ময়ে।
সূর্যাস্তে নিজের মৃত মুখ দেখে ভেবেছি শ্মশানবুড়ি তার
নদীচরে শীতল সত্যের কাছে বসে আছে আসশ্যাওড়ার
গভীর শরীরে যেখানে রহস্য বহু শতাব্দীর অন্ধকার
ভেঙ্গে শুনিয়েছে প্রাকৃত প্রবাহে স্থায়ী আশ্রয়ের কোনো চিহ্ন
নেই তবু মানুষের মনে সংঘের সংশয় জেগে থাকে স্রোতে।
রূপাই নদীর বুকে চাঁদ ভাসে, তীরের অদূরে বাঁশবন
নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে- তার ছায়া জলে পড়ে- বুঝেছি পৃথিবী
প্রতিক্ষণে অন্তঃসত্বা হয়। এই বয়ে যাওয়ার ভেতর রয়ে
গেছে আমাদেরই কঙ্কালের ইতিহাস— বলে যায় পৃথিবীর
মরমী জলকে নিজের মতন করে ভালোবেসে চলে যেতে।
গোধূলি কল্লোলে জলরেখাগুলি ফসলের মাঠে জেগে থেকে
জেনেছে চিহ্নিত হতাশার প্রতিচ্ছবি তার প্রত্ন পদচ্ছাপ
কিছুকাল মানুষের দেহে রেখে যায় জীবনের বিপরীতে
নির্জন দহনে মানুষের হৃদয়ের মাটিকে জাগাবে বলে।
জীবন বোধের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থেকেছে বহুমুখী রূঢ়
আকাঙ্ক্ষার জলছবি। চেতনার অন্তঃস্থলে অনুভবে দগ্ধ
আত্মক্ষয় থেকে গেলে আমরা বুঝেছি জগতের দেহজলে
পড়ে থাকে আমাদের জীবনের ঋণ। গৈরিক গোধূলি তার
শান্ত স্বরে জ্যোৎস্নাগানে বলে যায় বিমূর্তের অন্ধকারে আরো
P 4
এক জ্ঞান স্থানের সময়ে অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা হয়ে আছে
যেখানে তরঙ্গদেহ মাতৃগর্ভের সকল নির্মানের মূল
নির্দিষ্ট সত্যকে জানে, যা অস্থিরতার বীজে স্থিরতা এনেছে।
মন্দিরের ছায়াচ্ছন্ন মুখশ্রী স্মরণে আসে; পাথরের দেশে
পিতার স্নেহের মতো বটের করুণ ঝুরি মাথার উপর
নেমে আসে তার অক্ষমতা নিয়ে; তবু ঢেকে রাখে বৈশাখের
রোদ্দুরের দুঃসাহস পাতা বীজের আঁধারে। পার্বত্য প্রহরে
বেঁচে থাকে আমাদের অবশিষ্ট বেঁচে থাকা শুষ্ক আঁকাবাঁকা
আলপথে। অন্ধকার থেকে গন্তব্যের দিকে হেঁটে যেতে চায়
পাথুরে খিলানগুলি; আমাদের হারিয়ে যাওয়ার ব্যবধান
ক্রমাগত বেড়ে যায় সময়ের মহাবনে। স্তব্ধ মরুরাত
শতাব্দীর অনেক মুহূর্ত পেরিয়ে আবার গন্ডোয়ানা যুগে
ফিরে এসে সমযাত্রীদের রাজপথে নিজেকে দেখেছে, শান্ত
অনন্তের মহাকাল আজন্ম সন্ধির স্বাক্ষরে খাদ্যের কথা
লিখে গেছে। তবুও এখন ফসলের মাঠে রক্তাক্ত শরীর
পড়ে থাকে আরো কোনো এক চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে গেঁথে দিতে।
কল্লোলিত শিশিরের গান নির্জন পাহাড়ে একাকী মরেছে
