নবিনামা
সায়ীদ আবুবকর
★★★★★★
ষষ্ঠ সর্গ
কঠিন পরীক্ষা
পৌত্তলিকগণ আবু তালিবের কাছে
এলো ফের দলবেঁধে। ওয়ালিদ বিন
মুগিরার ছেলে ওমারাকে নিয়ে গেল
তাঁর কাছে এবং বললো, "এটা হচ্ছে
কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি
শক্তিশালী, সুদর্শন, ধার্মিক যুবক।
আপনি, হে বিজ্ঞ নেতা, গ্রহণ করুন
পুত্ররূপে একে। আজ থেকে আপনার
সন্তানরূপেই গণ্য হবে এ-যুবক।
এর শোণিতপাতের খেসারত আর
সাহায্যের অধিকারী হবেন আপনি।
এর পরিবর্তে পথভ্রান্ত আপনার
ভাতিজাকে তুলে দিন আমাদের হাতে।
সে আপনার এবং আমাদের পিতা-
পিতামহদের বিরোধিতা করছে। সে
আমাদের জাতীয়তা, একতা এবং
শৃঙ্খলাকে বিনষ্ট করছে। আমাদের
জ্ঞানীদেরকে সে মূর্খ আখ্যায়িত করে
সবাইকে অপমান করে যাচ্ছে। তাঁকে
হত্যা করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর
নেই। অতএব তাঁকে আমাদের হাতে
তুলে দিন। এক ব্যক্তির বিনিময়ে তো
এক ব্যক্তিই যথেষ্ট।" আবু তালিবের
চোখমুখ ক্রোধে হয়ে উঠলো রক্তিম।
ক্ষুব্ধ, শঙ্কিত, লজ্জিত আর বিচলিত
হয়ে উঠলো সে তাদের স্পর্ধায়। দুঃখ-
দীর্ণ কণ্ঠে বললো সে, "বড়ই জঘন্য
তোমাদের প্রস্তাব। ভেড়ার বাচ্চা দিয়ে
তোমরা আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে
এসেছো সিংহশাবক। বলো এর চেয়ে
নির্লজ্জতা আর কী থাকতে পারে? হায়,
তোমরা চাচ্ছো যে, তোমাদের সন্তানকে
খাওয়ায়ে পরায়ে আমি বড় করে তুলি
এবং আমার সন্তানকে তুলে দেই
তোমাদের হাতে এই উদ্দেশ্যে যে, তাঁকে
তোমরা হত্যা করে ফেলবে। আল্লাহর কসম!
কক্ষনোই এমনটি পারবে না হতে।"
নওফেল বিন আবদে মানাফের পুত্র
মুতইম বিন আদি বললো উত্তরে,
"লাতের কসম! হে আবু তালিব, তারা
উত্তম প্রস্তাবই দিয়েছে তোমাকে। কাজ-
কর্মের যে-ধারাপদ্ধতি তোমার জন্য
বিপদজনক, তা থেকে তোমাকে রক্ষা
করতেই চাচ্ছে তারা। অথচ তাদের
কোনো কথাতেই আমল দিচ্ছো না তুমি।"
আবু তালিব বললো, "আল্লাহর কসম!
তোমরা আমার সাথে বিবেকপ্রসূত
কোনো কথাই বলোনি। বরং তোমরা
আমার সান্নিধ্য পরিত্যাগ করে লিপ্ত
হয়ে গেছো আমারই বিরোধিতায়। তবে
ঠিক আছে, আমিও দেখছি তোমাদের
কী ক্ষমতা আর কত দূর বাহাদুরি।"
কুরাইশ নেতৃবৃন্দ বের হয়ে গেল
লাফাতে লাফাতে। উদ্বিগ্ন আবু তালিব
হয়ে গেল নিমজ্জিত গভীর চিন্তায়।
নিপীড়ন-নির্যাতন বেড়ে গেল আরো।
পৌত্তলিকগণ, চাকভাঙা ভিমরুল
যেন, হামলে পড়লো একসাথে জীর্ণ-
শীর্ণ মুসলিমদের 'পরে; যেখানেই
যাকে পায়, সেখানেই তাঁকে বিষদাঁতে
করতে লাগলো দংশন। তাদেরকে
নির্মূল না করে বুঝি থামবে না আর।
নতুন কৌশলে মহম্মদ ছুটে চলে
সম্মুখে। জানে সে, তাদেরকে মোকাবেলা
করার আসেনি সময়; সত্যের ভিত
মজবুত হতে হবে আরো, তা নইলে
পড়বে প্রাসাদ ধসে। তাঁর সঙ্গীগণ
করতে পারে না ইবাদত-বন্দেগিও
প্রকাশ্যে; গোপনে তাঁরা আরকাম বিন
আবিল আরকাম মাখযুমীর বাসায়
হয় একত্রিত। সাফা পর্বতের 'পরে
তাঁর এ-বাড়ি। সেখানে সমবেত হয়
তাঁরা সালাতের জন্যে। অত্যন্ত গোপনে
ছুটে আসে মহম্মদ, দিয়ে যায় দিক-
নির্দেশনা, শোনায় কোরান আর যারা
হতে চায় মুসলিম, এখানে বসেই
তাঁদেরকে কলেমা পড়ায়। কতিপয়
পৌত্তলিক একদিন দেখে ফ্যালে সব।
এভাবে একত্রে সালাত পড়তে দেখে
অকথ্য ভাষায় শুরু করে গালাগালি,
এমনকি তাঁদের উপর আচমকা
করে বসে আক্রমণ। নিরুপায় হয়ে
ভীত-ত্রস্ত মুসলিমগণ শক্তভাবে
রুখে দেয় তাদেরকে। সাদ বিন আবি
ওয়াক্কাসের প্রহারে এক পৌত্তলিক
হয়ে পড়ে রক্তাক্ত; সংজ্ঞা হারায় সে।
তাকে কাঁধে নিয়ে পালায় কাপুরুষেরা
সিংহের তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো।
অসহায় মুসলিমদের নিরাপত্তা
নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে মহম্মদ।
তাঁর কাছে পৌঁছেছিল আবিসিনিয়ার
মহান সম্রাট আসহামা নাজ্জাসীর
ন্যায়-পরায়ণতার কথা। যখন এ-
ওহি অবতীর্ণ হলো—য় ‘আপনি বলুন,
হে ঈমানদারগণ, শুধু ভয় করো
তোমাদের প্রতিপালককে; দুনিয়াতে
যারা সৎ-কাজ করবে, তাদের জন্যে
আছে কল্যাণ। আল্লাহর জমিন প্রশস্ত।
যারা ধৈর্যধারণ করবে, অবশ্যই
পুরস্কৃত হবে তারা।'; তখন নিশ্চিন্তে
মহম্মদ তাঁদেরকে আবিসিনিয়ায়
যাওয়ার দিয়ে দিলো অনুমতি। মক্কা
ছেড়ে রাতের আঁধারে প্রায় এক শত
মুসলিম চলে গেল আবিসিনিয়ায়।
পৌত্তলিকদের মাথায় পড়লো যেন
বাজ। যে-ধর্মের দীপ ফুঁক দিয়ে তারা
চেয়েছিল নেভাতে মক্কায়, মক্কা ছেড়ে
চললো তা পৃথিবীতে ছড়াতে ঔজ্জ্বল্য—
ভেবে তারা হয়ে গেল বিমূঢ় বিষাদে।
তত তারা হয়ে ওঠে ক্ষিপ্ত মহম্মদ
বিন আব্দুল্লাহর উপর, যেঁ এর হোতা,
যাঁর মন্ত্রবাণে ধসে ধসে পড়ছে সব
বিশ্বাসের দুর্গ, ঐতিহ্যের রাজবাড়ি।
পৌত্তলিকগণ বহু চিন্তা-ভাবনা করে
পাঠালো আমর বিন আস আর মক্কা-
মুলুকের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী আব্দুল্লাহ বিন
রাবিয়াকে দূত করে আবিসিনিয়ায়।
বিপুল উপঢৌকন নিয়ে তারা পৌঁছে
গেল সম্রাটের দরবারে। অতঃপর
বিনয়ের সাথে বললো, "হে মহামান্য
সম্রাট! নির্বোধ কিছু বিদ্রোহী যুবক
আমাদের দেশ থেকে পলায়ন করে
আশ্রয় নিয়েছে আপনার দেশে। তাঁরা
পূর্ব-পুরুষগণের কাছ থেকে বংশ-
পরম্পরা সূত্রে চলে আসা ধর্মমত
পরিত্যাগ করেছে। এখানে এসে তাঁরা
আপনার ধর্মমতও করেনি গ্রহণ। এঁরা
তৈরি করে ফেলেছে নতুন এক ধর্ম,
এবং চর্চাও করছে তা চুপিসারে।
এদের ধৃষ্টতায় আমরা মর্মাহত।
এদেরকে অনুগ্রহপূর্বক আপনি
আমাদের কাছে ছেড়ে নিন। দেশে নিয়ে
গিয়ে, আমরা এদের সুবিচার করে
যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবো।"
বললেন মহান সম্রাট, "তোমাদের
কথা আমি শুনলাম। এবার তাদের
কথাবার্তা শুনবো। সিদ্ধান্ত নেবো এর
পর, তাদেরকে আমি তোমাদের হাতে
তুলে দিতে পারবো কি পারবো না।" বলে
নির্দেশ দিলেন তিনি আশ্রিতদেরকে
দরবারে হাজির করতে। তারা এলে,
বলে উঠলেন নাজ্জাসী, "এদের ধর্ম
পরিত্যাগ করে যে-ধর্মে দীক্ষিত হয়ে
দেশ ছেড়ে এদেশে আশ্রয় নেছো তোমরা,
এমনকি আমাদের ধর্মের প্রতিও
উদাসীন হয়ে আছো, সেটি কোন্ ধর্ম? "
মুসলিমদের মুখপাত্র, জাফর বিন
আবু তালিব, বলে উঠলো প্রত্যুত্তরে,
"হে মহামান্য সম্রাট! আমরা ছিলাম
অশ্লীলতা, বর্বরতা ও অনাচারের
অন্ধকারে নিমজ্জিত এক পথভ্রষ্ট
জাতি। আমরা প্রতিমা পূজা করতাম,
মৃত জীব-জানোয়ায়ের মাংস ভক্ষণ
করতাম, নির্বিচারে জেনা-ব্যভিচার
ও অশ্লীলতায় লিপ্ত থাকতাম, পাড়া-
প্রতিবেশীদের সাথে অন্যায়াচরণ
করতাম, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন
করতাম, এতিমের সহায়-সম্পত্তি
গ্রাস করতাম, আমানত খেয়ানত
করতাম। নীতিনৈতিকতাহীন এক
অসভ্য জীবনযন্ত্রণায় ছটফট
করছিলাম আমরা। ঠিক সে-সময়ে
মহান আল্লাহ অনুগ্রহ করে এক
নবি পাঠালেন আমাদের কাছে। তাঁর
বংশমর্যাদা, সততা, সহনশীলতা,
ন্যায়-নিষ্ঠা, পরোপকারিতা, লাজুকতা,
সংযমশীলতা ও সত্যবাদিতার কথা
ভালোভাবে জানা ছিলো আমাদের। তিনি
আমাদের বললেন, ‘বিশ্বজাহানের
স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। আমরা আল্লাহ
ছাড়া আর কারো উপাসনা করবো না।
এ-যাবৎ যে-সমস্ত প্রতিমার পূজা
করে এসেছি, সেসব বর্জন করবো।
মিথ্যা বলা ছেড়ে দেবো। জেনা-ব্যভিচার
করবো না। পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে
সদ্ব্যবহার করবো। অশ্লীল অবৈধ
কাজ থেকে বিরত থাকবো। রক্তপাত
পরিহার করে চলবো। আল্লাহর সাথে
কাউকে শরিক করবো না।' উপরন্তু
তিনি আমাদের সালাত আদায় করা,
রমজান মাসে রোযা রাখা ও গরিব-
মিসকিনদের যাকাত দেওয়ার জন্য
নির্দেশ প্রদান করেন।" একটু থেমে
আবার সে বলতে লাগলো, "মহান এ-
নবিকে আমরা সত্য-নবি বলে মেনে
নিয়েছি এবং তাঁর নির্দেশাবলির
প্রতি প্রকাশ করেছি পূর্ণ আনুগত্য।
তাই আমরা এক ও অদ্বিতীয় প্রভু
আল্লাহ ব্যতীত আর কারো ইবাদত
করি না এবং বিশ্ব-পরিচালনায়
তাঁর কোনো অংশীদার আছে, তা আমরা
স্বীকার করি না। আমাদের পয়গম্বর
যে-সমস্ত কথা-কাজ-খাদ্য আমাদের
জন্য হারাম বলেন, সেসব আমরা
বর্জন করেছি, আর যেগুলোকে তিনি
হালাল বলেন, আমরা তা যথাসাধ্য
পালন করার চেষ্টা করি। এ-কারণে
আরবের বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়
আমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত আছে।তারা
চায় এ-সত্য সুন্দর ও শাশ্বত ধর্ম
থেকে আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে, ফের
অশ্লীলতা ও অনাচারের ঘৃণ্য পঙ্কে
নিমজ্জিত করতে। আমরা তা করতে
অস্বীকার করায় আমাদের উপর
নারকীয় নির্যাতন চালিয়েছে তারা।
নিদাঘের উত্তপ্ত কঙ্কর ও বালুকা-
রাশির উপর আমাদের শুইয়ে রেখে
দিয়েছে বুকের উপর পাথর চাপা;
দিয়েছে পাথর চাপা জ্বলন্ত অঙ্গারে
শুইয়ে রেখে আমাদের; পায়ে দড়ি বেঁধে
টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে রাস্তায় রাস্তায়;
নারীদের লজ্জাস্থানে তীর ছুঁড়ে মেরে
করেছে নির্মমভাবে হত্যা; আমাদের
ব্যবসা-বাণিজ্য, চলাফেরা বন্ধ করে
দিয়ে আমাদের জীবনকে তারা করে
তোলে দুর্বিষহ। এরকম অবস্থায়
আমাদের নবি আপনার সুশাসন
আর ন্যায়-পরায়ণতার কথা শুনে
আমাদের নির্দেশ দিলেন দেশ ত্যাগ
করে আপনার দেশে আশ্রয় গ্রহণ
করতে। হে মহান সম্রাট, আপনার
আশ্রয়ের সুশীতল ছায়াতলে থেকে
আমরা মুগ্ধ হয়েছি। অনুগ্রহ করে
এসব পাষণ্ড পশুবৎ জালিমের
হাতে আমাদের তুলে দেবেন না আপনি।"
বললেন সম্রাট নাজ্জাসী, "তোমাদের
পয়গম্বর যা এনেছেন, তার কিছু
অংশ কি শোনাতে পারবে আমাদের? "
পবিত্র কোরান থেকে সুরা মরিয়ম
উচ্চকণ্ঠে সুমধুর সুরে পাঠ করে
শোনাতে লাগলো জাফর। তা শুনে, যত
বিজ্ঞ পাদ্রী উপস্থিত ছিলো দরবারে,
তাঁদের দু-চক্ষু ভিজে গেল, উচ্চৈঃস্বরে
উঠলো ক্রন্দন করে তাঁরা। সব শুনে
সম্রাট নাজ্জাসী উঠলেন বলে, "এ তো
সেই কালামেরই অনুরূপ, যা নাযিল
হয়েছিল ঈশার উপর! এ-কালাম
আর সে-কালাম একই উৎস থেকে
আবির্ভূত।" অতঃপর তিনি মক্কা থেকে
আগমন করা দু-দূতকে বললেন,
"যে-দুরভিসন্ধি নিয়ে এসেছো তোমরা,
কিছুতেই সফল হবার নয়।" বলে
তিনি সভাষদবৃন্দসহ করলেন
প্রস্থান। আমর-বিন-আস আব্দুল্লাহ-
বিন-রাবিয়াকে বললো অস্ফুট স্বরে,
"লাতের কসম! এমন প্রসঙ্গ নিয়ে
রাজদরবারে আসবো আগামীকাল,
যা শুনে সম্রাট এদের কুত্তার মতো
লাথি মেরে বের করে দেবে দেশ থেকে।"
পরবর্তী দিন নাজ্জাসীর দরবারে
গিয়ে ফের বললো আমর-বিন-আস,
"হে সম্রাট, এরা ঈশা বিন মরিয়ম
সম্বন্ধে এমন সব কথা বলে, কেউ
বলেনি যা কোনোদিন। জঘন্য এদের
ধর্মীয় বিশ্বাস। দেখুন পরীক্ষা করে
এদের! " সম্রাট ফের ডেকে পাঠালেন
তাঁদেরকে। প্রশ্ন শুনে প্রত্যয়ের সাথে
বললো জাফর, "আমরা আল্লাহ ও তাঁর
রসুলের কাছ থেকে এটুঁকু জানি যে,
মহান ঈশা ছিলেন আল্লাহর বান্দা
এবং রসুল। তাঁর মাতা মরিয়ম
ছিলেন অত্যন্ত সতী-সাধ্বী, অতি উঁচু
মর্যাদার মহিলা। আল্লাহর হুকুমেই
বিশেষ ব্যবস্থাধীনে মহান ঈশার
জন্ম হয় কুমারী মরিয়মের গর্ভে।"
সম্রাট নাজ্জাসী বললেন, "এর চেয়ে
খড় পরিমাণও বেশি কিছু ছিলেন না
ঈশা। সুতরাং তোমরা নির্ভয়ে, যত
দিন খুশি, থাকো আমাদের দেশে। কেউ
তোমাদের কিছুই করতে পারবে না।"
তোতা মুখ ভোঁতা করে শূন্য হাতে ফিরে
চললো আমর আব্দুল্লাহর হাত ধরে।
দিনে দিনে বহু বেড়েছে এঁদের ডানা;
ভেঙে দিতে হবে এইবার! ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ,
শিকার হারানো বুভুক্ষু বাঘের মতো
শোকাহত আবুল হাকাম বৈঠকের
ডাক দিলো দারুন নদওয়ায়। বললো সে,
"এখনি পালের গোদাটাকে দিতে হরে
শেষ করে। তা না হলে শেষ হয়ে যাবো
আমরাই। কে এমন আছে তোমাদের
মধ্যে, যে-মহম্মদের মাথা কেটে এনে
ধন্য করবে আমাদের? আমরা সবাই
এ-জাতির শ্রেষ্ঠ বীর বলে মেনে নেবো
তাঁকে আর তাঁকে অর্থবিত্ত দিয়ে শ্রেষ্ঠ
ধনী করে দেবো আরবের।" মহাবীর
হামজা ও আরবের সরদার আবু
তালিবের ভ্রাতুষ্পুত্র, কাবার রক্ষক
আব্দুল মুত্তালিবের পৌত্র আর বনু
হাশিম গোত্রের সবার নয়নমণি
চির-সত্যবাদী মহম্মদের মস্তক
কার এত হিম্মত, কর্তন করে আনে!
আবু জেহেলের এ-জঘন্য ঘোষণায়
আরব বীরেরা থরথর করে কাঁপে।
এর ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তারা।
হঠাৎ দাঁড়ালো উঠে খাত্তাবের পুত্র
কুখ্যাত ওমর, আগুনের মতো যাঁর
দুচোখ সর্বদা জ্বলে, যেন সে বনের
সত্যিকার বাঘ, চড়ে যায় রাগ যাঁর
মস্তকে মুহূর্তে তুচ্ছ অজুহাতে। তাঁকে
দেখে, যেন বিজয়-উল্লাসে, বলে ওঠে
আবুল হাকাম, "সাবাস ওমর! আমি
জানতাম, তুমি ছাড়া আর-কারো পক্ষে
সম্ভব হবে না এই অসাধ্য সাধন।"
খোলা তলোয়ার হাতে উন্মত্ত ওমর
ছোটে। বেদ্বীনকে আজ উৎখাত করে
তবেই ফিরবে বাড়ি। ‘কোন্ যম এসে
বাঁচায় তোকে হে আরবের দুশমন
মহম্মদ বিন আব্দুল্লাহ? ' ভাবে আর
ছোটে; ফোটে টগবগ করে রক্ত তাঁর
সমস্ত শরীরে। এভাবে ছুটতে দেখে
নঈম ইবনে আব্দুল্লাহ নাহহাম
আদভি বললো তাঁকে ডেকে, "হে ওমর!
খোলা তরবারি নিয়ে ছুটলে কোথায়? "
বললো সে, "কাটতে মহম্মদের মাথা।"
নঈম বললো, "ওহে! তুমি কি ভেবেছো
বনু হাশিম ও বনু যুহরা তোমাকে
এমনি এমনি দেবে ছেড়ে? " রেগে গিয়ে
বললো ওমর, "পূর্ব-পুরুষের ধর্ম
ত্যাগ করে তোমরাও বুঝি হয়ে গেছো
বেদ্বীন? " নঈম বললো, "ওমর! শোনো,
একটা মজার কথা শোনাই তোমাকে।
ফাতিমা, তোমার বোন আর তাঁর স্বামী—
তারাও শুনছি হয়ে গেছে মুসলিম;
সে-খবর রাখো? আগে ঘর সামলাও;
তারপর তেল দিও অন্যের চরকায়! "
জ্বলন্ত আগুনে যেন ছিটিয়ে দিলো ঘি
নঈম! একথা শুনে উন্মত্ত ওমর
ফেটে পড়লো আরো ক্রোধে, "ও, তাই? তাহলে
ওদেরকেই আগে উৎখাত করে আসি! "
বলতে বলতে ছুটলো সে ভগ্নী-গৃহে।
সে-সময় ফাতিমা বিনতে খাত্তাবের
গৃহে খাব্বাব ইবনে আরাত্ত তামীমী
কোরানের তালিম দিচ্ছিল স্বামী-স্ত্রীকে।
দূর থেকে শুনে ফ্যালে খাব্বাবের কণ্ঠ
ওমর। সে চিল্লাতে চিল্লাতে ঢুকে যায়
গৃহে। তার আগেই খাব্বাব এক ঘরে
ঢুকে পড়ে করে আত্মগোপন।ফাতিমা
লুকায় বুকের পোশাকের নিচে দ্রুত,
হাতে লেখা কোরানের আয়াত। ওমর
বললো ভগ্নীকে, "শুনতে পেলাম কার
কণ্ঠ যেন! " বললো ফাতিমা, "আমরাই
পরস্পর কথাবার্তা বলছিলাম।" সে
বললো, "তোমরা উভয়েই বোধহয়
বেদ্বীন হয়ে গেছ।" বললো ভগ্নীপতি
সাঈদ বিন যায়দ, "বলো তো ওমর,
তোমাদের ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম
যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে সে-ক্ষেত্রে
কী দায়িত্ব হবে আমাদের? " সাঈদের
এই প্রশ্ন শুনে তেলে-বেগুনে উঠলো সে
জ¦লে। "রে পাপিষ্ঠ! সে-দায়িত্ব হবে এই—"
বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো সিংহের মতো
তার ভগ্নীপতির উপর। পাষণ্ডের
মতো মারতে লাগলো তাঁকে। ভগ্নী তাঁর,
ছুটে গিয়ে তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিলো
তাঁর আহত স্বামীকে। ওমর এবার
ফাতিমার গণ্ডদেশে এত জোরে এক
বসালো থাপ্পড়, মুহূর্তেই গোটা মুখ
হয়ে গেল রক্তাক্ত। ফাতিমা ক্ষুব্ধ স্বরে
বললো, "ওহে ওমর! তোমাদের ধর্ম
ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম যদি সত্য হয়,
তাহলে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া
কোনো উপাস্য-ই নেই, আর মহম্মদ
আল্লাহর রসুল।" ভগিনীর সারা মুখে
তাজা রক্ত আর অভিমানে ফেটে পড়া
দুচোখে অশ্রুর বন্যা দেখে মন তাঁর
ভেঙেচুরে হয়ে গেল খানখান। তাঁর
পাষাণহৃদয়ে উথলে উঠলো ঢেউ
দরিয়ার।আর দুই চোখে বয়ে গেল
আরবসাগর। আর্দ্র-কণ্ঠে সে বললো,
"বোন! তোমাদের নিকট যে-গ্রন্থখানা
আছে, আমাকে তা পড়তে দাও।" বললো
ফাতিমা সরোষে, "তুমি অপবিত্র। এটি
পবিত্র কিতাব। অপবিত্র অবস্থায়
যায় না এসব ধরা। স্নান করে পাক-
সাফ হয়ে এলেই, পারবে স্পর্শ করতে
এটা।" কী আছে এ-গ্রন্থে, বোনকে যা কেড়ে
নেয় ভাইয়ের কাছ থেকে? এ-কিতাবে
আছে কি সে জাদু, পাশবিক প্রহারেও
ভাঙতে দেয় না যা সাঈদ বিন যায়দের
অটল বিশ্বাস? বিধ্বস্ত ওমর ভাবে।
বোনের নির্দেশে করলো সে স্নান। পাক-
পবিত্র হয়ে সে, অতঃপর, ফাতিমার
হাত থেকে আশ্চর্য গ্রন্থটি হাতে নিয়ে
পড়তে লাগলো রুদ্ধশ্বাসে— ‘ত্ব-হা। আমি
তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য এ-কোরান
অবতীর্ণ করিনি। বরং অবতীর্ণ
করেছি সতর্কবাণী হিসেবে তাদের
জন্য, যারা ভয় করে। যিনি পৃথিবী ও
সুউচ্চ আকাশ সৃষ্টি করেছেন, এটি
তাঁর কাছ থেকে অবতীর্ণ। দয়াময়
তিনি; সুপ্রতিষ্ঠিত আছেন আরশে। যা
আকাশে, যা যমিনে, যা এ দু-এর মাঝে,
আর যা ভূগর্ভে, সব তাঁরই। তুমি যদি
উচ্চকণ্ঠে কথা বলো, তবে জেনে রাখো,
তিনি গুপ্ত ও তদপেক্ষাও গুপ্ত সব
বিষয়ই জানেন। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত
কোনো রব নেই; সুন্দর নামসমূহ
কেবল তাঁরই।' ওমর ইবনে খাত্তাব
যত পড়ে, তত তাঁর চক্ষু যায় খুলে;
তত তাঁর মনে লাগে ঘোর; তত তাঁর
জীবনের হিসাবনিকাশ হয়ে যায়
এলোমেলো। দেখলো ফাতিমা চেয়ে, খুনী-
ওমরের চক্ষু বেয়ে নেমেছে শান্তির
বারি। ভাইয়ের জন্যে সে প্রাণ খুলে করতে
লাগলো প্রার্থনা অন্তরে অন্তরে। বলে
উঠলো ওমর উল্লাসে, "এটা তো বড়ই
উত্তম, বড়ই সম্মানিত কথা! ওহে
ফাতিমা, আমাকে মহম্মদের সন্ধান
দাও।" গোপনীয় স্থান থেকে বের হয়ে
এলো খাব্বাব। সে বললো, "ওমর বিন
খাত্তাব! সন্তুষ্ট হয়ে যাও। গত রাতে
আল্লাহর নবিকে আমি শুনেছি প্রার্থনা
করতে তোমার জন্য। প্রার্থনা কবুল
হয়ে গেছে, হে ওমর! তুমি হর্ষোল্লাস
করো।" মহম্মদ অবস্থান করছিল
সে-সময় সাফা পর্বতের নিকটস্থ
এক গৃহে। খোলা তরবারি কোষবদ্ধ
করে খাব্বাবের সাথে ছুটলো ওমর।
সে-বাড়ির দরজায় গিয়ে সে করলো
করাঘাত। দরজার ফাঁক দিয়ে কেউ
উঁকি দিয়ে দেখলো কোষবদ্ধ তলোয়ার
নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ওমর। সাথে
সাথে বিষয়টি অবহিত করা হলো
আল্লাহর নবিকে। উপস্থিত ছিলো যারা,
হয়ে গেল সংঘবদ্ধ। লোকদের ভীত-
ত্রস্ত ভাব দেখে বলে উঠলো হামজা,
"কী ব্যাপার? কী হয়েছে? " বলে উঠলো তারা,
"ওমর দাঁড়িয়ে দরজায়! " সব শুনে
বললো হামজা সদর্পে, "এসেছে শেষে
খাত্তাবের পুত্র ওমর? দরজা খুলে
দাও। সে যদি সদিচ্ছা নিয়ে আসে, তবে
আমাদের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার কোনো
অভাব হবে না। আর যদি আসে কোনো
খারাপ উদ্দেশে, তাহলে আমরা তাঁর
খড়গ দিয়েই তাঁকে শেষ করে দেবো।"
সে-সময় নবির উপর অবতীর্ণ
হচ্ছিল ওহি। তা শেষ হলে, মহম্মদ
ওমরের বস্ত্র ও তরবারির কোষ
ধরে টান দিয়ে বললো সখেদে, "ওহে
ওমর! ওয়ালিদ বিন মুগিরার 'পরে
যেমনটি অবতীর্ণ হয়েছিল, সেই-
রূপ আল্লাহর তরফ থেকে যতক্ষণ
না তোমার উপর লাঞ্ছনা, বেইজ্জতি
আর শাস্তি অবতীর্ণ হচ্ছে, ততক্ষণ
তুমি পাপাচার থেকে বিরত হবে না? "
তারপর হাত তুলে ওমরের জন্য
করতে লাগলো সে প্রার্থনা, "হায়, প্রভু,
সর্বশক্তিমান! তোমার ইচ্ছাই কিংবা
অনিচ্ছাই হচ্ছে চূড়ান্ত। ওমর বিন
খাত্তাবের দ্বারা তুমি বৃদ্ধি করে দাও
ইসলামের শক্তি ও সম্মান।" তাঁর এ-
প্রার্থনা তুললো সাত সাগরের ঢেউ
ওমরের পাথরঅন্তরে। জীবনের
যত কালি, যত পাপ, দুর্গন্ধ ছড়ানো
যত নোংরা-আবর্জনা শরীরে ও মনে,
চোখের পানিতে সব ধুয়েমুছে গিয়ে
লাগলো হারিয়ে যেতে যেন ব্ল্যাকহোলে।
অনন্তের মহাজ্যোতি আছড়ে পড়লো
যেন চোখে; সে-জ্যোতি ধাঁধিয়ে দিলো তাঁর
চোখ; কেমন অস্থির হয়ে উঠে বজ্র-
কণ্ঠে সে হঠাৎ করে ফেললো ঘোষণা—
"আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু
অ-আন্নাকা রসুলুল্লাহ। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি,
নেই কোনো উপাস্য আল্লাহ ছাড়া, আর
নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রসুল।" শুনে
উপস্থিত মুসলিমগণ এত জোরে
‘আল্লাহু আকবর! ' বলে চীৎকার করে
উঠলো, তার ধ্বনি জমিনে পাহাড় ধসে
পড়বার মতো আছড়ে পড়লো গিয়ে
কাবাঘরে। সমস্ত মক্কায় মুহূর্তের
মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেল—‘মহম্মদকে হত্যা
করতে গিয়ে, মুসলমান হয়ে গেছে
খাত্তাবের পুত্র ওমর।' তা শুনে শোকে
মুহ্যমান হয়ে পৌত্তলিকগণ ঘরে
খিল দিয়ে জুড়ে দিলো ক্রন্দন-বিলাপ।
আবু লাহাব ও তার বউ উম্মে জামিল
চাপড়াতে লাগলো বুক। আবুল হাকাম
মূর্ছা গিয়ে পড়ে রইলো কাঠের মতো
ধুলোর উপর, যেন ঝড়ে উপড়ে যাওয়া
সুপারির গাছ। নিজ হাতে ছিঁড়তে ছিঁড়তে
মাথার বিস্রস্ত চুল, নগ্ন হয়ে সাফা
পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে শয়তান
ঘুচাতে মনের জ্বালা, ঝাঁপ দিলো নিচে।
যখন ওমর ও হামজা মহম্মদকে
মাঝখানে রেখে, ‘আল্লাহু আকবর' ধ্বনি
দিতে দিতে, উড়িয়ে পথের ধুলোবালি,
সংঘবদ্ধ মুসলিমদের শোভাযাত্রা
নিয়ে, প্রবেশ করলো এসে কাবাগৃহে;
ঘরদোর ভেঙে রাক্ষসের মতো এলো
ছুটে পৌত্তলিকগণ, ঝাঁক বেঁধে; এসে
কাবায় সিজদারত মুসলিমদের
উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তারা, যেন মত্ত
চাকভাঙা ভিমরুল। তাঁদের নবিকে
নিয়ে দুর্বল মুসলমানগণ গেল
পৌত্তলিকদের দৃষ্টির আড়ালে; শুধু
যাওয়ার আগে বললো ওমর, "ওহে
কুরাইশগণ! আমাদের সংখ্যা যদি
আরেকটু বেশি হতো, তাহলে নিতাম
দেখে আজ কেমন মরদ তোরা।" বাড়ি
গিয়ে বসতে না বসতেই, কেউ এসে
বললো, "ওমর, একজোট হয়েছে সব।
তোমার বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছে তারা;
তোমাকে এবার হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে।"
আবু আমর বিন আস বিন ওয়ায়িল
সাহমী বললো এসে, "কী ব্যাপার, ওহে
ওমর বিন খাত্তাব! চিন্তিত দেখাচ্ছে
কেন এত? " বললো ওমর, "শোনো ওহে
সাহম গোত্রের নেতা! আমি মুসলিম
হয়ে গেছি শুনে আমাকে তোমার জাতি
হত্যা করতে চাচ্ছে।" আবু আমর, প্রিয়
বন্ধু ওমরের, বললো সমস্ত শুনে,
"তা সম্ভব নয়।" বলে বেরিয়ে গেল সে।
ধাবমান লোকজনদের ইশারায়
থামিয়ে দিয়ে সে জানতে চাইলো, তারা
চলেছে কোথায়। তারা বললো, "শুনেছি,
ওমর বেদ্বীন হয়ে গেছে। আমরা যাচ্ছি
শায়েস্তা করতে তাঁকে।" সে বলে উঠলো,
"সেদিকে যাবার কোনো পথ নেই।" শুনে
দল বেঁধে ফিরে চললো তারা নিজগৃহে।
দিন দিন বেড়েই চলেছে মুসলিম।
যে-যায় মহম্মদকে করতে উৎখাত,
সে-ই তাঁর ভক্ত হয়ে দিতে যায় জান
তাঁর জন্যে; আসলে সে মস্ত জাদুকর;
কোনো শক্তি দিয়ে তাঁকে যাবে না ঘায়েল
করা; তার চেয়ে আমরা বুঝাই চলো
দরদের সাথে; সে নিশ্চয় ফেলবে না
আমাদের কথা; --এরকম কথাবার্তা
নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল
কুরাইশগণ। মহম্মদ বসে ছিলো
মসজিদুল হারামের এক কোণে একা।
উতবাহ বিন রাবিয়াহ বললো, "হে
কুরাইশগণ! মহম্মদের কাছে গিয়ে
আমি বলবো এমন কিছু কথা, যা সে
ফেলতে পারবে না, বরং ছেড়ে দেবে
তাঁর মিথ্যে ধর্মের প্রচার।" বলেই সে
ছুটে গেল তাঁর কাছে। তাঁর কাছে বসে
বললো সে, "ভ্রাতুষ্পুত্র! আমাদের গোত্রে
তোমার যে সম্মান-মর্যাদা, সে-সম্বন্ধে
নিশ্চয় তোমার জানা আছে। কিন্তু তুমি
হঠাৎ তোমার জাতির নিকট এক
বিশাল ব্যাপার নিয়ে হাজির হয়েছো,
যা তাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে বিভেদ,
তারা লিপ্ত হয়ে গেছে কলহ-বিবাদে।
তুমি তাদের বিচার-বুদ্ধি-বিবেককে
করে ফেলেছো নির্বুদ্ধিতার সম্মুখীন।
তাদের উপাস্য দেব-দেবী, ধর্ম আর
পূর্ব-পুরুষগণের নানা দোষত্রুটি
বের করে তাদেরকে কাফের সাব্যস্ত
করছো। এসব সমস্যার প্রেক্ষাপটে
আমি তোমার নিকট কয়েকটি কথা
পেশ করবো, যা তুমি শোনো মন দিয়ে।
হতে পারে, এর কোনো কথা আমাদের
সাহায্য করবে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে।"
মহম্মদ বললো, "আবুল ওয়ালিদ,
তুমি বলে যাও, আমি তোমার কথায়
পূর্ণ মনোযোগী হবো।" বললো উতবাহ,
"ভ্রাতুষ্পুত্র! তুমি যা নিয়ে এসেছো আর
মানুষকে যে-সমস্ত কথা তুমি বলে
বেড়াচ্ছো, উদ্দেশ্য যদি হয়, তুমি এর
মাধ্যমে ধন-সম্পদ অর্জন করতে
চাচ্ছো, তাহলে আমরা তোমার দু-হাতে
ঢেলে দেবো এত বেশি ধন-সম্পদ যে,
তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি
ধন-সম্পদের অধিকারী হয়ে যাবে;
আর যদি তুমি চাও সমাজের মধ্যে
সবচেয়ে বেশি মান-মর্যাদা, প্রভাব-
প্রতিপত্তি, তাহলে আমরা আমাদের
নেতৃত্ব তোমার হাতে সমর্পণ করে
দেবো, এবং তোমাকে ছাড়া ছোট-বড়
কোনো সমস্যারই সমাধান করবো না;
কিংবা যদি এমনও হয় যে, তুমি কোনো
রাজা-বাদশাহ হতে চাচ্ছো, ঠিক আছে,
আমরা তোমাকে আমাদের বাদশাহ
পদে অধিষ্ঠিত করে দিচ্ছি। মাঝে মাঝে
তোমার নিকট আগমন করে যে, সে
যদি জিন হয় কিংবা ভূতপ্রেত হয়,
যাকে তুমি দেখছো অথচ নিজে নিজে
তার কু-প্রভাব পারছো না প্রতিহত
করতে, তাহলে আমরা তোমার সব
চিকিৎসার ব্যয়-ভার বহন করবো
এবং সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত
চিকিৎসা চালিয়ে যাবো। কখনো কখনো
এমনও হয় যে, কারো কারো 'পরে জিন-
ভূতেরা আছর করে; কবিরাজ ডেকে
ঝাড়-ফুঁক করলে তা ভালো হয়ে যায়।"
যখন থামলো উতবাহ, মহম্মদ
বললো, "আবুল ওয়ালিদ, তোমার কি
কথা বলা শেষ? " সে বললো, "হ্যাঁ।" "বেশ।
তাহলে আমার কথা শোনো" বলে বলা
আরম্ভ করলো মহম্মদ কোরানের
আশ্চর্য অধ্যায় ‘ফুসসিলাত'—"হা-মিম।
অত্যন্ত করুণাময়, পরম দয়ালু
আল্লাহর নিকট হতে এটি অবতীর্ণ।
এটি অবতীর্ণ আরবি ভাষায়, যার
আয়াত বিশদভাবে বিবৃত কেবল
জ্ঞানীদের জন্য। এটি সুসংবাদদাতা
আর ভয়প্রদর্শক; কিন্তু অধিকাংশ
মানুষই বিমুখ। তাই তারা শুনবে না।
তারা বলে, ‘যে-কথার প্রতি আমাদের
তুমি ডাকো, সে-ব্যাপারে আমাদের চিত্ত
পর্দাবৃত, কর্ণ বধির। তোমার আর
আমাদের আছে এক দেয়াল। সেহেতু
তুমি নিজ কাজ করো এবং আমরা
আমাদের কাজ করি।' বলো, "আমি তো
তোমাদেরই মতো মানুষ; আমার কাছে
ওহি আসে—‘তোমাদের প্রভু এক আল্লাহ।'
তাই তাঁরই পথে চলো, আর তাঁরই কাছে
ক্ষমা চাও। দুর্ভোগ তো মুশরিকদের
জন্য, যারা যাকাত দেয় না। পরকালে
ওরা অবিশ্বাসী। যারা বিশ্বাস করবে,
সৎকাজ করবে, তাদের জন্য আছে
অফুরস্ত পুরস্কার।' বলো, ‘তোমরা কি
তাঁকে অস্বীকার করবেই, যিনি সৃষ্টি
করেছেন পৃথিবী দু-দিনে? তোমরা কি
তাঁর সমকক্ষ খুঁজছো? তিনি তো বিশ্ব-
জগতের রব। তিনি ভূ-পৃষ্টে স্থাপন
করেছেন অটল পর্বতমালা, আর
পৃথিবীতে রেখেছেন কল্যাণ, এবং
চার দিনে করেছেন খাদ্যের ব্যবস্থা
এতে, সমভাবে, সকল প্রার্থীর জন্যে।
এরপর তিনি মনোনিবেশ করেন
আকাশের দিকে, যা ছিলো ধুয়ার কুঞ্জ।
অতঃপর তিনি তাকে আর পৃথিবীকে
ডেকে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আসো
ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়।' তারা বললো,
‘আমরা স্বেচ্ছায় আসলাম।' অতঃপর
তিনি দু-দিনে আকাশমণ্ডলীকে করে
দিলেন সপ্ত আকাশ এবং প্রত্যেক
আকাশের কাছে তাঁর আদেশ প্রেরণ
করলেন, এবং নিচের আকাশকে
উজ্জ্বল প্রদীপমালা দ্বারা করলেন
সুশোভিত, আর করলেন সুরক্ষিত।
এটি পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর
অপূর্ব ব্যবস্থাপনা। অতঃপর যদি
তারা মুখ ফেরায়, তাহলে বলো, ‘আমি
তোমাদের এক কঠিন শাস্তি সম্পর্কে
সতর্ক করছি, যে-শাস্তির সম্মুখীন
হয়েছিল আদ ও সামুদ।'" মহম্মদ
পাঠ করতে থাকলো, যতক্ষণ না সে
পৌঁছে গেল অধ্যায়ের শেষ প্রান্তে। আর
উতবাহ তার দু-কানের মধ্যে দুটি
আঙুল ঢুকিয়ে বলতে থাকলো, "ওহে
মহম্মদ! থামো! থামো! " একথা বলতে
বলতে সে ছুটে গেল সঙ্গীদের কাছে।
তার চোখ-মুখ দেখে তারা বলাবলি
করতে লাগলো, "উজ্জার কসম! সে যে-
মুখ নিয়ে গিয়েছিল, সে-মুখ নিয়ে সে
ফিরে আসছে না।" তারা জিজ্ঞেস করলো,
"হে আবুল ওয়ালিদ! খবর কী, বলো।"
সে বললো, "আমি শুনেছি এমন এক
কথা, শুনিনি যা কোনোদিনই। লাত আর
উজ্জার কসম! সে-কথা কবিতা নয়,
যাদুও তা নয়। শোনো, কুরাইশগণ,
তাঁকে তাঁর অবস্থায় ছেড়ে দাও। তাঁর
মুখ থেকে যে-বাণী শ্রবণ করলাম,
লাতের কসম, অতিশয় গুরুতর
কিছু অবশ্যই ঘটে যাবে। তাঁকে যদি
হত্যা করে ফ্যালে কোনো আরবী, তাহলে
বেঁচে গেলে তোমরা ঝামেলা থেকে। আর
যদি সে বিজয়ী হয়ে যায়, তাহলে তো
তোমরাই তাঁর রাজত্বের ভাগীদার।"
লোকেরা বললো, "হে আবুল ওয়ালিদ,
তোমার উপরও দেখি পড়ে গেছে তাঁর
জাদুর প্রভাব! " সে বললো, "যা-ই বলো,
আমি যা বুঝেছি, তা-ই শুধু বললাম।"
আবুল হাকাম বললো সক্রোধে, "ওহে
কুরাইশগণ! আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি—
কাল সকালে, সহজে তোলা যায়, কিন্তু
ভারী, এরকম একটা পাথর নিয়ে
আমি বসে থাকবো; যখন মহম্মদ
এসে সিজদায় যাবে, সে-পাথর মেরে
তাঁর মাথা চূর্ণ করে ফেলবো, তখন
তোমরা আমাকে একা ফেলে রেখে যদি
পলায়ন করো, তাতেও একাজ থেকে
বিরত হবো না আমি।" লোকেরা বললো,
"ওহে আমর ইবনে হিশাম! তোমাকে
কিছুতেই একা ফেলে পালিয়ে যাবো না
আমরা। নিশ্চিন্তে তুমি তোমার সিদ্ধান্ত
কার্যকর করে ফ্যালো।" যখন সকালে
কাবাগৃহে এসে মহম্মদ সিজদায়
গেল, আবুল হাকাম পাথর উঠিয়ে
অগ্রসর হলো তাঁর দিকে। কিন্তু তাঁর
কাছে পৌছোবার আগেই, সে পরাজিত
সৈনিকের মতো হঠাৎ পশ্চাৎ দিকে
ফিরতে লাগলো। ভয়ে শক্ত হয়ে গেছে
তার মুখ। চোখজুড়ে হলুদ আতঙ্ক।
কুরাইশগণ তার কাছে গিয়ে বলে,
"ওহে আবুল হাকাম! কী হলো হঠাৎ? "
সে বললো, "আমি দেখলাম ভয়ঙ্কর
এক উট। এরকম ঘাড় আর দাঁত
কখনো দেখিনি আগে। সে আমাকে তেড়ে
নিয়ে এলো। মনে হলো, আমাকে খেয়েই
ফেলবে সে।" তা শুনে নেকড়ে-বাঘ দেখা
কুকুরের মতো লেজ তুলে দৌড় দিলো
পৌত্তলিকগণ। সন্ত্রস্ত আবু জেহেলও
দৌড়াতে লাগলো পাছপাছ। মহম্মদ
ডুবেই রইলো তাঁর মালিকের ধ্যানে।
লোকেরা বললো, "তাঁর মতো জাদুকর
দেখিনি আমরা আগে।" একজন বলে,
"সে যা-ই বলে, তা-ই তো হয়। একদিন
আবু লাহাবের পুত্র উতায়বা গিয়ে
তাঁকে বললো, ‘মানি না তোর ‘অন নাজমি
ইযা হাওয়া' ও ‘ছুম্মা দানা ফাতাদাল্লা'
এ-আয়াত দুটি।' বলেই সে তাঁকে ব্যঙ্গ-
বিদ্রূপ করতে থাকলো। সে তাঁর কোর্তা
ছিঁড়ে নষ্ট করে দিলো। এমনকি তাঁর
মুখে থুতু নিক্ষেপ করলো। মহম্মদ
বলে উঠলো, ‘হে আল্লাহ, তোমার কুত্তা-
সমূহের মধ্য থেকে একটিকে এর
পিছনে লেলিয়ে দাও।' এরপর সে তো
লোকদের সাথে এক কাজে শামদেশে
গেল। জারকা নামক স্থানে গিয়ে তারা
স্থাপন করলো তাবু। রাত হয়ে গেলে
এক বাঘ এসে তাদের তাবুর পাশে
করতে লাগলো ঘোরাঘুরি। উতায়বা
চীৎকার করে বলতে লাগলো, ‘হায়!
আমার ধ্বংস! আমার ধ্বংস! সে তো
খেয়ে ফেলবে আমাকে। দ্যাখো, আমি আছি
শামদেশে, আর মক্কা থেকে মহম্মদ
হত্যা করে ফেলছে আমাকে! ' লোকজন
শোওয়ার সময় তাকে মাঝখানে রেখে
শুলো, যাতে বাঘ এসে নাগাল না পায়
তার। কিন্তু তারা যেই ঘুমিয়ে পড়লো,
বাঘ এসে সবা'কে ডিঙিয়ে ঠিকঠিকই
তুলে নিয়ে গেল তাকে, তার দেহ থেকে
মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে দিলো পুরোপরি।"
ভয়ে শিউরে উঠলো সবার শরীর।
তারা লাত, উজ্জা আর হুবালের
নাম ধরে আর্তনাদ করতে লাগলো
আর বলতে লাগলো, "হায় আমাদের
প্রাণ! হায় আমাদের অভিশপ্ত ভাগ্য!
আমাদের কী হবে? কী হবে আমাদের? "
এক উজ্জ্বল জোছনারাতে মহম্মদ
যখন মিনায় অবস্থান করছিল,
কুরাইশগণ ছুটে এলো তাঁর কাছে।
তারা বললো, "হে মহম্মদ! যদি তুমি
সত্যিকার নবি হয়ে থাকো, এ-মুহূর্তে
এ-চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করে দেখাও তো! "
সে বললো, "যদি দেখাই? " বললো তারা,
"তাহলে আমরা ধরে নেবো, আসলেই
তুমি সত্য-নবি।" সে বললো, "তাই? " তারা
বললো, "হ্যাঁ।" তখন সে আকাশের দিকে
হাত তুলে অঙ্গুলি ইশারা করতেই
দুই ভাগ হয়ে চাঁদ সরে গেল দুই
দিকে। এক খণ্ড সরে গেল কাইকাআন
পাহাড়ের দিকে আর অন্য খণ্ড আবু
কুবাইস পাহাড়ের দিকে। মাঝখানে
দেখা গেল হেরা পর্বত। সেখানে যারা
উপস্থিত ছিলো, তাদেরকে ডেকে বলে
উঠলো সে, "দ্যাখো! দ্যাখো আর সাক্ষ্য দাও।"
অতঃপর খণ্ড দুটি জোড়া লেগে গেল।
তারা তা দেখলো অবাক বিস্ময়ে; দেখে
বলে উঠলো, "মহম্মদ! তুমি তো আশ্চর্য
জাদুকর! এ কেমন জাদুকর তুমি! "
সে বললো, "আমি কি কখনো মিথ্যে বলি? "
তারা বললো, "না।" কিন্তু একজন বলে
উঠলো, "সে পৃথিবীর সব মানুষকে
জাদুগ্রস্ত করতে পারবে না। সুতরাং
তোমরা অপেক্ষা করো। নানা স্থান থেকে
লোকেরা আসুক। তাদের জিজ্ঞেস করো
তারাও দেখেছে কিনা তোমাদের মতো।"
তারা অপেক্ষা করলো। দূর-দূরান্তর
থেকে যারা এলো, তাদেরকে ডেকে তারা
জিজ্ঞেস করলো। তারাও বললো, তারা
এমনই দেখেছে। কিন্তু আবুল হাকাম
উঠলো গর্জন করে, "লাতের কসম!
কক্ষনো না! চাঁদ দ্বি-খণ্ডিত হওয়ার
নয়। সে-মিথ্যুক। বরং সে ভয়ঙ্কর
জাদুকর। সে যা বলছে, আমরা তাতে
সায় দিচ্ছি। সে যা দেখাচ্ছে, আমরা দেখে
বাহবা দিচ্ছি। আসলে সে গোটা জাতিকেই
মোহগ্রস্ত করে রেখেছে। যে-কোনো মূল্যে
পৃথিবী থেকেই মুছে ফেলতে হবে তাঁর
চিহ্ন আমাদের, পুরোপুরি। তা না হলে
অচিরেই আমরা সবাই চিরতরে
ধ্বংস হয়ে যাবো। সুতরাং ভাইসব,
আসুন আমরা একত্রিত হয়ে যাই;
ভুলে যাই সব দ্বন্দ্ব, সব ভেদাভেদ;
আসুন সকলে এককণ্ঠে বলে উঠি:
"বেদীন নিপাত যাক। আবু তালিবের
ভ্রাতুষ্পুত্র মহম্মদ বিন আব্দুল্লাহ
ধ্বংস হোক।" বললো সবাই সমস্বরে,
"মহম্মদ বিন আব্দুল্লাহ ধ্বংস হোক।"
কুরাইশদের মতি-গতি দেখে আবু
তালিব পড়লো আতঙ্কিত হয়ে। তাঁর
ভ্রাতুষ্পুত্রকে যে হত্যা করতে চাচ্ছে তারা,
তা আঁচ করতে পেরে, অতি দ্রুত তাঁর
প্রপিতামহ আবদে মানাফের দু-পুত্র
হাশিম ও মুত্তালিব বংশধারার
পরিবারবর্গকে করলো একত্রিত।
সে উদ্বিগ্নকণ্ঠে বলে উঠলো, "আমরা কি
বসে বসে আঙুল চুষবো, আমাদের
সামনে দিয়ে যখন বনু হিশামের
খচ্চরেরা আমাদের পুত্র মহম্মদকে
ধরে নিয়ে যাবে, তাঁকে হত্যা করে তাঁর
লাশের উপর উল্লুকের মতো নৃত্য
করবে আর আনন্দ-উল্লাস করবে?
গোটা আরবজাহান বনু হাশিম ও
বনু মুত্তালিবদের মর্যাদার কথা
জানে। যখন জানবে, যে-কাবা ধ্বংস
করতে এসে আবরাহা পর্যুদস্ত হয়ে
ফিরে গিয়েছিল, পবিত্র সেই কাবার
রক্ষকদের পুত্রকে কুরাইশদের
কিছু কাপুরুষ হত্যা করেছে, তখন
কেমন লাগবে আমাদের? হে আমার
আত্মীয়-স্বজন, আবুল হাকাম তার
লোকজন নিয়ে আমার নিকট এসে
বললো, ‘ওয়ালিদ বিন মুগিরার পুত্র
ওমারাকে আপনি নিজের পুত্র করে
নিন। বিনিময়ে আপনার ভাতিজাকে
তুলে দিন আমাদের হাতে। আমরা তাঁকে
হত্যা করে ফেলবো।' এখন তোমরাই
বলো আমার কী করণীয়।" উত্তেজিত
হয়ে ওঠে দু-গোত্রের লোকজন। তারা
বললো, "হে আমাদের নেতা, লাত আর
উজ্জার কসম! কাপুরুষ ছিলেন না
আমাদের পিতা-পিতামহগণ; আর
তাঁরা জন্ম দিয়ে যাননি অথর্ব কোনো
কাপুরুষদেরকে। আমরা আমাদের
প্রিয় ভ্রাতা আব্দুল্লাহর পুত্র মহম্মদকে
দেবো না কখনো তুলে ভেড়াদের হাতে।
আমরা সর্বস্ব দিয়ে তাঁর নিরাপত্তা,
আশ্রয় ও সমর্থন দিয়ে যেতে থাকবো।"
যখন আবুল হাকামের কানে গিয়ে
পৌছোলো তাদের বৈঠকের কথা, বোকা
বনে গেল সে। কাফের-মুসলিমগণ
মহম্মদের পক্ষেই এক হয়ে গেছে,
জানতে পেরে সে হা-হুতাশ করতে করতে
ছুটে গেল আবু লাহাবের কাছে। তারা
আহত সিংহের মতো গোঙরাতে থাকলো
শোকে, আর খুঁজতে থাকলো পথ, কোন্
পথে সমূলে বিনাশ করা যায় বনু
হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রকে। সে-
উদ্দেশে সর্বত্র দৌড়াতে লাগলো তারা,
যেভাবে লাশের দিকে দৌড়ায় শকুন।
কুরাইশদের ঘরে ঘরে গিয়ে তারা
উত্তেজিত করে তুললো তাদের। তারা
মুহাসসাব নামক উপত্যকায় গিয়ে
একত্রিত হলো। বাগিয বিন আমির
তাদের শোনালো এক একরারনামা
পাঠ করে। তারা অঙ্গীকার করলো যে,
বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের সাথে
তারা বন্ধ করে দেবে সব ধরনের
বেচা-কেনা, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য,
উঠা-বসা, কথাবার্তা ও বিবাহ-শাদী।
বনু হাশিমের পক্ষ হতে কোনো সন্ধি-
চুক্তির প্রস্তাব এলে তারা তা গ্রহণ
করবে না, যতদিন মহম্মদকে না
তারা সমর্পণ করবে তাদের হাতে।
এ একরারনামাটি ঝুলিয়ে দেওয়া
হলো কাবার দেয়ালে। আবু তালিবের
মাথায়ই ছিলো না, এরকম ঘৃণ্য কোনো
পদক্ষেপ নিতে পারে কুরাইশগণ।
আতঙ্কিত হয়ে বনু হাশিম ও বনু
মুত্তালিব আশ্রয়গ্রহণ করলো গিয়ে
‘শিয়াবে আবু তালিব' গিরি-সংকটে।
একরারনামার লেখক বাগিযের
প্রতি মহম্মদ দিলো বদদোয়া। সেই
রাতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে, রইলো সে
পড়ে বিছানায় নির্বাক, নিশ্চুপ। স্থির
তার চোখের পাতায় করে এসে ভিড়
মহম্মদের আশ্চর্য ইন্দ্রজালের ভয়
আর কেঁপে কেঁপে ওঠে জন্মান্ধ হৃদয়।
-------
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem