Nabinama (নবিনামা) , An Epic: Canto-5 Poem by Sayeed Abubakar

Nabinama (নবিনামা) , An Epic: Canto-5

নবিনামা
সায়ীদ আবুবকর
*** *** *** ***
পঞ্চম সর্গ

দাবানল

দিয়াশলাইয়ের ছোট্ট একটা কাঠি, কত
নগণ্য অথচ তার জীর্ণশীর্ণ বুকে
কি-বিপুল বৈশ্বানর, সুযোগ পেলেই
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়
অরণ্য নগর গ্রাম! আর আরশের
মহাঅধিপতি পাঠালো যে মহাবাণী,
তা যেন এ্যাটেম বোমা! মহম্মদ
পকেটে আগুন নিয়ে কি-দিব্যি মক্কার
অলিতে গলিতে চলে! চলতে চলতে
হঠাৎ সে একদিন থমকে দাঁড়ায়
পথে। কানে এসে বাজে গায়েবি আওয়াজ।
আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইতেই,
অন্তরাত্মা ওঠে কেঁপে। দেখতে পায় সে
হেরাগুহার সে ফেরেস্তাকে ফের, স্বীয়
মূর্তি ধারণ করে যে—কি-বিশাল তনু! —
বসে আছে অন্তরীক্ষ আর পৃথিবীর
মাঝখানে তাঁর নিজস্ব কুরসিতে! দেখে
ভয়ে ও বিস্ময়ে তাঁর বুজে এলো চোখ।
ছুটে চললো সে ঊর্ধ্বশ্বাসে খাদিজার
কাছে। "হে খাদিজা, আমাকে চাদর দিয়ে
ঢেকে দাও দ্রুত ", বললো সে।কম্পমান
স্বামীকে খাদিজা চাদরে আবৃত করে
জপতে লাগলো মহান স্রষ্টার নাম।
তৎক্ষণাৎ অবতীর্ণ হলো ওহি—‘ইয়া
আইয়ুহাল মুদ্দাসসির। কুম ফাআন
যির। ওয়া রাব্বুকা ফাকাব্বির। ওয়াসিয়া
বাকা ফাতাহ্হির। ওর্য়ারুজ্জা ফাহ্জুর।
-- হে চাদরাবৃত! ওঠো, হুঁশিয়ার করো;
শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো তোমার রবের;
এবং পবিত্র রাখো তোমার পোশাক।'

প্রকৃতিস্থ হলে, খাদিজা উঠলো বলে,
‘কী হলো তোমার? এখনো যে চোখে-মুখে
লেগে আছে সেই ভীতি! " বললো মহম্মদ,
"আমি তো দেখতে পাচ্ছি এখনো, খাদিজা,
তাঁকে! " বসিয়ে স্বামীকে ঊরুর উপর,
খাদিজা বললো, "এখনো দেখতে পাও? "
"দেখা যাচ্ছে ওই! এখনো যে দেখা যায়! "
খাদিজা তখন খুঁজতে লাগলো পথ
কিভাবে স্বামীর কাটানো যায় এ ঘোর।
কী ভেবে হঠাৎ বক্ষদেশ থেকে তাঁর
সরিয়ে কাপড়, বসালো আবার তাঁকে
ঊরুর উপর। অতঃপর বললো সে,
"কাশেমের বাপ, এখন কি দেখা যায়? "
মহম্মদ বললো, "না। নেই সে কোথাও
আর! হয়তো সে গেছে চলে।" তাই শুনে
বললো খাদিজা, "ওহে আবুল কাশেম,
এবার আনন্দ করো। ইনি জিব্রাইল।
খোদার কসম! ইনি সেই জিব্রাইল।
শয়তান যদি হতো, উন্মুক্ত আমার
বক্ষদেশ দেখে এভাবে যেতো না চলে;
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতো সে
নারীর সৌন্দর্য। নিষ্কলুষ, ফেরেস্তারা;
কখনো নারীর নগ্ন শরীরের দিকে
নজর দেবে না তাঁরা। হর্ষোল্লাস করো,
ইনি ওরাকার বলা সেই জিব্রাইল-ই।"

সহধর্মিণীর ধী-শক্তি দর্শনে মুগ্ধ
মহম্মদ বলে উঠলো সানন্দে, "ঠিকই
বলেছো, খাদিজা। ইনি সেই জিব্রাইল,
বার্তাবাহক মহান আল্লাহর। আমাকে
শেখালেন তিনি পাক-পবিত্রতা। আর
দিয়ে গেলেন নির্দেশ, যেন পৌছে দেই
পবিত্র কালাম এই, মানুষের কাছে।
আমাকে পাঠানো হয়েছে রসুল করে,
যার দায়িত্ব সতর্ক করা, মানুষকে
বাঁচানো জ্বলন্ত জাহান্নাম থেকে আর
মানবজাতির মধ্যে মহান আল্লাহর
শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করা। যে আনবে ঈমান
আল্লাহ ও রসুলের 'পর, দুনিয়া ও
আখিরাতে হবে সে সফলকাম। তাঁর
কোনো ভয় থাকবে না। তাকে দেয়া হবে
জান্নাত মৃত্যুর পর, অনন্তকাল সে
থাকবে সেখানে, আর পাবে শুধু শান্তি
আর শান্তি। যে তাঁর নির্দেশ চলবে মেনে,
সে হবে মুসলিম। তার ধর্ম হবে ইসলাম।"
খাদিজা বললো, "স্বামী, তাহলে আমিই
প্রথম সে ব্যক্তি, নিলাম যে মেনে বিনা
শর্তে তোমার এ-ধর্ম। এখন আমার
কী দায়িত্ব, বলে দাও।" মহম্মদ তাঁকে
কলেমা পড়িয়ে, মহান স্রষ্টার কাছে
করলো প্রার্থনা হাত তুলে। খাদিজার
অন্তর উঠলো কেঁপে। আহা-কি অপূর্ব
অনাবিল অনুভূতি! সব কিছু যেন
মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেছে পাক-সাফ!
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'র আকস্মিক স্পর্শে
দুচোখে নেমেছে জ্যোতি, পবিত্র আলোয়
ভরে গেছে, আহা, জীবনের ঘরদোর!
শান্তি শান্তি সৌরভে-সঙ্গীতে করতেছে
মৌ মৌ হৃদয়-শরীর! আনন্দ-অশ্রুতে
ভিজিয়ে দুচোখ, নবি আর নবি-পত্নী
জানালো শুকরিয়া স্রষ্টার দরবারে।

ইসলাম এমন-এক চুম্বক, টানে যা
চুপিচুপি প্রচণ্ড শক্তিতে সত্যান্বেষী
মানুষের অন্তর, যেভাবে টেনে নেয়
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল লোহার জাহাজ
অথই গহ্বরে। উঠতি কিশোর আলী
মহম্মদের সাথেই থাকতো তখন,
আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর
যেভাবে থাকতো মহম্মদ একদিন
আবু তালিবের গৃহে। যখন আলীর
কানে গিয়ে পৌঁছোলো এ-পবিত্র কালাম,
সেভাবে সে ছুটে এলো ঈমানের দিকে
যেভাবে পতঙ্গ আগুনের দিকে ছুটে
যায়। সেইদিনই খাদিজার মুক্ত করে
দেওয়া ক্রীতদাস যায়দ বিন হারিসা
বিন শুরাহ্বিল কালবি-ও হয়ে গেল
মুসলিম। আবুবকর ইবনে কুহাফা,
বুঝি কোন্ অদৃশ্যের ডাকে, ছুটে এলো
মহম্মদের সন্ধানে। "হে আবুবকর! "
বললো মহম্মদ, "জিব্রাইল এসেছিল
আমার নিকট। আমাকে নির্দেশ দেওয়া
হয়েছে, সমস্ত মানুষের কাছে যেন
পৌঁছে দেই পবিত্র এ-বাণী।" বলেই সে
শোনালো আবৃত্তি করে তাঁকে অবতীর্ণ
হওয়া সেই পবিত্র কালাম। অতঃপর
বললো সে, "শোনো, আমি সর্বশেষ নবি।
আমাকে পাঠানো হয়েছে রসুল করে।
যে-ব্যক্তি বিশ্বাস করে আল্লাহ ও তাঁর
রসুলের 'পর, জীবনের সমুদয়
গোনাহ তার মাফ করে দেওয়া হবে। তাকে
জান্নাত দেওয়া হবে, যার নিচ দিয়ে
বয়ে গেছে চারটি নহর। সেখানে সে
থাকবে অনন্তকাল। সেখানে বর্ষিত
হবে তার 'পরে ‘সালাম! সালাম! '" শুনে
বললো আবুবকর, "আপনি সত্যই
বলেছেন, মহম্মদ; কারণ শুনিনি
মিথ্যা বলতে কখনো আপনাকে।" নও-
মুসলিমগণ ‘সোবহানাল্লাহ! ' বলে
জানালো শুকরিয়া স্রষ্টার দরবারে।
আবুবকর বললো, "হে আল্লাহর নবি!
বলুন, এখন থেকে আমার কী কাজ? "
"আমার যে-কাজ, শোনো, তোমারও সে-কাজ।
মানুষকে তুমি গোপনে ডাকতে থাকো
আল্লাহতায়ালার একত্ববাদের দিকে,
যে-পর্যন্ত না প্রকাশ্য দাওয়াতের আমি
পাই কোনো নির্দেশনা আসমান থেকে।"

ছড়িয়ে পড়লো আগুন অন্তর থেকে
অন্তরে গোপনে গোপনে। ভিড়তে লাগলো
সমাজের উচ্চ স্তর থেকে শুরু করে
নিম্ন স্তর পর্যন্ত সমস্ত তবকার
লোক চির শান্তির এ-ধর্মে চুপিসারে।
বিপ্লবী এ-ধর্ম ধনী-গরিবের, সাদা
ও কালোর মুছে দেছে সব ভেদাভেদ;
নারী ও পুরষে করে না বৈষম্য; বলে,
জেনা-ব্যভিচার, জুয়া, সুদের কারবারি,
কন্যাশিশুহত্যা, ধর্ষণ, লুটতোরাজ,
চৌর্যবৃত্তি সম্পূর্ণ হারাম; বলে, সে-ই
উত্তম, উত্তম যার কাজ! এ-মুলুকে
এরকম কথা কখনো শোনেনি তারা।
একে একে হলো দীক্ষিত এ-ধর্মে সাদ
বিন আবি ওয়াক্কাস, উসমান বিন
আফফান, তালহা বিন উবাইদুল্লাহ,
আব্দুর রহমান বিন আউফ, আম্মার
বিন ইয়াসির, তার পিতা ইয়াসির,
মাতা সুমাইয়া, আবু সালামাহ বিন
আব্দুল আসাদ মাখযুমী, যুবায়ের,
উবাইদা বিন হারিস বিন মুত্তালিব
বিন আবদে মানাফ, সাঈদ বিন যায়দ,
তার স্ত্রী ফাতিমা বিনতে খাত্তাব, উম্মু
আয়মান বারাকাত হাবশী, আসমা
বিনতে আবুবকর, আব্দুল্লাহ বিন
মাসউদ, বেলাল বিন রিবাহ হাবশী,
আব্দুল্লাহ বিন জাহশ প্রমুখ প্রায়
তিন শত ত্রিশ জন নারী ও পুরুষ।
হোক ধনী, হোক ক্রীতদাস, কিন্তু যেই
পড়ে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ', হয়ে যায়
তার একটাই পরিচয়— মুসলিম।
এমন সাম্যের গান এ-মুলুকে কেউ
শোনেনি কখনো আগে। মহম্মদ তাঁর
অনুসারীদের নিয়ে গোপন বৈঠকে
বসতে লাগলো এখানে-ওখানে, যাতে
পেতে পারে তাঁরা ওহির খবর আর
ইবাদতের নতুন দিক-নির্দেশনা।
কখনো মনুষ্য রূপে আসে জিব্রাইল,
কখনো বা নিজস্ব সুরতে। কখনো বা
টুং টাং শব্দ করে, করে আগমন;
নবিকে তখন ঢেকে দেওয়া হয় বস্ত্রে;
তাঁর উপর অবতীর্ণ হতে থাকে ওহি;
সে-ওহির ভারে ললাট দিয়ে ঝরতে
থাকে ঘাম। এভাবেই চলতে চলতে
কেটে গেল তিনটি বছর। প্রার্থনার
সময় হলেই গোপন ঘাঁটিতে গিয়ে
মুসলিমগণ পড়তো সালাত, যাতে
জানতে না পারে কেউ। কিন্তু কত দিন
লুকিয়ে লুকিয়ে চলে প্রণয়ের খেলা?
লোকে টের পায়, মহম্মদ আর তাঁর
অনুসারীগণ চলছে আলাদা পথে।
একদিন চাচা আবু তালিব আলী ও
মহম্মদকে দেখে ফ্যালে ঘরের ভিতর
সিজদায় অবনত। সে জানতে চায়,
কী করছিল তাঁরা। সব কথা শুনে
সে বললো, "এর 'পরে দৃঢ় হয়ে থাকো।"
আবু লাহাবেরও হয়েছিল এ-সন্দেহ—
মহম্মদ ভিন্ন হয়ে গেছে; মানুষের
মাঝে ছড়াচ্ছে বিভ্রান্তি দেব-দেবী নিয়ে;
হয়তো নতুন ধর্ম কোনো করেছে সে
আবিষ্কার, ভিড়ছে যেখানে লোকজন।

যে-সমাজ ডুবে গেছে পৌত্তলিকতার
নগ্ন অন্ধকারে; যে-মানুষ মজে আছে
খামখেয়ালিপনার চূড়ান্ত উল্লাসে;
যেখানে অন্ত্যজজন শোষণে-শাসনে
করছে আর্তনাদ; যেখানে বিলুপ্ত বোধ,
জেগে আছে শুধু কাম-ক্রোধ-মাৎসর্য;
কী করে সেখানে, হায়, লুকিয়ে লুকিয়ে
আসবে মানবমুক্তি, ঈপ্সিত বিপ্লব?
না আসলে ভূমিকম্প, মৃত-জরা এই
পাষাণপৃথিবী এমনি এমনি নড়ে?
অবতীর্ণ হলো তাই বিপ্লবী এ-বাণী—
‘ওয়া আনযির আশিরাকাতাল আক্রা
বিন।-আর তুমি সতর্ক করো তোমার
নিকটতম আত্মীয়স্বজনদেরকে।'
লুকানোর আর রইলো না অবকাশ।
ঝেড়ে ফেলে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব, মহম্মদ
বনু হাশিম গোত্রকে ডেকে একদিন
করলো একত্রিত। কিন্তু তাঁকে কোনো কথা
বলার সুযোগ না-দিয়ে দাঁড়ালো উঠে
আবু লাহাব, দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, "দ্যাখো,
এঁরা সকলেই তোমার নিকটাত্মীয়,
চাচা ও চাচাতো ভাই। তোমার উচিত
বাচালতা বাদ দিয়ে ভালো কথা বলা।
আর জেনে রাখো, তোমার জন্যে তাবৎ
আরববাসীর সঙ্গে শত্রুতা করার
শক্তি আমাদের নেই। সবার উচিত
এখনি তোমাকে কারারুদ্ধ করে রাখা।
তুমি যে বংশের মুখে চূণকালি দিয়ে
ডুবাবে আমাদেরকে, তা আমার জানা।
সুতরাং কেউ এর কথা শুনবে না।
ও তো পাগল-উন্মাদ ছাড়া কিছু নয়।"
আবু লাহাবের কথা শুনে, মুখ বুজে
কেটে পড়তে লাগলো, এসেছিল যারা।
শূন্য আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল করে
তাকিয়ে রইলো মহম্মদ। এভাবেই
হয়ে গেল ভণ্ডুল প্রথম সম্মেলন।

এরপর একদিন নিজের গোত্রকে
ডাকলো সে ফের। লোকজন উপস্থিত
হলে বলতে আরম্ভ করলো, "সমুদয়
প্রশংসা আল্লাহর। আমি তাঁর স্তুতি করি।
সাহায্য প্রার্থনা করি তাঁর। তাঁরই ‘পরে
বিশ্বাস স্থাপন করি। নির্ভর করছি
তাঁর উপরেই। অতঃপর সাক্ষ্য দিচ্ছি,
কেউই, আল্লাহ ছাড়া, উপাসনার যোগ্য
নয়। তিনি একক এবং অদ্বিতীয়।
তাঁর কোনো অংশীদার নেই। শুনে রাখো,
কোনো পথ-প্রদর্শক আপন আত্মীয়-
স্বজনকে বলতে পারে না মিথ্যা। সেই
আল্লাহর শপথ, যিনি ছাড়া নেই কোনো
উপাস্য আর; বিশেষভাবে তোমাদের
জন্য আর সাধারণভাবে পৃথিবীর
সব মানুষের জন্য, প্রেরিত হয়েছি
আমি নবিরূপে। তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো
যেমনটি বিছানায় শুয়ে, সেইভাবে
সম্মুখীন হবে তোমরা মৃত্যুর; আর
যেমনটি জেগে ওঠো ঘুমন্ত অবস্থা
থেকে, সেইভাবে হবে তোমরা উত্থিত
পুনরায়। সেদিন হিসাব নেয়া হবে
তোমাদের সমস্ত কর্মের। যারা ভালো
কাজ করে, তাদেরকে প্রবেশ করানো
হবে চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির আবাস
জান্নাতে এবং যারা পাপী, তাদেরকে
চিরস্থায়ী দুঃখের আবাস জাহান্নামে।"

কথা শেষ হলে বললো আবু তালিব,
"প্রশ্ন করো না, তোমার জন্য কতটুকু
সাহায্য করতে পারবো আমরা, আর
কতটুকুই বা গ্রহণযোগ্যতা পাবে
তোমার এ-উপদেশ আমাদের কাছে,
এবং তোমার কথাবার্তা সত্য বলে
কতটুকু মেনে নিতে পারবো আমরা।
উপস্থিত লোকজন তোমারই পিতার
পরিবারের সদস্য। তদ্রূপ আমিও;
পার্থক্য এটুকু, তোমার সহায়তায়
একটু, তাঁদের চেয়ে, অগ্রগামী আমি।
অতএব যে-নির্দেশাবলি অবতীর্ণ
হয়েছে তোমার 'পরে, তা তুমি সম্পন্ন
করে যাও। আল্লাহ চান তো, অবিরাম
আমি তোমাকে সাহায্য-সমর্থন করে
যাবো। তবে পিতা আব্দুল মুত্তালিবের
ধর্ম ত্যাগ করতে প্রস্তুত নই আমি।"

রাগে আলতার মতো লাল হয়ে ওঠে
আবু লাহাবের মুখ। "উজ্জার শপথ! "
সে বললো, "এ হচ্ছে অন্যায় আর যত
দুষ্টামি-নষ্টামি। এর হাত, অন্যদের
আগে, ধরে নাও তোমরাই।" শুনে আবু
লাহাবের কথা, উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলো
আবু তালিব, "আল্লাহর কসম! এ-দেহে
যতক্ষণ আছে প্রাণ, আমি দিয়ে যাবো
তাঁকে নিরাপত্তা আর করতে থাকবো
তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ।" প্রমাদ গুনলো
আবু লাহাব। হাসলো লোকজন, দেখে।

একদিন মহম্মদ উঠে গেল সাফা
পর্বতের চূড়ার উপর। তার 'পরে
একটি প্রস্তর রেখে, সেই প্রস্তরের
উপর দাঁড়িয়ে, "হায় প্রাতঃকাল! " বলে
করতে লাগলো আহ্বান মক্কার সব
গোত্রকে এভাবে—'ওহে বনু কুরাইশ!
ওহে বনু আবদে মানাফ! ওহে বনু
ফিহর! বনু আব্দুল মুত্তালিব! ওহে
বনু আদি! ওহে বনু আবদে শামস! "
যখন জানতে চাইলো তারা, "কে করছে
চীৎকার এইভাবে? " লোকেরা বললো,
"মহম্মদ।" তখন সবাই ছুটে গেল
সাফা পর্বতের নিচে। সে বলে উঠলো,
"ওহে কুরাইশগণ! আমি যদি বলি
পর্বতের অন্য দিকে ওঁৎ পেতে আছে
একদল পরাক্রমশালী শত্রুসেনা
তোমাদের জানমাল কেড়ে নেওয়ার
জন্য; তাহলে কি আমার কথার ‘পরে
বিশ্বাস স্থাপন করবে তোমরা? " তারা
বলে উঠলো, "নিশ্চয়! কারণ তোমাকে
শুনিনি আমরা মিথ্যা বলতে কখনো।"
সে বললো, "তবে শোনো, আমি তোমাদের
অনিবার্য কঠোর দণ্ডের কথা মনে
করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি।
কুরাইশগণ, তোমরা তোমাদেরকে
রক্ষা করো জাহান্নামের আগুন থেকে
এবং নিজেদেরকে আল্লাহর নিকট
সঁপে দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করো।
হে বনু কুসাই, তোমরা তোমাদেরকে
জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।
বনু কাব ইবনে লুআই, নিজেদেরকে
জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।
বনু কাব বিন মুররাহ, নিজেদেরকে
জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।
হে বনু আবদে মানাফ, নিজেদেরকে
জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো
কারণ আমি তো তোমাদের উপকার-
কিংবা অপকার কিছুই করার কোনো
ক্ষমতা রাখি না। বনু আবদে শামস,
হে বনু হাশিম, তোমরা তোমাদেরকে
জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।
হে বনু আব্দুল মুত্তালিব, নিজেদেরকে
জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো
কারণ আমি তো আল্লাহর নিকট কোনো
উপকারে আসবো না তোমাদের জন্য।
বনু আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব,
আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য
কোনো উপকারে-অপকারে আসবো না।
হে সুফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব,
আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকট
কোনো উপকারে-অপকারে আসবো না।
হে ফাতিমা বিনতে মহম্মদ, নিজেকে
জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো
কারণ তোমার জন্য আল্লাহর নিকট
আমি কোনো উপকারে আসবো না। তবে
তোমাদের সাথে আমার যে-আত্মীয়তা,
যথাযথভাবে রাখবো তা আমি ধরে।"

ভীতি প্রদর্শন করা তাঁর এ-বক্তব্য
শেষ হলে, লোকজন যার যার মতো
চলে গেল উঠে। কেবল আবু লাহাব
তাঁর কাছে এসে বললো সক্রোধে, "তোর
সর্বনাশ হোক! এখানে কি এজন্যই
একত্রিত করেছিস আমাদের? " বলে
ছুড়ে মারলো সে তাঁর দিকে একখণ্ড
প্রস্তর, ফেরেস্তা জিব্রাইল, তাঁর কাছে
পৌঁছানোর আগেই, যা ধরে ফ্যালে তাঁর
অলৌকিক হাতে। সাথে সাথে অবতীর্ণ
হলো—‘তাব্বাত ইয়াদা আবি লাহাবিও
ওয়াতাব। মা আগনা আনহু মালুহু
ওয়ামা কাসাব। সা ইয়াছ লা নারান
যা তা লাহাবিও ওয়া আমরা আতুহু
হাম্মা লাতাল হাতাব। ফি জি দিহা
হাবলুম মিম মাসাদ।- ধবংস হোক
আবু লাহাবের দুই হাত। ধ্বংস হোক
সে নিজে। আসেনি কোনো কাজে তার ধন-
সম্পদ আর যা উপার্জন করেছে সে।
সত্বরই সে প্রবেশ করবে লেলিহান
অগ্নিতে এবং তার স্ত্রীও, গলায় যে
খেজুরের রশি দিয়ে বয়ে চলে কাঠ।'

"শুনেছো? শুনেছো? " বলে ছুটতে ছুটতে
এলো আবু লাহাব। বললো উম্মে জামিল,
"আমি তাঁর চলার রাস্তায় কাঁটা পুঁতে
রাখি। আর সে কি-মনোযোগ দিয়ে তুলে
ফ্যালে সব কাঁটা, যেন রাস্তার মধ্যে সে
হারিয়ে ফেলেছে সোনা! " বলে ফেটে পড়ে
উন্মত্ত হাসিতে। স্বামী তার বলে, "শোনো,
আজ প্রাতেই সে জুড়ে দিলো অভিনয়।
সাফা পর্বতের 'পরে উঠে, কী কৌশলে,
ডেকে ডেকে করলো হাজির সবাইকে।
তারপর তাঁর সেই পুরনো প্যাঁচাল!
আমি তো পাথর ছুঁড়ে মারলাম রেগে।"
"মরেনি সে? " জানতে চাইলো উম্মে জামিল।
"সেজন্যে তো আমি কই, ও এক আশ্চর্য
জাদুকর! সে কেমন ভস্ম করে দিলো
গোটা সে-পাথর, কোথাও তা পেলাম না
আর খুঁজে।" এদিকে "শুনেছো? শুনেছো হে? "
বলতে বলতে ছুটে এলো ঊর্ধ্বশ্বাসে
আবুল হাকাম। বললো সে, "মহম্মদ
তোমাকে ও তোমার বউকে নিয়ে নাকি
কবিতা শোনাচ্ছে। সে-ই বানিয়েছে কিংবা
তাঁর কাছে আসে যে-শয়তানটা, সে-ই
শিখিয়ে দিয়েছে তাঁকে। কারণ সে মূর্খ,
লেখাপড়া শেখেনি সে। সে বলছে, তুমি
নাকি জাহান্নামে যাবে খুব শিগগির!
তুমি আর উম্মে জামিল সেখানে গিয়ে
পুড়তে থাকবে জ্বালানি কাঠের মতো! "

ফুঁসে উঠলো উম্মে জামিল, "কক্ষনো না!
ধৈর্যের একটা সীমা আছে মানুষের!
এক্ষুণি একটা বিহিত করেই তবে
ফিরবো আমি।" বলেই সে হয়ে গেল বের।
বলতে লাগলো আবুল হাকাম, "সব
দোষ তোমার ভা'য়ের। আবু তালিবের
প্রশ্রয়েই দেখাচ্ছে সে দুঃসাহস এত।"
বললো আবু লাহাব, "ঠিক আছে। চলো
তাঁর কাছে গিয়ে একদিন সকলেই
খুলে বলি সব কথা। তাঁকে রাগিয়ে তো
আমরা কেউই করতে পারবো না কিছু।"
"মন্দ বলোনি। তিনি তো কাবার রক্ষক;
আমাদের সকলেরই নেতা। যাওয়া-ই
যায় তাঁর কাছে। যাই একদিন চলো।"
বলে কেটে পড়লো সে দ্রুত, যেন রেখে
এসেছে সে তরকারি চুলার উপর।

মহম্মদ ছিলো কাবাগৃহে। সাথে ছিলো
আবুবকর। হাজির হলো এসে ক্রুদ্ধ
উম্মে জামিল। বললো হাঁফাতে হাঁফাতে,
"হে আবুবকর, কোথায় তোমার সঙ্গী?
উজ্জার শপথ! তাঁকে যদি এ-মুহূর্তে
পেতাম এখানে, তাঁর মুখের উপর
এ-কঙ্কর মারতাম ছুঁড়ে। তোমার সে
সঙ্গী নাকি আমাদের নিয়ে কি-সমস্ত
কুৎসা রটিয়ে বেড়াচ্ছে! তাহলে তাঁর
জানা উচিত, আমিও একজন উচ্চ
মানের মহিলা কবি। আমার কবিতা
শুনে রাখো—‘আমরা মন্দের সাথে কোনো
করিনি আপস। অমান্য করেছি তাঁর
নির্দেশ। করেছি প্রত্যাখ্যান তাঁর ধর্ম
ঘৃণ্য, নিকৃষ্ট এবং নিচু মনে করে।' "
এই বলে যে-পথে সে এসেছিল, ব্যর্থ-
মনোরথ সে-পথেই গেল চলে। বলে
উঠলো আবুবকর, "হে আল্লাহর নবি,
আপনি তো তাঁর সামনেই ছিলেন! সে কি
দেখতে পায়নি আপনাকে? " মহম্মদ
বললো "না, আমাকে দেখতে পায়নি সে।
ফেলে দেওয়া হয়েছিল এক পর্দা তার
ও আমার মাঝখানে, বিশাল ও পুরু।"

শুরু হয়ে গেল নিপীড়ন-নির্যাতন
সমস্ত মক্কায় নও-মুসলিমদের
'পরে। আবুল হাকাম-আবু লাহাবের
প্রকাশ্য ইন্ধনে, যেন অগ্নিচক্ষু হিংস্র
শিকারী কুকুর সব, ঝাঁপিয়ে পড়লো
একসাথে পৌত্তলিকগণ। ক্রীতদাস
দীন-হীন নও-মুসলিমরাই হলো
প্রথম শিকার এ-আক্রমণের। ছিলো
উমাইয়া ইবনে খালাফ জুমাহীর
ক্রীতদাস হাবশী বেলাল। তাঁকে রোজ
মধ্যাহ্নের প্রচণ্ড বোদ্দুরে হস্ত-পদ
বেঁধে, দিগম্বর করে, ফেলে রাখা হতো
উত্তপ্ত বালির উপর। উমাইয়া তাঁর
বুকের উপর উঠে বলতো উল্লাসে,
"বল্, মহম্মদ মাতাল ও তাঁর ধর্ম
মাতালের ধর্ম।" দুচোখের পানি ফেলে
বলতো বেলাল শুধু, "আহাদ! আহাদ! "
কখনো গলায় রশি বেঁধে, উমাইয়া
তুলে দিতো তাঁকে ছেলে-ছোকরার হাতে।
দুষ্ট ছোকরার দল টানতে টানতে
ঘুরাতো রাস্তায় তাঁকে, যেন সে কাঠের
গুঁড়ি। নিরন্ন, নির্জীব, মৃতপ্রায়, কৃষ্ণ
বেলালকে দেখে আবুবকর ইবনে
কুহাফার ভেঙে যায় বুক। দুইশত
দিরহাম দিয়ে সে ক্রয় করে নেয় তাঁকে
উমাইয়ার কাছ থেকে। তারপর তাঁকে
করে দেয় স্বাধীন। এই সে রসুলের
আদরের হাবশী বেলাল, ভাঙতো যাঁর
আজানের সুরে সারা পৃথিবীর ঘুম;
ফেরেস্তারা ‘মারহাবা! ' বলে আসমানে
করতো উল্লাস; রাত্রি ঝরে পড়ে, দিবা
মারতো আকাশে উঁকি ঊর্বশীর মতো।
অশ্রুসিক্ত মহম্মদ বললো উচ্চৈঃস্বরে,
"হে আবুবকর, মারহাবা! আজ তুমি
ফিরেছো উত্তম ব্যবসায় করে।" হলো
অবতীর্ণ তাঁর শানে— ‘দোজখের অগ্নি
থেকে দূরে রাখা হবে এমন ব্যক্তিকে,
যে আল্লাহকে খুব ভয় করে, পবিত্রতা
অর্জনের আশায় যে দান করে তাঁর
ধন-সম্পদ, সে দান করে প্রতিদান
পাওয়ার প্রত্যাশায় নয়, একমাত্র
তাঁর প্রতিপালকের সন্তুষ্টির জন্যে;
অবশ্যই অতি শীঘ্র সে সন্তুষ্ট হয়ে
যাবে প্রতিপালকের নিয়ামত দেখে।'

আম্মার বিন ইয়াসির, বনু মাখযুমের
ক্রীতদাস। সে এবং তার মাতাপিতা
সুমাইয়া ও ইয়াসির হয়ে গিয়েছিল
মুসলিম একসাথে। নেমে এসেছিল
কিয়ামত যেন তাঁদের উপর। বনু
মাখযুম, আবুল হাকাম আর সব
পাপিষ্ঠ কাফের করতো তাঁদের নিয়ে
খেলা, যেভাবে বিড়াল মুষিককে নিয়ে
মেতে ওঠে মরণখেলায়।রৌদ্রতাপে
গনগন করা বালির উপর রাখা হতো
শোয়ায়ে তাঁদের; তাঁদের বুকের ‘পরে
রেখে দেয়া হতো ভারী প্রস্তর। চাবুক
দিয়ে অতঃপর করা হতো পালাক্রমে
এমন প্রহার, নিশ্চেতন হয়ে যেতো
তারা। এভাবেই একদিন মারা যায়
আম্মারের পিতা ইয়াসির।মহাপাপী
আবুল হাকাম একদিন মহাক্রোধে
আত্মহারা হয়ে ছুঁড়ে মারে তীক্ষ্ণ বর্শা
সুমাইয়ার লজ্জাস্থানে। লুটিয়ে পড়ে সে
মৃত্তিকায়। কেঁপে ওঠে আল্লাহর আরশ।
ফেরেস্তারা ‘সুমাইয়া! সুমাইয়া! ' বলে
জোড়ে আর্তনাদ; আর রেশমি কাপড়ে
জড়ায়ে পবিত্র আত্মা তাঁর, চলে তাঁরা
আল্লাহর দরবারে। মহম্মদ কাঁদে
আর বলে, "হায় প্রভু, সর্বশক্তিমান!
আমরা দুর্বল, আমাদের শক্তি দিন
আর দিন ধৈর্য, সহ্য, দৃঢ় মনোবল।
কী এঁদের অপরাধ হায়! ‘আল্লাহ ছাড়া
কোনো প্রভু নেই' বলার অপরাধেই
হত্যা করে ফেলছে তারা হায়েনার মতো।
আপনার কাছেই শুধু বিচার চাই হে
বিচারদিনের মালিক, মহাদয়ালু! "
এ এক বর্বর জনপদ— নেই রাষ্ট্র,
নেই আইন-শাসক, নেই নিরাপত্তা-
রক্ষী মানুষের; ন্যায় নয়, সত্য নয়,
পাশবিক শক্তিই এখানে খেলা করে
বন্য বরাহের মতো, মানুষের 'পরে।

খাব্বাব বিন আরত্ত ছিলো খুযায়াহ
গোত্রের উম্মু আনমার সিবা নাম্মী
এক মহিলার ক্রীতদাস। সে যখন
জেনে ফ্যালে, বেচারা খাব্বাব হয়ে গেছে
মুসলিম, শাস্তিস্বরূপ সে তপ্ত লোহা
চেপে ধরে তাঁর পিঠের উপর। পরে
মাটিতে শোয়ায়ে ফেলে, বুকের উপর
উঠে উন্মাদের মতো নাচতে নাচতে
বলে, "হে খাব্বাব, বল্, মিথ্যে মহম্মদ,
মিথ্যে তাঁর খোদা আর তাঁর ধর্ম মিথ্যে।"
পর্বতের মতো অনড় খাব্বাব তাঁর
ধর্মবিশ্বাসে। উন্মত্ত উম্মু আনমার,
লোহার পোশাক পরিয়ে এবার, তপ্ত
বালির উপর রেখে দেয় তাঁকে ফেলে।
প্রচণ্ড উত্তাপে কষ্টে ছটফট করে
প্রেমিক খাব্বাব! মুখে তাঁর একটাই
বাণী— ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! ' একটাই
ধ্যান-জ্ঞান—‘মহম্মাদুর রসুলুল্লাহ! '

শুনলে স্রষ্টার একত্ববাদের কথা,
কেন এত হিংস্র হয়ে ওঠে এরা? কেন
এত হয়ে যায় পর একান্ত আপন
ছিলো যারা একদিন? মুসআব বিন
উমায়ের ছিলো ধনীর দুলাল। তাঁর
দরদের পিতা উমায়ের তাঁকে দু-শ
দিরহাম মূল্যের পোশাক কিনে কিনে
করাতো পরিধান। সে ছিলো সুদর্শন
এক সৌখিন যুবক, সমস্ত জীবন
যার কেটেছিল নানা প্রাচূর্যে-ঐশ্বর্যে।
কপালের ফেরে চোখে তাঁর একদিন
আছড়ে পড়ে ঈমানের জ্যোতি। উথলে ওঠে
তাঁর বুক আল্লাহ ও তাঁর রসুলের
প্রেমে। আর সে গোপনে অন্যদের মতো
হয়ে যায় মুসলিম। এ-খবর যেই
জানাজানি হয়ে গেল, নির্দয়া তাঁর মা
বন্ধ করে দিলো খানাপিনা; একদিন
বের করে দিলো বাড়ি থেকে; এমনকি
কেড়ে নিলো তাঁর পরনের বস্ত্রটিও।
কী হয় পড়লে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ',
দরদের মাও হয়ে যায় দুশমন; ক্রোধে
অগ্নিশর্মা হয়ে, বন্ধুজন ধেয়ে আসে
দা-সড়কি নিয়ে, শেষ করে দেবে বলে?

নিপীড়িত মুসলিমদের আর্তনাদে
ভারী হয়ে ওঠে মক্কার বাতাস। আবু
লাহাব, আবুল হাকাম ও ওয়ালিদ
বিন মুগিরার ষড়যন্ত্রজাল তত
হতে লাগলো ভয়াবহ।হজের মৌসুম
এদিকে আসন্ন প্রায়।আরেক সংকটে
পড়ে গেল পৌত্তলিকগণ। মহম্মদ
পবিত্র এ-মাসে হাজীদের কাছে গিয়ে
প্রচার করতে পারে তাঁর ধর্ম; তাই
ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার গৃহে তারা
হলো একত্রিত সলা-পরামর্শে। বলে
ওঠে ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, "বলুন,
মহম্মদ সম্বন্ধে আমরা হাজীদের
কী বলতে পারি? " একজন বলে, "তাঁকে
গণক বলতে পারি আমরা।" বললো
ওয়ালিদ, "না, না! গণক সে নয়। বহু
গণককে দেখেছি আমরা। এ তাদের
মতো চোখ বুজে গুনগুন করে কোনো
গান গায় না, কোনো কবিতাও আওড়ায় না।"
একজন বলে ওঠে, "তাহলে আমরা
পাগল বলবো তাঁকে।" ওয়ালিদ বলে,
"সে পাগল নয়। তাঁর মধ্যে পাগলদের
মতো দম বন্ধ করে রাখা, অসংলগ্ন
কথাবার্তা বলা, অপ্রাকৃত কাজকর্ম
করা— এসবের কিছুই যায় না দেখা।"
একজন বলে, "তাহলে বলবো যে, সে
একজন কবি।" ওয়ালিদ বলে, "না, না,
সে কবিও নয়। কত কবিতার কথা
আমরা জানি। রযয, হাজয, মাকবুয,
মাবসুত, কারিয ইত্যাদি কাব্যরীতি
সম্বন্ধে ধারণা আছে আমাদের। তাঁর
প্রলাপের সাথে এসবের নেই কোনো
মিল।" আরেকজন বললো, "হাজীদের
আমরা বলবো, মহম্মদ একজন
জাদুকর।" এবারও বললো ওয়ালিদ
উল্টো সুরে, "কী করে বলবো জাদুকর?
আমরা তো জাদুকরদের নানা ফন্দি-
ফিকির সম্বন্ধে জানি। তারা সত্য-মিথ্যা
কত কথা বলে, কত অঙ্গ-ভঙ্গি করে,
ঝাড়-ফুঁক করে, গিরা দেয়। মহম্মদ
কিছুই করে না এসবের।" লোকজন
তখন হতাশ হয়ে বললো, "তাহলে
আপনিই ঠিক করুন কী বলা যায়
তাঁকে।।" সে বললো, "শোনো, আল্লাহর কসম!
তাঁর কথা বড়ই মধুর। যেকথা-ই
তাঁর সম্বন্ধে বলো না কেন, যারা তাঁর
সংস্পর্শে আসবে, তারা আর তোমাদের
কোনো কথাই বিশ্বাস করবে না।" বলে
থেমে গেল সে, কী যেন ভাবলো, হঠাৎ
উঠলো বলে, "এ তো জাদু ছাড়া কিছু নয়!
হ্যাঁ, তাঁর সম্বন্ধে আমরা এটাই শুধু
বলতে পারি— সে একজন জাদুকর।
বাস্তবিকই সে এমন সব কথাবার্তা
উত্থাপন করেছে, যা জাদু বলে মনে
হয়। সজ্ঞানে সে তৈরি করেছে বিভেদ
গোত্র-গোত্রে, পিতা-পুত্রে, মাতা-আত্মজায়,
ভাইয়ে-ভাইয়ে, স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যেও।"
তার এ-দ্বিমুখী চরিত্রকে ব্যঙ্গ করে
অবতীর্ণ হলো কোরানের এ-আয়াত—
‘ইন্নাহু ফাক্কারা ওয়াকাদ্দার। ফাকুতিলা
কাইফা কাদ্দার। ছুম্মা কুতিলা কাইফা
কাদ্দার। ছুম্মা নাযার। ছুম্মা আবাসা
ওয়াবাসার। ছুম্মা আদবারা ওয়াস্
তাকবার। ফাকালা ইন হাযা ইল্লা
সিহ্রুই ইউসার। ইন হাযা ইল্লা
কওলুল বাশার।- সে কেমন চিন্তা-
ভাবনা করলো এবং সিদ্ধান্ত নিলো!
ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে সিদ্ধান্ত
নিলো! আবারও ধ্বংস হোক সে, সিদ্ধান্ত
নিলো সে কিভাবে! তারপর সে তাকালো।
তারপর ভ্রু কুঁচকালো ও মুখ বাঁকালো।
তারপর সে পিছনে ফিরলো এবং
অহঙ্কার করলো। তারপর বললো,
‘এ তো জাদু ছাড়া কিছু নয়, এসব তো
পূর্বকাল থেকে চলে আসছে। এটা তো
মানুষের কথা মাত্র।' হজের মৌসুম
গেল এসে। স্রষ্টার নির্দেশে মহম্মদ
ছুটে গেল হাজীদের শিবিরে শিবিরে;
মক্কার ওকাজ-মাজিন্না-যুলমাজায
বাজারে গিয়েও সে বিদেশী লোকদের
শোনাতে লাগলো কোরানের বাণী আর
তাঁর নবুওয়াতপ্রাপ্তির কথা। কিন্তু তাঁর
পশ্চাতে পশ্চাতে ঘৃণ্য মাছির মতোই
ভনভন করে ঘুরতে লাগলো আবু
লাহাব। আগত হাজীদের শুনিয়ে সে
বলতে লাগলো, "এর কথায় তোমরা
কান দিও না। সে মিথ্যুক, ছলনাকারী,
ভণ্ড, প্রতারক।সে বেদ্বীন হয়ে গেছে।
তাই এর কথা বিশ্বাস করো না কেউ।"

বিদেশী হাজীরা ভ্রু কুঁচকায় ও ভাবে,
"কেন সে এমন করে? প্রকৃত প্রস্তাবে
কে এদের মাঝে মিথ্যুক ও সত্যবাদী?
কেন এ-যুবক করে এত সাধাসাধি
মহান স্রষ্টার একত্ববাদের দিকে?
কেন এ-বৃদ্ধের মুখ হয়ে যায় ফিকে
শুনে তাঁর কথা? স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো
ধর্মকথা তাঁর। একই কথা অবিরত
বলে চলে। ঠিকই, সত্যের তো নেই রঙ!
তবু তাঁর পশ্চাতে কেন এ বৃদ্ধ সঙ
কুকুরের মতো ঘোরে, বাঁদরের প্রায়
বারবার শুধু তার মুখ ভেংচায়? "

হজ মৌসুমের পর কুরাইশ গোত্রের
কিছু নেতা এলো আবু তালিবের কাছে।
তারা বললো, "হে আবু তালিব! শুনুন
আপনার ভাতিজার কথা। সে প্রকাশ্যে
আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে বলে যাচ্ছে।
দেব-দেবীদের নামে বলে যাচ্ছে যা তা।
আমাদেরকে সে বিচার-বিবেকহীন
আকাট মূর্খ বলছে। আমাদের পূর্ব-
পুরুষদেরকে বলছে সে পথভ্রষ্ট।
আপনি একটা বিহিত করুন এর।
তা নইলে আপনি তাঁর ও আমাদের
মাঝখান থেকে সরে যান। আমরাই
দেখি কিভাবে শায়েস্তা করা যায় তাঁকে।
আপনি তো আমাদেরই মতো মানেন না
তাঁর ধর্ম। আসুন আমরা বাঁধা দেই
একসাথে। সে সত্যিই বাড়াবাড়ি করছে।"
বলে তারা চলে গেল। কিছুদিন পর
আবার আসলো তারা দল বেঁধে। এসে
বললো, "হে আবু তালিব! আমরা এর
আগে এসে আপনার ভাতিজার কথা
বলেছিলাম আপনাকে। আপনি তো তাঁর
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি কোনো। ফলে সে
অপকর্ম করে যাচ্ছে পূর্বেকার মতো।
আমরা তো কিছুতেই আর বরদাস্ত
করবো না এ নিয়ে যে, আমাদের পূর্ব-
পুরুষদেরকে পথভ্রষ্ট বলা হবে,
আমাদের বিবেককে নির্বুদ্ধিতা বলে
আখ্যায়িত করা হবে, আর আমাদের
দেব-দেবীদের নামে নিন্দা করা হবে।
আপনি এসব থেকে নিবৃত্ত রাখুন
তাঁকে; তা না হলে আমাদের দু-দলের
মধ্যে একদল ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত
যুদ্ধ-বিগ্রহ চলতেই থাকবে।" তাদের
কথা শুনে উঠলো অগ্নির মতো জ্বলে
কুরাইশসর্দার আবু তালিব, "ধিক
তোমাদের! তোমাদের স্পর্ধা তোমাদের
প্রকৃত শক্তিকে অতিক্রম করে গেছে।
যুদ্ধ-বিগ্রহের হুমকি দিচ্ছো আমাকে?
অথচ তোমরা অবগত আছো কারা
কত শক্তি রাখে। পিতা আবদুল মুত্তা-
লিবের শপথ! কাবার রক্ষক আবু
তালিবকে কেউ, দেখিয়ে যুদ্ধের ভয়,
কাবু করতে পারবে না। তবে যদি বলো
ন্যায়-বিচারের কথা, আমি রাজী আছি
তোমাদের বিষয়টি বিবেচনা করতে।"
ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল তারা।
শেষমেশ তারা বললো, "হে আবু তালিব,
আমরা শান্তির পক্ষে আছি। এখন যা
ভালো মনে করেন, আপনি তা করুন।"
বলে তারা প্রস্থান করলো একসাথে।

ডেকে পাঠালো ভ্রাতুষ্পুত্রকে আবু তালিব।
তাঁকে শোনালো সে কুরাইশ-নেতৃবৃন্দের
কথা এবং বললো অতঃপর, "শোনো,
একটু বিচার বিবেচনা করে কাজ
করো। যে-বোঝা বহন করার সামর্থ্য
আমার নেই, তা চাপিয়ে দিও না তুমি
আমার উপর।" দু-পায়ের নিচ থেকে
যেন সরে যেতে লাগলো মৃত্তিকা! আবু
তালিব নামের শীতল আশ্রয় থেকে
এইবার বুঝি হতে হবে বিতাড়িত!
অভিমান মাখা কণ্ঠে বললো ভাতিজা
তাঁর, "আল্লাহর শপথ! আমার দক্ষিণ
হাতে যদি সূর্য আর বাম হাতে যদি
এনে দেয় তারা চাঁদ, তবুও, হে চাচা,
আমার এ-সত্য থেকে আমি এক চুলও
হবো না বিচ্যূত। আমার এ-কাজে হয়
আল্লাহ আমাকে করবেন জয়যুক্ত,
না হয় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবো আমি।"
একথা বলেই অশ্রু টলোমলো চোখে
চলে গেল মহম্মদ আবু তালিবের
সামনে থেকে। ভাতিজার এ-অসহায়ত্ব
দর্শনে, হৃদয় তাঁর কাঁচের গ্লাসের
মতো মেঝেতে আছড়ে পড়ে হয়ে গেল
খান খান। দুচোখে বইলো নদী। তাঁকে
পুনরায় পাঠালো সে ডেকে। সে বললো,
"হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, নির্দ্বিধায় তুমি
তোমার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পন্ন করে
যাও। আল্লাহর কসম! তোমাকে কখনো
পরিত্যাগ করবো না আমি।" তারপর
করতে লাগলো আবৃত্তি সে উচ্চৈঃস্বরে,
"যদি চান মহাপ্রভু, তারা কোনোদিন
পৌঁছোতেই পারবে না তোমার নিকট,
যতক্ষণ পর্যন্ত না হচ্ছি সমাহিত।
নিশ্চিন্তে চালিয়ে যাও তোমার প্রচার,
পাবে না সাহস তারা রুখতে তোমাকে।
প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্র, তুমি খুশী থাকো
এবং তোমার চক্ষু হোক পরিতৃপ্ত।"

মহম্মদ ফের ঝাঁপিয়ে পড়লো তাঁর
সত্যের আহ্বানে। প্রেম যত হয় গাঢ়,
তত বাড়ে মত্ততা, বৈরিতা তত বাড়ে।
কুরাইশগণ হন্যে কুকুরের মতো
হয়ে গেল পুরো ক্ষেপা। আবুল হাকাম
দিতে লাগলো উসকানি। যখন, যেখানে
যে-অবস্থাতেই পায় তারা তাঁর দেখা,
ঠাট্টা ও বিদ্রƒপে করে তাঁকে জর্জরিত।
নেই তাঁর নবিত্বে বিশ্বাস এক তিলও,
পরিবর্তে তোলে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক
ওহি নিয়ে এই বলে, "এটা নয় কিছু,
মিথ্যে ছাড়া; সে তা তৈরি করেছে অথবা
ভিন্ন জাতির লোকেরা সাহায্য করেছে
তাঁকে এ-ব্যাপারে।"; এ-ও বলে, " এ-তো পূর্ব
যুগের কাহিনী, যা সে লিখিযে নিয়েছে;
আর এগুলোই তাঁকে সকাল-সন্ধ্যায়
হয় শোনানো।"; কখনো তারা বলে, "হায়,
এ কেমন নবি, যে খাবার খায় আর
হাট-বাজারেও করে চলাফেরা! " তারা
নও-মুসলিমদের বলে, "তোমরা তো
অনুসরণ করছো এক জাদুগ্রস্ত
ব্যক্তিকে।" কখনো তারা হেসে হেসে বলে,
"ওই দ্যাখো, এসে গেছে বিশ্বের সম্রাট,
যুদ্ধে যে কিনা পরাস্ত করবে রোমের
কায়সার আর পারস্যের কিসরাকে! "
এই কথা বলে তারা দেয় হাততালি,
শিস দেয়, নাচে আর করে হাসাহাসি।
মহম্মদ সব দ্যাখে, সহ্য করে আর
রাত্রি জেগে জেগে দুচোখের পানি ফেলে
করে ফরিয়াদ আল্লাহর দরবারে।
নতুন উদ্যমে সে তাঁর জাতির কাছে
ছুটে যায় পুনরায় আর বলে, "যারা
মেনে নেবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ', তারা
বেঁচে যাবে জাহান্নাম থেকে, তাদেরকে
দেয়া হবে জান্নাত, যেখানে পাবে তারা
চিরস্থায়ী সুখের জীবন।" তারা হাসে।
মহম্মদ বলে, "হে আমার জাতি, যদি
মেনে নাও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ', তবে
তোমরা সম্রাট হবে গোটা আরবের;
আজমরা হবে তোমাদের অধীনস্থ।"
তবু অবিশ্বাসে উল্টা পথে তারা ছোটে
আর অপমানে-নির্যাতনে করে তোলে
তাঁকে অতিষ্ঠ। চলার পথে তাঁর, পুঁতে
রাখে বিষকাঁটা; ছুঁড়ে মারে মুখে ধুলো;
খাদিজার রান্না করা খাদ্যের পাতিলে,
সুযোগ পেলেই, মল-মূত্র-আবর্জনা
দেয় ফেলে। হেন কোনো নেই অপকর্ম,
করছে না তারা। এদের ইন্ধনদাতা
আবুল হাকাম ও আবু লাহাব। তারা
টের পায়, মহম্মদ নয় সাধারণ
কোনো লোক। কিভারে সে গোপন কথাও
করে দেয় ফাঁস! অসম্ভব সহ্যশক্তি
তাঁর! এ এমন এক খুঁটি, দুমড়ানো-
মুচড়ানো যায় না কখনো যাঁকে। আর
সে যে জাদুকর, এ-ই শুধু তারা জানে।
আবু তালিবের ভয়ে, দলবেঁধে তাঁকে
হামলা করার হয় না সাহস; তাতে
বনি হাশিমের সাথে বেঁধে যেতে পারে
যুদ্ধ। তাই মেটায় মনের ঝাল তাঁকে
বিদ্রূপ ও উপহাস করে করে। শেষে
মহম্মদের চূড়ান্ত দুশমন আবু
জেহেলের ইশারায়, পৌত্তলিকদের
কেউ কেউ শারীরিকভাবে তাঁকে করতে
লাগলো লাঞ্ছিত। একবার কাবাগৃহে
ডুবে ছিলো মহম্মদ সালাতের মধ্যে।
দেখছিল দূরে বসে আবুল হাকাম
তার সাথীদের নিয়ে। সালাতের নানা
অঙ্গভঙ্গি দেখে হাসাহাসি করছিল
তারা। আবুল হাকাম হঠাৎ উঠলো
বলে, "কে আছে এমন, গিয়ে নিয়ে আসে
মুগিরার বাড়ি থেকে উটের ভুড়িটা,
আর সে যখন সিজদায় যায়, তাঁর
পিঠের উপর চাপিয়ে দেয় তা? " উঠে
দাঁড়ালো উকবা বিন আবি মুআইত;
নিষ্ঠুরতা-নির্লজ্জতা-দুশ্চরিত্রতার
জন্যে সে কুখ্যাত ছিলো সমস্ত মক্কায়।
উটের ভুড়িটা নিয়ে এসে, ঠিকঠিকই
চাপিয়ে দিলো সে তাঁর পিঠের উপর।
বিশাল ভুড়ির চাপে সিজদার মধ্যে
হাঁসফাঁস খেতে লাগলো মহম্মদ।দেখে
প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়লো তারা আর
করতে লাগলো গলাগলি ঢলাঢলি
উন্মত্ত উল্লাসে। নবি-নন্দিনী ফাতিমা
জানতে পারে তা কারো কাছে। ছুটে এসে
করে সে উদ্ধার প্রাণের পিতাকে আর
উচ্চৈঃস্বরে ধিক্কার জানাতে থাকে ঘৃণ্য
পাপিষ্ঠদেরকে। বলে ওঠে মহম্মদ,
"হে আল্লাহ, পাপিষ্ঠ এ-কুরাইশদের
পাকড়াও করুন। পাকড়াও করুন আবু
জেহেলকে। উতবাহ বিন রাবিয়াহ,
শায়বা বিন রাবিআহ, ওয়ালিদ বিন
উতবাহ, উমাইয়া ইবনে খালাফ
এবং উকবা বিন আবি মুআইতকে
পাকড়াও করুন।" শুনে দুরাত্মাগণের
কেঁপে ওঠে সমস্ত শরীর। চুপ হয়ে
গেল তারা। চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো
একে অপরের মুখ, যেন মৃত্যু এসে
ঘিরে ফেলেছে তাদের চতুর্দিক হতে।
তাদের আশঙ্কা হলো, তাঁর বদদোয়া
মুহূর্তেই বুঝি হয়ে যাবে কার্যকর!
উকবা, উমাইয়া, আবু জেহেলের নিন্দা
করতে করতে অগ্নিমূর্তি নবির দুলালী
পিতাকে আঁকড়ে ধরে ফিরে চলে ঘরে।
"হে আল্লাহ! আপনিই করুন বিচার।"
বলে আর্তনাদ জুড়ে দিলো নবি-পত্নী
খাদিজা খুওয়াইলিদ আর ভেজা বস্ত্রে
মুছতে লাগলো তাঁর পবিত্র শরীর।
ফাতিমা ভাসায় বক্ষ কেঁদে, আর বলে,
"এমন সুন্দর মুখে কী করে মানুষ
ছুঁড়ে মারে থুতু? এমন সুন্দর গায়ে
কী করে ময়লা-আবর্জনা মারে ছুঁড়ে?
পাষণ্ড উকবা কী করে পারলো, হায়,
করতে এ জঘন্য কাজ? " মহম্মদ বলে,
"ধৈর্য ধরো! ধৈর্য ধরো! একটা সময়
আসবে নিশ্চয়, বাতাসের আগে আগে
ছুটতে থাকবে তোমার পিতার নাম,
কস্তুরির ঘ্রাণ যেভাবে বাতাসে ছোটে।"
খাদিজা উঠলো বলে, "নিশ্চয় আসবে,
কারণ তুমি তো মিথ্যা বলো না কখনো।"

আবু জেহেলের অষ্ট প্রহরের ধ্যান
কিভাবে মহম্মদের তুলে ফেলা যায়
শিকড়-বাকড় আর কিভাবে সমস্ত
মুসলমানকে করা যায় ধূলিসাৎ।
তাই সে শানায় শত্রুতার তরবারি;
বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসে কুমন্ত্রণা
আর পৌত্তলিকদের করে উত্তেজিত,
যেন সে সুদক্ষ শয়তানের অনুচর,
একটাই তার কাজ—মিথ্যা বলা আর
কুৎসা রটানো মহম্মদের বিরুদ্ধে।
"হায়, যে কাবায় তিন শ ষাটটি মূর্তি
দেব-দেবীর, রক্ষিত: কী করে সেখানে
একজন মহম্মদ তাঁর মন গড়া
এক-ঈশ্বরের সিজদায় পড়ে নুয়ে
নিশ্চিন্তে রাত্রিদিন? এ অথর্ব নগরে
কেউ কি এমন নেই, বাঁধা দেয় তাঁকে
আর বলে, এ-কাবায় সালাত নিষেধ? "
গুমরে গুমরে মরে আবুল হাকাম।
"যদি কেউ নেই, তাহলে আমিই সেই
সাহসী পুরুষ, পাঠানো হয়েছে যাকে
এই মর্ত্যে বেদ্বীনের মূলোৎপাটনে।"
মাকামে ইব্রাহিমের নিকট তখন
সালাতে দাঁড়িয়েছিল মহম্মদ। তাঁকে
দেখে জ্বলে উঠলো সে বারুদের মতো
এবং বললো, "মহম্মদ! তোমাকে কি
আমি বলিনি, এখানে সিজদাহ দেওয়া
চলবে না? " মহম্মদ তার কোর্তাটার
মাঝখান ধরে দিলো এক টান; দিয়ে
বললো বিক্ষুব্ধ স্বরে, "আওলা লাকা
ফাআওলা। ছুম্মা আওলা লাকা ফাআওলা।-
দুর্ভোগ তোমার জন্য, দুর্ভোগ! দুর্ভোগ!
অতঃপর দুর্ভোগের উপর দুর্ভোগ! "
বললো আবু জেহেল, "মহম্মদ! তুমি
ধমকাচ্ছো? শপথ উজ্জার! পারবে না
তুমি ও তোমার প্রভু করতে কিছুই।
আমি তো মক্কার পর্বতমালার মধ্যে
যারা বিচরণ করে, তাদের সবার
মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি।"

ছুটে গেল আবুল হাকাম কুরাইশ
নেতৃবৃন্দের নিকট। জানতে চাইলো,
"তোমাদের সামনে কি মহম্মদ তাঁর
মুখমণ্ডলকে ধূলায় লাগিয়ে রাখে? "
তারা বললো, "হ্যাঁ।" সে বললো দম্ভ ভরে,
"উজ্জার কসম! তাঁকে যদি পুনরায়
সেই অবস্থায় দেখি, তাঁর গ্রীবা আমি
পদপিষ্ট করে ফেলবো এবং তাঁর
মুখমণ্ডলকে মাটিতে থেতলে দেবো।"
একদিন কুরাইশগণ তাকে ডেকে
বললো, "ওই যে মহম্মদ! সে তো ফের
সিজদায় পড়ে আছে! " আবুল হাকাম
দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চললো তাঁর দিকে।
হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ালো ভয়ে। তার
পাপপোড়া চোখ দুটো হয়ে গেছে স্থির।
এক পায়ে দুই পায়ে পিছনের দিকে
সরে আসতে লাগলো সে। দুই হাত তুলে
কার কাছে যেন জানাচ্ছে আকুতি প্রাণ-
ভিক্ষার অথচ মহম্মদ সিজদাতে!
সাথীরা বললো, "কী ব্যাপার, ওহে বীর
আবুল হাকাম? ফিরে আসলে যে বড়!
চেহারাও দেখি করে ফেলেছো বিকৃত! "
বললো সে, "তাঁর ও আমার মাঝখানে
দেখতে পেলাম এক আগুনের গর্ত,
যার লেলিহান শিখা ভুজঙ্গের মতো
ফণা তুলে ধেয়ে আসছে আমার দিকেই।
আর একজন লোক, কি-কঠিন মূর্তি,
লোহার শিকল হাতে নিয়ে, চেয়ে আছে
অগ্নিঝরা চোখে, যেন সে এক্ষুণি তার
ভয়ঙ্কর হাতে ধরে ফেলবে আমাকে।"
তারা বলতে লাগলো, "বলেছি না, কেউ
পারবে না করতে কিছুই তাঁর? সে তো
মহাজাদুকর। যেই যাবে তাঁর কাছে,
জাদু দিয়ে তাকে করে ফেলবে নিশ্চিহ্ন।"

তবু কি জালিম থামে? চেপে যায় জিদ
তার, যেভাবেই হোক এই বিষকাঁটা
সরাতেই হবে জীবনের পথ থেকে।
সাফা পর্বতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে
হঠাৎ সে একদিন থেমে গিয়ে দ্যাখে,
একা একা বসে আছে মহম্মদ। তাঁকে
দেখেই ওঠে সে ক্ষিপ্ত হয়ে। কুকুরের
মতো জুড়ে দেয় ঘেউ ঘেউ। কয়েকটা
কটূ কথা বললো সে। অশ্রাব্য ভাষায
করলো সে উচ্চবাচ্য। মহম্মদ তবু
দেখালো না প্রতিক্রিয়া । তার প্রতি তাঁর
এরূপ নিঃশব্দ নিঃস্পৃহতা দেখে তার
বেড়ে গেল আরো ক্রোধ। একটা প্রস্তর-
খণ্ড তুলে, তাঁর মাথায় আঘাত করে
বসলো সে। ক্ষতস্থান দিয়ে ফিনকি দিয়ে
প্রবাহিত হতে লাগলো রক্তের ধারা।
আব্দুল্লাহ বিন জুদআনের দাসী দেখে
ছুটে গেল ঝড়োবেগে হামজার বাড়ি।
উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো সে, "বনু
হাশিম গোত্রের কী হয়েছে? চুপ হয়ে
আছে কেন তারা? পিতা নেই বলে তাঁর
জগতে কি কেউ নেই? কী করে তাদের
মহম্মদ? কেন তারা যখন তখন
দুহাত উঠাবে তাঁর গায়ে? " এইমাত্র
ফিরেছে মৃগয়া থেকে হামজা ইবনে
আবদুল মুত্তালিব। তখনো ধনুক-
তীর ধরা তাঁর হাতে। দাসীর কথায়
দাঁড়ালো সে ঘুরে। "কী হয়েছে? " বললো সে
ক্রুদ্ধস্বরে। "এইমাত্র ইবনে হিশাম
প্রস্তরের আঘাতে ফাটিয়ে গেল তাঁর
মাথা।" শুনে এই কথা, কেশরীর মতো
উঠলো সে লাফ দিয়ে। আরবের শ্রেষ্ঠ
বীর সে; বুকের পাটা কার এত বড়,
দাঁড়ায় সম্মুখে তাঁর শির উঁচু করে!
সে বললো বজ্রস্বরে, "আমার ভাতিজা
মহম্মদের গায়ে তুলেছে সে হাত? যাই
কুকুরের বাচ্চাটার ছাড়ায়ে আসি গে'
ভূত। কোথায় সে বেজন্মা, গর্তের কীট? "
"কাবার দিকেই গিয়েছে সে তাঁকে মেরে।"
তীর-ধনুক হাতেই ছুটলো হামজা।
চোখেমুখে জ¦লছে আগুন। "কী ব্যাপার! "
বলে মেয়েলোকগণ বের হয়ে এলো
ঘর থেকে। কাবাঘরে বসে করছিল
হাসাহাসি আবুল হাকাম মজাদার
সেই ঘটনাটি নিয়ে, লোকদের সাথে।
কিভাবে কোথায় বসে ছিলো মহম্মদ
আর কিভাবে সে মেরেছিল ছুঁড়ে সেই
প্রস্তরখণ্ডটা, দিচ্ছিল বর্ণনা; শুনে
বাহবা দিচ্ছিল তাকে পৌত্তলিকগণ।
মারমুখো হামজাকে দেখে চুপসে গেল
আবুল হাকাম। তাঁর বীরত্বের কথা
জানে না কে আরবমুলুকে? ক্ষিপ্ত ব্যঘ্র
যেন, তাকে দেখেই উঠলো চীৎকার
করে, "ওহে গুহ্যদ্বার দিয়ে মন্দ বায়ু
নিঃসরণকারী! জানিস না মহম্মদ
আমার ভাতিজা? তুই নাকি তাঁর গায়ে
তুলেছিস নোংরা তোর হাত? " বলে তার
মাথার উপর করলো আঘাত তাঁর
ধনুক দিয়েই। তাকে মারতে থাকলো
কিল-ঘুষি অনবরত, যে-পর্যন্ত না সে
ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার দুরবস্থা দেখে
বনু মাখযুম গোত্র এলো ছুটে। পাল্টা
হামজার পক্ষে বনু হাশিম গোত্রের
লোকজন হলো জড়ো। দুই গোত্রে বুঝি
বেঁধে যাবে এখনি সমর। মহাধূর্ত
আবুল হাকাম গুনলো প্রমাদ। তারই
ভুলের কারণে, হায়, পৌত্তলিকগণও
চলে গেল শত্রুপক্ষে! এতে লাভবান
হবে মহম্মদ। সবা'কে থামিয়ে তাই
বললো সে উচ্চৈঃস্বরে, "কুরাইশগণ!
ঠিকই করেছে হামজা। আমিই বরং
তাঁর ভাতিজাকে মেরে করেছি অন্যায়।
তাই আর কেউ গণ্ডগোল করবে না।"
এভাবে সম্ভব হলো যুদ্ধকে এড়ানো।

হামজা বললো তাঁর ভাতিজাকে গিয়ে,
"হে মহম্মদ, আবুল হাকামকে আমি
এসেছি পিটিয়ে। দিয়েছি ভুলিয়ে তার
পিতৃনাম।" মহম্মদ বললো, "হে চাচা,
আমি নবি। মনুষ্যপ্রহারে কোনো নবি
হয় না সন্তুষ্ট। প্রেরিত হয়েছি আমি
মানুষের কল্যাণের জন্যে। সেইদিন
আমি খুশী হবো যেদিন আমার চাচা
পড়বেন--‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'।" শুনে
অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে রইলো সে
ভাতিজার পবিত্র মুখের দিকে। এ-কি
কোনো সাধারণ মানুষের কথা? তাঁর
মাথায় ব্যাণ্ডেজ; যায়নি রক্তের দাগ
মুছে; অথচ শত্রুর প্রতি নেই কোনো
অভিযোগ! বিধাতা অন্তরচক্ষু তাঁর
দিলো খুলে। মানুষ ও নবির পার্থক্য
বুঝে এলো তাঁর। ভাতিজার জন্যে নয়,
এবার নিজেরই জন্যে বলে উঠলো সে
কম্পমান কণ্ঠে—‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'।
নির্যাতিত মুসলিমগণ খুঁজে পেল
শক্তি ও সাহস হামজার আবির্ভাবে।
------

POET'S NOTES ABOUT THE POEM
The biggest epic in Bengali
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Sayeed Abubakar

Sayeed Abubakar

Jessore / Bangladesh
Close
Error Success