ঘুরে অন্ধকার চতুর্দশী টেনে এনে। অনর্গল নৈঃশব্দ্যের
মধ্যে আত্মাস্থিত বেদনায় ছৌ এর মুখোশে শিল্পকে বেঁধেছে।
সেদিন সন্ধ্যার মোহময় মেঘ পাহাড়চূড়ার মরুদেশ
থেকে নেমে এসে তার প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর পথে চলে
যেতে চেয়েছিলো অতলের তলে যেখানে বোধের বিন্দু চেয়ে
থাকে উৎসে—জন্মের নিবিড় দাগে ঘুমন্ত মায়ের মুখ ভাসে
নিরন্তর। মৃত্যুমুখী সকল ক্ষতের ভেতর ছড়িয়ে থাকে
অভিসারী মন। মৃত আঁধারে আত্মীয়দের মৃদু হাত ডাকে;
P 5
পরিস্রুত বেদনায় উদাসীন হয়ে অনুভব করে তীব্র
সময় প্রবাহ জীবনে যে বিবর্তন দিতে চেয়েছিলো -তার
সেই সব অরণ্য পাহাড়ে স্বাভাবিক অধিকার অন্য কেউ
সম্মিলিত ভাবে নিয়ে গেছে- অস্তিত্বকে ছিঁড়ে নিজেকে যথেষ্ট
সাবলীল করার সহজ পথে। মাটির ভেতর মাটি হয়ে
থেকে যায় পাতাকুড়ানির ঘর মধ্যরাত পুরানো সংসার।
প্রাচীন মন্দির থেকে উঠে আসে গাজনের ঘ্রাণ- বটতলা—
পথের দুপাশে বনতুলসীর ঝোঁপ নিজস্ব ধর্মের ভারে
বহুচেনা এইসব গাছ সক্ষম ভঙ্গিতে আজো চেয়ে থাকে।
সূর্যাস্তে নিজেই নিজেকে দেখেছি ধ্বংস ও ক্ষয়ের পর আমি
জেগে আছি এক গোপন চৈতন্যে যেখানে নির্জনে শৈলসানু,
পাখিপুরাণের জ্যোৎস্নানদী, মহাবিশ্বের জঠরে খেলা করে।
দেখছি অতীশ শ্রীজ্ঞান নীরবে পণ্যের মতন চলে যায়
কাল থেকে মহাকালে সমষ্টির স্রোতে জন্মের আগে ও পরে।
বিগত জন্মের প্রত্ন রোদ্দুরে দেখেছে তারা পিতৃপুরুষের
ক্ষয়িষ্ণু কঙ্কাল আজো কাঁদে জ্যোৎস্নার কাঙালী আলোর শরীরে।
পাথরখন্ডের সন্ধ্যাভাষা আদি বিশ্বের মূলের দিকে টানে
যেখানে আদিম তৃষ্ণার নির্জন চর সহজেই আরণ্যক
পৃথিবীর আত্মার সংসার পেয়েছিল ঘুমন্ত দেহের দেশে।
আলোকঋতুর অবিনশ্বর ছায়ার কথা জেনে নিজেদের
বহমান প্রাণে প্রতিভা খুঁজেছে জন্মের জটিলতম ক্ষণে।
গ্রামের পথের পাথরের গায়ে কৃষ্ণদ্বাদশীর চাঁদ কাঁপে
তারই মাঝে আঘাতে আঘাতে জীবন ভেসেছে ক্ষুধার জ্বালায়
মৃত্যুময় অন্ধকারে। মরুগুল্মের মতন অভিজ্ঞতা নিয়ে
সন্তপ্ত অস্তিত্বে বেঁচে থেকে জীবনের সার্থকতা খুঁজেছিলো
P 6
প্রান্তরের এই জনপদ। অনুষ্ণ আদিম চেতনা আসন্ন
দিনের মৃত্যুর ছায়া তীব্র শোকে ঘুমের গভীর থেকে উঠে
এসে দেখে তারা ক্রমাগত পিপাসায় পরাজয়ে বৃত্তাকার
পথে ঘুরে ঘুরে ক্ষয়ে গেছে। প্রাক্তন দেহাতি পৃথিবীর এক
ভৌতিক জ্যোৎস্নার সংক্ষিপ্ত সময়ে শেকড়ের দৃঢ় ইশারার
অভিজ্ঞানে অসহায় গৃহস্থের আদিরূপে তাকিয়ে রয়েছে।
এইভাবে অনার্য মাটির নির্মল সত্তার ধুলোর ভেতরে
হৃদয়ের লেনদেনে আজো শান্ত সুগভীর স্নায়ুর অন্তরে
পোয়াতি গ্রামের স্বপ্ন দেখে। সুদূরের সময়ের অবিরল
ইতিহাস শতাব্দীর বহু ধ্বংসের শরীরে ফিরে ফিরে আসে।
তবুও সুতীব্র বেদনা উৎসের ক্ষুধিত অন্তরে বারবার
বিকশিত হয় এক অখন্ড বিশ্বাসে আর একাকী ব্যথার
দিনে জেগে ওঠে পাথরের বুক ভেঙে মাটির দুর্লভ গর্ভে।
অন্ধ বাউলের মতো দিনশেষের দিগন্তে খুঁজেছে সৃষ্টির
সেই অভিজ্ঞান যেখানে রাত্রির অন্ধ মন্দিরে মানুষ আজো
প্রসন্নতা ভিক্ষা করে, মৃত বিস্মৃত শতাব্দী জাগিয়ে দেখেছে
বেদনার নিজস্ব আগুন পৃথিবীর প্রথম রাত্রির বুকে
ফিরে যেতে চায়। সকল দুঃখের মাঝে বিপন্ন সন্ধ্যার তীব্র
দহনে শূন্যতা ভেঙে রোদ্দুরের নরম প্রশ্রয় চেয়েছিলো।
নদীতটে সভ্যতার মুখরতা অপচয়ে ম্লান হয়ে এলে
নিজেকে নিলামে তোলে— তারপর নিঃসঙ্গ প্রাণের ব্যর্থতার
ফল অনুভবে বুঝেছে দুঃখিত মৈথুনের পর আত্মজের
যে করুণ জন্ম দিয়ে গেছে তারা সংকটের নীরব মুহূর্তে
বারবার একমুঠো ক্লান্ত ছাই হয়ে উড়ে গেছে সেইসব।
P 7
শোকের অন্তরে তাদের প্রাণের ক্ষুধিত কঙ্কাল বস্তুবিশ্বে
তাদের অতীত বিশ্লেষণ করে বুঝেছিলো আজকের পথে
মানুষের হৃদয়ের সকল গহবর সকলের হৃদয়ের
নিজস্ব দুঃখের গহবর ছিলোনা কোনোদিন। প্রান্তরের নিঃস্ব
বিস্তৃত মাঠের অন্ধকার সেই কথা বলে যায়। জীবনের
অস্থির ব্যথার দিনে অসচ্ছলতায় কেন তবে পৃথিবীতে
নরকের আর্তনাদে পণ্য হয়েছি আমরা একে অপরের
কাছে সুচতুর ভাবে একই স্বাদের মাটিতে— দু-হাতে অনেক
অন্ধকার ঘেঁটে করতলে পেয়েছি শরীরী উষ্ণতার বীজ।
ঘুমন্ত বৃক্ষের পাতারা মাটিতে দিগন্ত পোড়ার শব্দ শোনে
শরীরের প্রতিকৃতি শুভ আকাঙ্ক্ষায় শুয়ে আছে হৃদয়ের
এক কোণে। ফসলের হলুদ সন্তান বিমূর্ত মুহূর্তগুলি
স্পর্শ করে জেনেছিলো নিঃশব্দে দু - হাতে গ্রামের শূন্যতা ভরে
দিলে অনন্তের অন্তরে উজ্জ্বল স্নেহের স্বাক্ষর রয়ে গেছে
জীবনের যন্ত্রণার প্রাকৃত বসন্তে—সেইখানে নীরবতা
পাথুরে প্রকৃতি ভেঙে মুখরতা পায়। আকাশের রৌদ্ররসে
বৃদ্ধের দু - চোখ অনুভব করে পার্থিব রুক্ষতা চিরে দেখে
নির্জন পাহাড়ি বটের শিকড়ে শাখায় সে জেগে আছে মূলে
বহুকাল নিঃসীম প্রবাহে— একদিন সে নির্মিত হয়েছিলো
নক্ষত্র ধুলোর লেনদেনে। অশরীরী আত্মার মতন তারা
আজো ঝরে রাঙ্গামাটির কদমতলে। ঘর বাড়ি হাঁড়ি ঘট
ভাঙ্গা প্রত্নস্তূপ থেকে থেঁতলানো কঙ্কালে জীবাশ্মে সুলগ্নের
প্রেমজাত প্রিয়জনের শীতল অভিযোগে আজ তার মৌন
অভিযান সমূহ জ্যোৎস্নার শালবন জুড়ে— হাহাকার থেকে
P 8
শর্বরী জন্মের পাষাণ প্রতিমা তার নিঃস্ব শিরদাঁড়াটুকু
নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে আপন ছায়ার অন্ধকারে ফাল্গুনের
শাণিত শীতল পাথরের চিরস্থির রামগড়ের জঙ্গলে
জলহীন তরুতলে পাতারা কেঁপেছে মাথার শিয়রে ঝর্না
তার জলশঙ্খে অসংখ্য নদীর জন্ম দিয়ে জন্ম বেদনায়
হিম সূর্যাস্তের সকল সময় তার অছিন্ন সন্তানদের
কাছে পেতে চেয়েছিলো আজ সেখানে পাখিরা অজ্ঞাত আড়ালে
করুণ নিশ্বর হয়ে কোথাও হয়তো বেঁচে আছে শব্দহীন
রক্তস্রোতে একাকী বিষন্ন সময়ের অর্জুন শালের দেহে।
চিরন্তন মেঘ অবিশ্রাম ঘুরে ঘুরে এখানের মুহ্যমান
হিম মরুরাতে অন্ধকার শুষ্ক বাতাসের দীর্ঘ কান্না শুনে
বুঝেছিলো পাথরের হৃদয়ের নূপুরের শব্দে বারবার
সাঁওতালপরগণা উপজাত হয়ে আদি শিলাগন্ধস্রোতে
ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে থেকে তারই আশা নিরাশার অন্তহীন খেদে
বিদীর্ণ করেছে বনভূমি। উঁচু নিচু চড়ায়- উৎরায় স্বাক্ষী
হয়ে রয়ে গেছে তাদেরই প্রাণের অপজীর্ণ স্বেদ অস্থি মাংসে।
পৃথিবীতে মানুষ তাদের জন্মের প্রণয়ে জন্মকে স্বার্থক
করতে রাষ্ট্রের বিপ্লবে নিজেকে যুক্ত করে তার পরবর্তী
প্রজন্মের হাতে জীবনের বহু স্বাদ দিতে গিয়ে দেখেছিলো
ক্ষণিক স্ফুলিঙ্গে বিরসা অনেককাল তাদের বাঁচিয়ে রেখে
বুঝিয়ে গিয়েছে প্রতিযুদ্ধের মাধ্যমে বিপ্লবের জন্ম দিয়ে
সন্তানের সুযোগ্য জন্মের শরীরে কালের ঋণ পরিশোধ
করে পৃথিবীর পরিচিত প্রতিবিম্ব নিজের দুয়ারে টেনে
না নিলে প্রাণের প্রচ্ছন্ন চিহ্নের স্বাদ ক্রমাগত আকাঙ্ক্ষার
P 9
আবহমানের দৃশ্য তার নিশ্চিহ্নের দিকে চলে যেতে থাকে।
উৎসবের দগ্ধ দিনে এখানে দুঃখিত জন্মভূমি পঞ্চকোট
রাজসভা পাষাণের নগ্ন প্রতিধ্বনি শোনে। উঁচু নিচু টিলা
বনটিয়া আজ প্রাসাদে প্রাচীন প্রত্নঘ্রাণ নিয়ে টের পায়
ছলছল জলস্রোত ছিলো কোনো একদিন। অধরা ঝুমুর
ভাদু টুসু ধামসা মাদল আড়বাঁশি নিজেকে উজাড় করে
মাতৃমূলে গেঁথে আছে বহু বিস্মৃত পোয়াতি গাঁয়ের বীজের
গভীরে অলক্ষ্যে যেখানে বুকের অতলে প্রাকৃত ইতিহাস
নতজানু হয়ে আছে নরকের মেধাহীন মস্তিষ্কের গর্ভে।
তবুও নতুন আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিতে চেয়ে নির্জনে ভেঙেছে
ধ্বংসের দিনের স্থবিরতা। পাহাড়ি ডুংরির উপল আকীর্ণ
পথে প্রাকপ্রত্নে নিহিত সত্যের হাহাকার প্রত্যাশার জন্ম
দিলে, মৃত্যু মৃত্যুহীন হয়— সূর্যাস্তের গৈরিক গোধূলি সেই
কণ্ঠস্বর জানে— জানে শিকড়ে শিরায় আদিম বৃক্ষের জন্ম
মৃত্যু শেষ ক্ষয় আর ঝুরিনামা রহস্যের নিবিড় সন্ধান।
রাত্রির আতুর গন্ধ দিগন্ত রেখার থেকে নেমে শতখাতে
বয়ে গিয়ে চেতনার রক্তাক্ত শরীরে পার্থিব জন্মের ঘাসে
শ্মশানচুল্লির দগ্ধ অঙ্গার মাটিতে প্রশ্নচিহ্ন রেখে গেছে।
সেঁজুতির আলো নিভে গেছে তবু দুঃস্বপ্নের নদী থেকে উঠে
এসে নাভিকুন্ডে মহাকালের পায়ের ছাপ দেখে আলোকিত
মায়াসুরে ফিরে ফিরে এসেছে বিশ্বের বিস্তৃত বেদনা ছুঁয়ে।
পলাশের বন অন্তিম প্রান্তর অরুণাভ করে চলে যায়
বসন্তের শেষে— অজস্র উড়ন্ত বনটিয়ার সবুজ ঝাঁক
ঈশ্বরপুত্রের দিকে চেয়ে থেকে দেখে জরা মরণের ডাক
P 10
অস্তিত্বের আদি স্বরলিপি মৃত্তিকা জন্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে
আছে। সংঘবদ্ধ মৃত্যুকান্না প্রাগৈতিহাসিক পুকুরের জলে
ধ্বনিত হয়েছে নিরবধি কাল সময়গ্রন্থিকে সাথে নিয়ে।
প্রত্ন অতীতের চৌখুপি দেউল মৃত্যুগন্ধ— ঋজুপালিকার
তটে শালবৃক্ষের মহৎ আকাশতরঙ্গ বাঁচিয়ে রেখেছে
আদিস্বরে একা একা নিজেকে জ্বালিয়ে জলচক্রের আদিম
পুনরাবর্তনে; একদিন যেখানে একাকী প্রাক-মুন্ডা জন
তাদের দেহজ উত্তাপে নির্ঘুম প্রোটো-মেডিটেরেনীয় ক্ষুদ্র
আগুনের জলছবি টেনে এনেছিলো এখানের ভূখণ্ডের
উঠোনের মাটি চুমে জীবনের অনন্ত রক্তিম স্বপ্নসুরে।
এখানে এখন স্মৃতির নির্বাক আকাঙ্ক্ষারা সন্ধ্যার দুঃখিত
মাঠে জেগে থেকে পৌষের প্রচ্ছদে আলপথ শস্যক্ষেত আঁকে।
অরণ্যের পরপারে জন্ম ও মৃত্যুর সংঘাতে শীতের সন্ধ্যা
কেটে যায় শাল মহুয়ার রুক্ষ গাঁয়ে তবুও আশার গভীরে
বেঁচে থাকে নক্ষত্রের নদীজল। ক্ষয়ের গভীরে রয়ে যায়
পৃথিবীর ব্যাপক বিস্তৃতি আর নিঃশব্দে যুদ্ধের বজ্রচিহ্ন।
বিষাদের দেশ মোহময় অন্ধকারে মানুষের মন বিদ্ধ
করে চিরকাল বিষন্ন মাটির করোটির ভিতরে মৃত্যুর
ধ্বনি ভাসিয়েছে। চূড়ান্ত দুঃখের দিনে অরণ্যের কিছু ভাঙ্গা
কোলাহল প্রাণের প্রগাঢ় কথায় তাদের জন্মস্রোতে মিশে
গিয়ে দেখে চিরকাল মানুষের প্রতিভার মেঘ ভেঙে দিয়ে
গেছে করতলে একমুঠো সংহত বিশ্বাস। অতীতের এই
আপৃথিবী ভাঙনের কথা মানুষকে একাকী অচেনা করে
গেছে। নিষাদের দেহ ছুঁয়ে তারই ধূসর ইশারা জেগে থাকে।
P11
লোধ্ররেনুময় সন্ধ্যার অন্তিম আকাশ সৃষ্টির নৈঃশব্দ্যের
মর্মমন্ত্রকথা শান্তভাবে নিজস্ব অভ্যাসে প্রাগৈতিহাসিক
বৃত্তপথে ক্রমশ আত্মস্থ করে সূর্যাস্তের অন্ধকার নিয়ে
দৃঢ় নিঃস্বতার সুরকে বিশীর্ণ হৃদয়ে উৎকীর্ণ করে তারা
জেনেছিলো শরীরী স্রোতের মধ্যে নদীর দহনে বেঁচে আছে
পৃথিবীর সমূহ পথের প্রসারণ। শূন্য দিগন্তের থেকে
তারা দেখে অন্তহীন এক মৃন্ময়ী রূপাঙ্গ অরণ্যদেবীর
বীজের ভেতর নিজেকে কালের মহাক্ষেত্রে ছায়ার আঙ্গিকে
গোপনে রেখেছে। বিমূর্ত বিভঙ্গে ক্ষতচিহ্নগুলি ছায়াহীন
ছায়ার ভেতর এইভাবে রয়ে গিয়ে অজ্ঞাত জীবন থেকে
ক্ষরিত মৃত্যুর অভিজ্ঞতা তাদের উৎসের দিকে নিয়ে যায়।
পুনর্জন্মময় প্রার্থনার পরিসরে দেহাতীত প্রতিবিম্বে
দেখেছি প্রতিটি অনন্ত পথের রেখা অসম্পূর্ণ হয়ে আছে
যেখানে রোগা ও রুগ্ন শিশুর স্বপ্নের হাত ধানের মঞ্জুরি
ছুঁয়ে আকস্মিক জেগে ওঠে। নিজস্ব দু-হাতে সূর্যের সৌভাগ্য
তবু তুলে নিতে চেয়েছিলো শৈশবের প্রোটো-অস্ট্রোলয়েডরা।
অন্তর্গূঢ় বেদনার গোধূলিলগ্নের পুরোনো গুহার গাঢ়
শ্যাওলার স্মৃতির বিস্ময়ে তখনও নেগ্রিটো জীবন তার
কৃষ্ণাঙ্গের শক্ত গ্রীবার চোয়ালে মুখে শঙ্খের মতন তীব্র
ভাষা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে স্থলচেতনার ফসলের ক্ষেত
ভালোবেসে। বিরতি বিহীন এক ইশারায় অজস্র কোষের
সৃষ্টির সহস্র স্পন্দন মাটিতে মহাজীবনের স্বাদে গেঁথে
যাচ্ছিলো নিজেকে ক্রমাগত প্রসারণশীল ঘন মহাবিশ্বে।
P12
হারানো সন্ধ্যার বুলবুলি নাচ আজ প্রথম সৃষ্টির মতো
কাছে আসে। কৃষ্ণের মুরলি ডাকে সখী শ্রীরাধা আসরে আসে।
জন্ম পুরাণের পথে জীর্ণ পাতার স্পন্দনে মৃতক্ষত ছুঁয়ে
সাঁওতাল গ্রামজননীর হাতের মলিন রেখা ভালোবেসে
একদিন ডেকেছিলো তার আঁকাবাঁকা বিদীর্ণ পল্লীর ঘরে।
পর্বত সংকুল এই মালভূমি পৃথিবীর এক বন্ধামাঠে
শুয়ে আছে; - শুয়ে আছে—সম্ভাবনাময় সকল শস্যের দানা;
সম্ভাবনাময় প্রত্নরক্ত গাঁথা দুঃখিত কাঙালি প্রাণশক্তি।
ক্ষয় ক্ষতি শোক জড়িয়ে জটিল বিহারিনাথের অন্ধগ্রাম
নাড়ি বেয়ে নেমে আসে শৈশবের অতল জলের নাভিপদ্মে।
বাউল রাত্রির ভাষা সন্ধ্যার সন্ন্যাসী আলোর গোধূলি চিহ্নে
মিশে গেছে অবসন্ন আলপথে সেইখানে শস্যের সংলাপ
শুনেছি নিষাদী বাতাসের গানে। অস্ফুটে শুনেছি ভাঙ্গাচোরা
অন্ধকারবুড়ির নির্জন স্বর- দেহজলে ধ্বংস জন্মভূমি
আমাকে পোড়ালো তারই শীর্ণ জোড়ে। শিকড়ের সন্ধ্যা শাখা ছিঁড়ে
জঠরের যতদূরে ভেসে আছি জন্মান্ধ দু-চোখ বহুদূর
সেই ঋণ রেখে ভেসে আছে নিজস্ব দূরত্বে। এখানে এখন
মন্দিরের দীর্ঘ আগ্নেয় শিলার মাটিছায়াগন্ধ মৃদঙ্গের
মতো হৃদয়ের এক কোণে বেজে গেছে দুঃখিত রাত্রির সঙ্গে।
ঋষভনাথের শিখরভূমের উষ্ণীষ ইছরি অজয়ের
জলে ভেসে আছে—ভেসে আছে রাঢ়ভূমি তারই প্রত্ন পদতলে।
ষড়ঋতু জুড়ে বেদনা পাথরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বীরজঙ্গা;
সেই গুহামুখ থেকে অহল্যাবাতাসে অভিমানী দামোদর
দামদাক ভাষা নিয়ে নেমেছে জঙ্গলমহল ধবলভূম
P 13
ঘিরে আদি জীবনের জন্মঘ্রাণে বিষাদের মৃত স্তূপ ছুঁয়ে।
এখানে আমার জীবন শোকার্ত পাতার মতন অবিরল
পেতে চেয়েছিলো গোপন জ্যোতির জল নিজেরই দহন পাত্রে।
জরায়ুর দুঃখী গর্ভজাল ভেঙ্গে ভেঙ্গে কত হিমযুগ আর
বৃষ্টিরাত চিরে কৃষ্ণপক্ষে চতুর্দশীর গোপন ক্ষীণ চাঁদে
ভেসে আছি ক্ষতচিহ্নের আতীব্র রক্তরসে। আজ নাভিকুন্ড
ছেয়ে আছে প্রস্তর জীবাশ্ম; যদিও আমরা আমাদের উষ্ণ
রাষ্ট্রস্রোতে মিশে গিয়ে চেয়েছি অভিন্ন মুখ- এখন পাঁজরে
দূরের নদীর শরীরে নূপুর বাজে সূর্যাস্তের ভিন্নগন্ধে।
অযোধ্যা পাহাড় ঘিরে বৈশাখী পূর্ণিমা নেমে আসে- খরপ্রভা
জীবনের সরল বিস্তার বুনো শুয়োরের দিকে ছুটে যায়;
অরণ্য বাকলে জ্যোৎস্না আসে, দিশুম সেন্দরা মন্থর সৃষ্টির
মন্থনের দিকে নিয়ে যায়। শ্যাওলার সহজাত অন্ধকার
নিথর শূন্যতা নিয়ে পাতা খসার অস্তিত্বে পিতৃপ্রবাহের
ছবি আঁকে- সেইখানে ভাঙ্গা মাটির মানুষ মানুষের কাছে
গল্পের আদিম দৃশ্য খোদিত করেছে ঝিঁঝিঁর নিবিড় ডাকে।
জন্মশোক স্মৃতিজল ছুঁয়ে প্রবীণ বৃক্ষের প্রাকৃত কঙ্কালে
চেয়ে থাকে; অন্তরের নির্জনতা নিজের মরমী অন্তর্লীন
বাঁশির একাগ্র সুরে আত্মগত ছায়ার গভীরে ক্ষতগুলি
দেখেছে, শ্মশানভূমিতে কিভাবে চন্দ্রদগ্ধ এক নদী ভাঙ্গা
মলিন আলোর বাঁশবন থেকে নিরুদ্দেশ হয়- চেতনার
সুগভীর স্তরের ভেতর? শেকড়ের স্নেহের স্রোতের ছায়া
কুটিরে ধ্বনিত হয়েছিল যাদের শিরায় তারা আজ মৃত;
সহস্র রাত্রির আঁধার পেরিয়ে প্রান্তরের দুর্বোধ্য পশ্চিমে
P14
চলে গেছে কোন স্বান্তনার- আকাঙ্ক্ষার উজ্জ্বল পথের দিকে?
নদীর কিনারে অচেনা পাখিরা আসে যায় জ্যোৎস্নায় তাদের
প্রতিবিম্ব ভাসে— শতাব্দীর সূর্যাস্তের পর জীবন কি তবে
তায়- সৃষ্টিবীজে ছাইতাপে হৃদয়ের সেই স্পর্শ রেখে যায়?
বিষাদের প্রিয় মুখগুলি অরণ্য প্রদেশে জীবিতের মাটি
হাঁটুভাঙ্গা দুঃখে নিজের সত্তার থেকে বিযুক্ত হয়েছে, তবু
বীরহড় বেঁচে থাকে নিজস্ব উদ্যমে; আত্মবিনাশের থেকে
বহুদূর সঙ্ঘে জীবন ছায়ার অনেক বিশ্বাস ভালোবেসে।
পাহারতলির বনস্থল অন্ধকার সংশয়ের সীমানার
জঙ্গলে গেঁথেছে পৃথিবীর উচ্ছিষ্ট উৎসাহে তাদের নিজস্ব
আনন্দের জনপদ। পত্রশাখা কুসুমের ফুল শব্দহীন
স্বেদবিন্দুগুলি পার্বত্য পথের ধুলোয় শীতের শিশিরের
গন্ধে বটফুল গৃহস্থের তাপে মিশে গিয়ে সংখ্যাহীন বর্ণে
ঋতুর সকল ডানামেলে মধুবনে উড়ে যায় অভিসারে।
অবেলার স্মৃতিগুলি রদবদলের পরিবৃত্তে সেইসব
অনুবিম্বে চেয়ে থেকে আসন্ন অঘ্রানে আগামীর শস্যক্ষেতে
বনভোজনের পুরোনো পার্বণে জন্মকে সার্থক মহীরুহে
পরিনত করে যেতে চায় বিজ্ঞাপনের চতুর অন্তরালে।
শতাব্দীর এই শহরের হিমঋতু ক্রমশ যখন এক
নিভৃত শোকের দিকে আমাদের নিয়ে যায়— ন্যুব্জ করে রাখে
দেখেছি সেদিন পৃথিবীর গুহার মানুষ মহাজাগতিক
পাখির ডানায় ছায়ার আতপে সুযোগ্য সম্বলে বেঁচে আছে
পিপাসার পুত্র কন্যা নিয়ে প্রেমে পূর্ণ হয়ে পরস্পর একই
দেহস্থিত মনিকোষের মহৎ অন্তরে আচ্ছন্ন হয়ে থেকে।
P15
বিশৃঙ্খলা বিগত স্মৃতিতে যে জ্ঞান দিয়েছে তারই প্রান্তরের
একপাশে দেখি আমাদেরই প্রজ্ঞাবান পুরুষ তন্ময় জ্ঞানে
সুস্থির তরঙ্গ ছড়িয়েছে নিজের সন্তানদের দেহরক্তে—
আবাদভূমিকে পঞ্চতীর্থ - পঞ্চগুণের দহন অশ্রু দিয়ে
ভরাট করেছে। যারা চিরকাল রোদ্দুরে কুণ্ঠিত হয়ে ঝুঁকে
নৈঃশব্দ্যের অন্ধকারে নিহতের মতো বেঁচেছে মলিন মুখে
তারা আজ বিচ্ছেদের দিনে সংগ্রামের দৃঢ় কথা বলে জন্ম
মৃত্যুর জীবন ছড়িয়ে দিয়েছে নির্নিমেষ আলোর গভীরে।
জন্মের আদিমতম অস্তিত্বে যুদ্ধের গভীরেই তারা বেঁচে
আছে নিরন্তর সভ্যতার দেহে। পাতাঝরা ধুলোর কঠিন
ভূমির নাভিতে দুর্বোধ্য বেদনা সহে প্রথম দিনের নগ্ন
পৃথিবীকে-পাখির জীবন পেয়ে শতশোকে আজো ভালোবাসে।
অরণ্যভূমির সন্ধ্যার শেকড়ে ও বীজে যে ক্ষত চিহ্নগুলি
আছে তা প্রাকৃত রাখালের নগ্ন হাতের ছোঁয়ায় ঘুমিয়েছে—
জন্মের নিবিড় মাতৃনাড়ির শুশ্রূষা পেয়ে সূর্যাস্তে আবার
অন্তঃসত্বা হয়- বিশ্বলতার বাঁশির রূপসুরে বেজে চলে।
টিলার ভেতর আগ্নেয় শিলার ঘুমহীন মহাকাশ থেকে
এক দীর্ঘ পথের যন্ত্রণাময় ছায়াপথ অভিমানে নেমে
এসে তার সৃষ্টির বিষন্ন হৃদয়ে নদীর জন্ম দিতে চায়
এখানের অবাধ দিগন্তে- নির্জলা পাথরে জলজ ঘাসের
গ্রাম ভিক্ষে করে — সবুজ ব্যাপ্তিতে দীর্ঘ চরাচর এক মুক্ত
উঠোনের স্বপ্ন দেখে। অতীত বর্ষার স্মৃতি বিশুষ্ক বাতাসে
যুবতী কাঁসায় শীলাবতীর উদ্দাম জলস্রোতের শব্দের
ছবি আঁকে।ভোরহীন পৃথিবীতে বেদনার তীব্র প্রতিধ্বনি
আত্মীয়তা খোঁজে।চিরকাল করোটিতে ক্লান্তির অতীত স্বর
মাতৃময় ঘুমন্ত গ্রামের জন্ম দেয় দগ্ধ ঘুমের ভিতর
সেইখানে অঢেল শূন্যতা নিয়ে মরানদী অন্তিম সূর্যাস্তে
মিশে গিয়ে শোকার্ত রাত্রির আঙ্গিনায় আমাদের কথা বলে।
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem