Nabinama (নবিনামা) , An Epic: Canto-4 Poem by Sayeed Abubakar

Nabinama (নবিনামা) , An Epic: Canto-4

নবিনামা
সায়ীদ আবুবকর
*** *** *** ***
চতুর্থ সর্গ

নবুয়ত

ফিজার যুদ্ধের বীভৎস রুদ্ররূপ,
মানুষের মধ্যে জেগে ওঠা পাপাচার,
বরাহ-বন্যতা, রেষারেষি, খুনোখুনি,
ধর্ষণ, লুন্ঠন আর শুধু দিকে দিকে
ভয়াবহ মৃত্যুর মিছিল; মক্কা জুড়ে
কেবলি এমন নারকীয় দৃশ্য দেখে
বিচলিত ও বিমর্ষ সুবর্ণ-যুবক
মহম্মদ বিন আব্দুল্লাহ। সে এমন
এক পদ্মফুল, যার রঙের বাহারে
পদ্মপুকুরও রঙিন হয়ে উঠে করে
হংসকে উন্মত্ত; তাঁর বুক জুড়ে শুধু
প্রেম, চোখ জুড়ে স্বর্ণপৃথিবীর স্বপ্ন।
একদিন ডাকলো সে সব মানুষকে
একখানে। অর্থহীন কলহ-বিবাদ
যুদ্ধ-বিগ্রহ-বিদ্বেষ ও রক্তারক্তির
অন্তঃসারশূন্যতার কথা বোঝালো সে
প্রাণপণ। তাদেরকে নিয়ে, অতঃপর,
গড়ে তুললো এক সংঘ হিলফুল ফুজুল,
যার লক্ষ্য মানুষে মানুষে গড়ে তোলা
সাম্য ও মৈত্রীর অবিচ্ছিন্ন বন্ধন ও
শাশ্বত ভ্রাতৃত্ব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে।
লোকেরা বললো, 'তবে হে আল-আমিন,
তাই হোক। তোমার ইচ্ছাই আমাদের
ইচ্ছা। আর আমাদের কল্যাণ তোমার
বিরল উদ্যোগে।' দ্যাখেনি আরব আগে
এমন যুবক—বিনয়ে মস্তক তাঁর
যেন নুয়ে পড়া ফলের বাগান কিন্তু
তাঁর চোখে-মুখে ঝিকিমিকি করে শুধু
সাহসের রোদ্দুর: সে সুদর্শন যেন
পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ—যেই চায় তাঁর
দিকে, পরম শান্তিতে তুষারের মতো
গলে গলে যায় মন। শিশুর সে বন্ধু,
তরুণের সহচর, বৃদ্ধদের চির
সেবক নিঃস্বার্থ। আর বড়ই বিশ্বস্ত
সে সবার কাছে। লোকে তাই বলে তাঁকে
‘আল-আমিন'। মহম্মদ বিন আব্দুল্লাহ
আল-আমিন নামেই খ্যাত হয়ে ওঠে
সমস্ত মক্কায়। কত যে রূপসী তাঁর
স্বপ্ন দেখে দেখে কাটিয়েছে বিষরাত;
কত কুমারীর হৃদয়কন্দরে, তাঁর
জন্যে, নির্মিত হয়েছে সিংহাসন; কিন্তু
করে সে পরোয়া কার! তাঁর ধ্যান শুধু
বিশ্বমানবের মুক্তি; তাঁর স্বপ্ন শুধু
অজ্ঞতার অন্ধকারে আলো আর শান্তি
অশান্তির দাবানলে পুড়তে থাকা প্রিয়
জন্মভূমি মক্কানগরীতে। যেই তাঁকে
দ্যাখে, যুবক কি বৃদ্ধ, কিশোরী কি নারী,
জুড়ায় অন্তর সুখে। আর সাথে সাথে
মুহূর্তের তরে ভুলে যায় সব ব্যথা,
সব গ্লানি, লোভ, ক্রোধ, ঘৃণা ও বিদ্বেষ।

মক্কার সম্ভ্রান্ত এক বিত্তশালী-জ্ঞানী-
মহিয়সী নারী খাদিজাতুল কুবরা
বিনতে খুওয়াইলিদ। বিদূষী বিধবা
এ-নারীর ছিলো দেশ-বিদেশের সাথে
ব্যবসায়। গৃহে বসে, স্বামীর মৃত্যুর
পর, করে যাচ্ছিল সে ব্যবসার কাজ
যথারীতি; এ-কাজে করতো ব্যবহার
তাঁর আস্থাভাজন আত্মীয়স্বজনকে।
মহম্মদের উন্নত চরিত্রের কথা,
সদাচার, বিশ্বস্ততা, আমানতদারি,
সত্যবাদিতার কথা পৌঁছেছিল তাঁর
কাছে। একদিন তাঁকে পাঠালো প্রস্তাব—
তাঁর ক্রীতদাস মায়সারার সাথে সে
প্রেরণ করতে চায় তাঁকে ব্যবসার
কাজে, সিরিয়ায়; একটি লভ্যাংশ তাঁকে
দেয়া হবে বিনিময়ে। তাঁর এ-প্রস্তাবে
মহম্মদ হয়ে গেল রাজী। খাদিজার
বাণিজ্যবহর নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে
রওনা হয়ে গেল তাঁরা। ব্যবসায় এত
বেশি লাভ হলো, সব হিসাব-নিকাশ
শেষ করে যখন সমস্ত আমানত
লভ্যাংশসহ তুলে দিলো মহম্মদ
খাদিজার হাতে, হলো সে অবাক। এত
সততা, নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততা দ্যাখেনি সে
কোনোদিন। শুধু শুনেছে সে লোকমুখে
আব্দুল্লাহর পুত্রের গুণের কাহিনী;
আজ তা প্রত্যক্ষ করে তাঁর প্রতি ভরে
উঠলো হৃদয় তাঁর গভীর শ্রদ্ধায়।
মায়সারার কাছে সে শোনে অত্যাশ্চর্য
ভ্রমণবৃত্তান্ত তাঁর। সে বলে, '‘হে মাতা,
এমন মানুষ আর আছে কি জগতে?
এত মিষ্টি তাঁর ভাষা, যে-ই শোনে, সে-ই
মুহূর্তের মধ্যে হয়ে যায় সম্মোহিত!
জানে না মিথ্যা সে; সত্য দিয়ে এনেছে সে
কিনে গোটা সিরিয়াই! তাঁর ব্যবহারে
আছে জাদু; সব ক্রেতা, বাদ দিয়ে সব
সওদাগর, হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁর কাছে।
মক্কা থেকে এত লম্বা পথ সিরিয়ার—
না শুনেছি তাঁর মুখে কটূ কথা কোনো-
দিন, না দেখেছি কোনো রূঢ় ব্যবহার।
শুধু মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা
আর এ-মহাবিশ্বের সৃষ্টি-রহস্যের
কথা আমাকে সে শুনায়েছে বারবার।
এমন আশ্চর্য কথা আমি এর আগে
শুনিনি কোথাও। কোন্ সে গভীরতর
ভাবনার ভুবনে সে করে বসবাস,
কী সাধ্য আমার, বুঝাই তা আপনারে!
দেখেছি আশ্চর্য দৃশ্য এক প্রতিদিন—
যখন সে পথ চলে, ছায়া দিয়ে দিয়ে
তাঁর মাথার উপর দিয়ে চলে কালো
মেঘ; সে যখন থামে, মেঘও যায় থেমে।
সে এমন আজব মানুষ, যাঁর গায়ে
বসে না কখনো মশা-মাছি। উটগুলো
তাঁকে দেখে শ্রদ্ধায় নুয়ায়ে দেয় শির।'

খাদিজা যতই শোনে, তত তাঁর লাগে
ঘোর, তত তাঁর ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালবাসা
আছড়ে আছড়ে পড়ে তাঁর পায়ে। তত তাঁর
বলে ওঠে মন—এই সেই ইউসুফ,
জুলেখার মতো যাঁকে সমস্ত জীবন
স্বপ্নই দেখেছি আমি। পর-নারীদের
দিকে চোখ তুলে তাকায় না একটিবারও;
এ-কেমন আশ্চর্য যুবক! আহা, এ-কি
পুরুষ মহান, যাঁর সমস্তই শুধু
গুণ, যেন কোনো ফুলগাছ, যে-গাছের
সর্বাঙ্গে কেবলি ফুল, নেই কোনো পাতা
আর কাঁটা তাঁর গায়ে! ওহে প্রিয় সখী
নাফিসা বিনতে মুনাব্বিহ, শুনে যাও
সেই হরিণীর কথা, বুকে বিঁধে গেছে
তীর যার, মৃত্যু ছাড়া যার আর নেই
কোনো গতি। ডাকো লোকজন, তারা এসে
খুড়ুক কবর অতি দ্রুত আর তাকে
অন্ধ-মৃত্তিকার নিচে দিয়ে যাক চাপা,
কারণ লাজুক সেই অভাগা হরিণী
পৃথিবীকে আর দেখাতে চায় না মুখ।
বললো নাফিসা এসে, 'কী হয়েছে, কও
সব খুলে। কেন চোখে জমেছে এ-জল? '
বললো সে, 'আব্দুল্লাহর পুত্র মহম্মদ—'
বললো মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তাঁর
প্রাণের বান্ধবী, 'করি না বিশ্বাস, যদি
বলো, সে-ই কোনো মেরেছে হরিণী! সে তো
দয়ার সাগর। তাঁর দয়াদাক্ষিণ্যের
কথা কে শোনেনি মক্কামুলুকে? সবাই
তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সেই কিনা
মেরেছে হরিণী তীরের আঘাতে! আহা,
এমন আশ্চর্য কথা কে কবে মক্কায়? '
খাদিজা বললো, 'সখি, ছাড়ো রঙ্গকথা।
অভাগীর কথা তুমি শোনো মন দিয়ে।'
বলে সে হৃদয় তাঁর খুলে দিলো বিনা
সঙ্কোচে, রাত্রির অন্ধকার ছিঁড়ে ফেলে
যেভাবে দিবস তার খুলে দেয় অব-
গুণ্ঠন। চললো বিনতে মুনাব্বিহ ছুটে
ইবনে আব্দুল্লাহর কাছে। বাতাসে লাগলো
দোল। পুষ্পে পুষ্পে বন উঠলো রঙিন
হয়ে। পিকেরা জুড়লো গান। সাগরের
উত্তাল তরঙ্গমালা আছড়ে পড়লো
নিথর সৈকতে। বলে মহম্মদ হেসে,
'তাহলে পিতৃব্য আবু তালিব যাবেন
বিবাহের পয়গাম নিয়ে তাঁর গৃহে।'
সব শুনে খুশিতে খাদিজা হাত তুলে
জানালো স্রষ্টার দরবারে শুকরিয়া।

গণ্যমান্য যত লোক আরবের, আবু
তালিবের আমন্ত্রণে পদধূলি দিয়ে
করলো ধন্য। আনন্দমুখর পরিবেশে
শেষ হলো বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা।
উন্নত আহারে পরিতৃপ্ত হয়ে সব,
বর ও কন্যের জন্যে করলো আশীর্বাদ
প্রাণখুলে। কাবিন স্বরূপ মহম্মদ
তুলে দিলো সহধর্মিনীর হাতে দশ-
জোড়া উট। বাঁধা পড়লো দু-জীবন চির
আনন্দ-বন্ধনে, ছিঁড়লো না কোনোদিন
কোনো ঝড়ে, কোনো দুঃখ-দুর্দশা-দুর্যোগে।

বেহেস্তের হাঁট যেন খাদিজার ঘরে।
এত সুখসম্ভার দেখেছে কে কোথায়!
কে শুনেছে শান্তির এমন মিষ্টি সুর,
যে-সুরে জীবন উথলে উথলে পড়ে,
যেন বর্ষার উজানো গাঙ! এ-কেমন
আশ্চর্য মানুষ—নেই ক্রোধ, নেই লোভ,
মোহ, মাৎসর্য. অহঙ্কার; মানুষের
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা যাঁর অষ্ট
প্রহরের ধ্যান-জ্ঞান! কোন্ কপালের
গুণে এরকম স্বামী মেলে, ভেবে ভেবে
পায় না খাদিজা কূল। আর তাই তত
জানায় কৃতজ্ঞতা স্রষ্টার দরবারে।
এই সে মহৎ নারী, যে-তাঁর সর্বস্ব
দিয়েছে উজাড় করে স্বামীর কল্যাণে;
এই সে উম্মুল মুমেনিন, দিয়েছে যে
উপহার তাঁকে ছয়-ছয়টি সন্তান:
কাশেম, যয়নব, রোকেয়া, উম্মে কুলসুম,
ফাতেমা ও আব্দুল্লাহ। ছেলেরা সবাই
মারা যায় শৈশবে। কেবল মেয়েরাই
পেয়ে যায় জনকের নবির জীবন।

মহম্মদ পত্নী-অন্ত প্রাণ। খাদিজার
চোখের সম্মুখে আলোর মতো সে মেতে
থাকে গৃহকাজে। কাশেম-যয়নবের
দরদের প্রিয় পিতা। আলী ইবনে আবু
তালিবের যেন সহোদর ভাই। যদি
ডাক আসে অন্যের দুর্দিনে, হয়ে যায়
অস্থির। দুঃস্থের সে যে ত্রাতা। দরিদ্রের
চির বন্ধু। ঘর ও বাহির তাঁকে করে
রাখে ব্যস্ত রাত্রিদিন। যতবার তাঁকে
দ্যাখে, খাদিজার কাটে না বিস্ময়। এত
সে প্রাণোচ্ছল; হঠাৎ নিমগ্ন গভীর
ধ্যানে! চোখেমুখে এত খুশি; সে-খুশির
মাঝে কখনো হঠাৎ শ্রাবণের কালো
মেঘ। কার জন্যে কাঁদে তাঁর এত মন?
খাদিজার চোখে দর্পণের মতো সবই
পড়ে যায় ধরা। কখনো নিশীথে একা
চেয়ে থাকে দূর নভে; তারায় তারায়,
গ্রহ-গ্রহান্তরে বেড়ায় সে ঘুরে ঘুরে
একমনে। সে তো কবি নয়; তাহলে সে
কেন এত ধ্যানমগ্ন? লাত, উজ্জা, রুদা,
মানাত, হুবাল, নুহা— কোনো দেবতারই
নয় সে পূজারী মোটে; তবে কার ধ্যান
ভেঙে দেয় তাঁর ঘুম? জেনা-ব্যভিচারে
ডুবে গেছে এ-নগর; বেহায়াপনায়
সয়লাব এ-সমাজ। কিন্তু তাঁর স্বামী,
খাদিজা তা জানে, শিশিরের মতো শুভ্র
চরিত্রের অধিকারী; পাপ-পঙ্কিলতা
তাঁর বিপরীতে ছোটে, যেভাবে আলোর
বিপরীতে অন্ধকার। যদি কোনো নারী
নয়, যদি কোনো দেব-দেবী নয়, যদি
নয় কবিদের মতো আত্মনিমগ্নতা,
তাহলে কিসের ধ্যানে কাটে তাঁর রাত?
'হে আবুল কাশেম, আমাকে, যে-তোমার
জীবনসঙ্গিনী, খুলে বলো আজ, কী সে
তুমি ভাবো এইভাবে একা সারারাত?
বলো, কী তোমাকে দেয় না ঘুমাতে রাতে? '
মহম্মদ বলে হেসে, 'বুঝি না আমিও
নিজে। আমার অন্তর শুধু বলে, মিথ্যে
এই দেব-দেবী; পবিত্র কাবাকে ওরা
করেছে যে কলুষিত মূর্তি দিয়ে ভরে!
পাথুরে মূর্তির কী ক্ষমতা আছে কও,
মুক্তি দিতে পারে মানুষের? হে খাদিজা,
বিশ্বজাহানের যদি নানা খোদা হতো,
খোদায় খোদায় বেঁধে যেত ঠোকাঠুকি,
ধ্বংস হয়ে যেত আকাশ-জমিন। দ্যাখো,
একদিকে মূর্তি-পূজারীরা জন্মান্ধের
মতো করছে উলঙ্গ হয়ে পূজা দেব-
দেবীর; তারাই আবার কি পাষণ্ডের
মতো নিজ হাতে দিয়ে যাচ্ছে নিজ নিজ
কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর! এটা
কী করে হে হয় ধর্ম? চির-অন্ধকারে
ডুবে আছে এ-জমিন; এখানে মিথ্যার
জয়জয়কার। মানুষে মানুষে তাই
এত হানাহানি, গরিবেরা নির্যাতিত,
নারীরা লাঞ্ছিত, বিতাড়িত মানবতা।
আমিও বুঝি না ঠিক সত্য কোনখানে;
কে দেবে আমাকে, হায়, সত্যের ঠিকানা! '
বললো খাদিজা, 'স্বামী, তুমি সত্যবাদী;
বলো নি তো ও-জবানে মিথ্যা কোনোদিন।
তোমার অন্তর যা বলে, সত্য তা। আমি
জানি, আমাদের আল-আমিন হবে না
পথভ্রষ্ট। স্রষ্টাই দেখাবে তাঁকে পথ।
আর সে পাবেই খুঁজে, খুঁজতেছে যা সে।'

বিচ্ছিন্ন এ-ভূমি সমস্ত পৃথিবী থেকে।
এ-মরুমুলুকে রোম-পারস্যসম্রাট
দেয়নি নজর কোনোদিন। নানা গোত্র
যে-যার মতন করে ক্ষমতা জাহির
একে অপরের 'পর। সবার উপর
গোত্রের মর্যাদা; প্রয়োজন হলে, দেবে
জান, তবু এরা গোত্রের মর্যাদাহানি
করবে না বরদাস্ত— ন্যায় কি অন্যায়,
কি বা তাতে যায় আসে! তুচ্ছাতিতুচ্ছ
বিষয় নিয়েও এরা করে হানাহানি,
চলে যা যুগের পর যুগ। পাতকূপে
উষ্ট্রের পানি খাওয়া নিয়ে করে যুদ্ধ;
ওকাজ মেলায় কাব্য পাঠ করা নিয়ে
এ-গোত্রে সে-গোত্রে বেঁধে যায় খুনোখুনি;
নারীর দখল নিয়ে, ভুঁই দখলের
মতো, মেতে ওঠে সব রক্তের খেলায়,
যেন জীবন এদের কাছে পুড়তে থাকা
নেশার চুরুট, শেষ টান দিয়েই যা
ছুঁড়ে দিলো নর্দমা কি ডাস্টবিনে। মৃত্যু
এরা কথায় কথায় কত সহজেই
লাত ও উজ্জার নামের কসম খেয়ে
শরাবের মতো করে পান! এইসব
দেখে দেখে, একা একা হয় পেরেশান
আর খোঁজে রাত্রি জেগে জেগে মহম্মদ
পথভ্রান্ত মানুষের পরিত্রাণপথ।

চলছিল কাবাগৃহ পুনঃনির্মাণের
কাজ। তাই নিয়ে হুট করে বেঁধে গেল
তুমুল কলহ গোত্রে গোত্রে। সব গোত্র
এ-দাবিতে হয়েছে একাট্টা, কাবাগৃহে
তারা প্রত্যেকেই করবে স্থাপন পুণ্য
কৃষ্ণ পাথর। দেবে না চুল পরিমাণ
ছাড় কেউ এ-ব্যাপারে। বেঁধে যেতে পারে
গৃহযুদ্ধ এটা নিয়ে যে-কোনো মুহূর্তে।
তাই দেখে বর্ষীয়ান কুরাইশ নেতা
আবু উমাইয়া মাখযুমী বলে ওঠে,
'ভাইসব, এক কাজ করো। আজ রাতে
অবস্থান করো সকলেই কাবাগৃহে।
যে-ব্যক্তি প্রতুষে আসবে সবার আগে
পবিত্র এ-ঘরে, তার উপর আমরা
ছেড়ে দেবো সিদ্ধান্তের ভার। বলবে সে
কোন্ গোত্র স্থাপন করবে পবিত্র এ
কৃষ্ণ পাথর। আমরা বাধ্য থাকবো মেনে
নিতে তার সেই রায়। থাকবে না তাতে
কারো কোনো মনঃকষ্ট আর।' সকলেই
বলে ওঠে উচ্চৈঃস্বরে, 'উত্তম প্রস্তাব! '

জেগে জেগে রাত্রি হলো শেষ। চেয়ে আছে
পথ সকলেই, কে আসে সবার আগে
খোদার এ-ঘরে! ডাকলো মোরগ বুঝি
দূরে কার গৃহে! পূর্ব আকাশে পড়েছে
ছড়িয়ে রক্তিম আভা সুবে সাদিকের।
মক্কানগরীর কে সে ভাগ্যবান, যার
প্রথম পায়ের ধুলো পড়বে এ-প্রাতে
পবিত্র কাবায়! হঠাৎ চীৎকার করে
উঠলো সবাই সমস্বরে, 'আর কেউ
নয়, এসেছে সবার আগে আমাদের
আল-আমিন, সকলের প্রিয় মহম্মদ
বিন আব্দুল্লাহ! ' হতভম্ব মহম্মদ
শোনে সব কথা; জানতো না কেন তারা
এভাবে এখানে একত্রিত এত প্রাতে।
বললো সে সব শুনে, 'আসুন সবাই।
একটি চাদর নিয়ে আসুন এখানে।'
চাদর বিছিয়ে, তার 'পরে রাখলো সে
নিজ হাতে কৃষ্ণ পাথরটি। তারপর
ডেকে নিলো কাছে কলহ-বিবাদে লিপ্ত
সব গোত্রপ্রধানকে। জানালো আহ্বান
অতঃপর, 'সবাই একত্রে চাদরের
প্রান্তদেশ ধরে এগিয়ে চলুন।' কৃষ্ণ
পাথর রাখার স্থানে পৌছানোর পর,
মহম্মদ নিজ হাতে পাথরটি নিয়ে,
দিলো বসিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে। বলে উঠলো
সানন্দে সবাই, 'সর্বোত্তম ফয়সালা।
আমরা সন্তুষ্ট মহম্মদের উপর।'

সন্তুষ্ট সবাই মহম্মদের উপর;
কিন্তু সে সন্তুষ্ট নয় কিছুতেই নানা
অপকর্মে লিপ্ত পথভ্রান্ত এইসব
মানুষের 'পরে। হঠাৎ ভীষণ ভালো,
আবার হঠাৎ করে জঘন্য বর্বর;
এ যেন এমন আবহাওয়া, সকালে
রোদ্দুর, দুপুরে হঠাৎ ঝড় ও বৃষ্টি,
বিকালে আবার ঝরঝরে নীলাকাশ।
বড়ই বিচিত্র এইসব লোক। এরা
চলে না যুক্তিতে; এদের চালায় শুধু
এদের অবাধ্য মন, যে-মনে কেবলি
কিলবিল করে ভালবাসা-ক্রোধ-ঘৃণা।

যত দিন যায়, মহম্মদ যায় ডুবে
তত বেশি ধ্যানে। দিবসে-নিশীথে তাঁর
নিরলস নিমজ্জন নির্জনতা আর
অন্তর্মুখিতায়। খাদিজা ততই তাঁকে
চোখে চোখে রাখে; দিয়ে যায় প্রাণভরে
সাহস, সান্ত্বনা, বরাভয়। মহম্মদ
মাঝে মাঝে ছুটে এসে তাঁকে বলে, যেন
ভয় পেয়ে যাওয়া শিশু, এরকম সব
কথা, শোনেনি যা কখনো কোথাও। বলে,
'হে আমার প্রিয় পত্নী, আমার কি হবে
কও! যেদিকেই যাই, ফিসফিস করে
কারা বলে, ‘তুমি নবি।' আকাশে তাকাই,
নেই কেউ; ঘাড় ফেরালেই ফের শুনি,
‘আনতা রসুল! ' আশপাশে চাই, সব
ফাঁকা; পথ চললেই ফের শুনি, ‘নবি!
ওহে নবি।‘' কখনো সে বলে, 'হে খাদিজা,
বৃক্ষেরা আমাকে ডেকে দিয়েছে সালাম।'
কখনো সে কয়, 'বনের হরিণ এসে
বললো আমাকে, ‘নবি! সালাম! সালাম! ''
আবার কখনো বলে, 'যখন নির্জনে
চলি, চারদিকে শুধু শুনি এই ধ্বনি—
‘ইয়া রসুল, সালাম আলাইকা! ইয়া
নবি, সালাম আলাইকা! '' খাদিজা বুঝায়
বুঝে বা না বুঝে কতভাবে, আর দেয়
অভয়, 'তুমি তো সত্যবাদী, করোনি তো
কোনো অন্যায় কখনো, করোনি তো কারো
ক্ষতি; হতেই পারে না কোনো অকল্যাণ
তোমার; তোমাকে রক্ষা করবেন প্রভু।'

যেভাবে প্রসব-বেদনার আগে মীন
চলে যায় একান্ত নিভৃতে, নীল তিমি
অথৈ সমুদ্রের নিচে খোঁজে নির্জনতা,
বনের হরিণী আরো সুগভীর বন
আর বিহঙ্গ নিবিড় নীড়; সেইভাবে
নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে, কোথায় মক্কার
আল-আমিন যায় ছুটে যখন তখন?
একদিন মহম্মদ এসে বলে, 'আমি
পেয়েছি নির্জন স্থান এক, খুঁজে। মক্কা
থেকে দু-মাইল দূরে জাবালে নুরের
হেরা গুহা। এ-গুহায় বসে রাত্রিদিন
ডুবে থাকতে চাই আমি আমার প্রভুর
ধ্যানে।' বললো খাদিজা শুনে, 'মহম্মদ,
হে আমার ভালো স্বামী, আমাকে রেখো না
উৎকণ্ঠার মাঝে। যাবে যাও, খাবার ও
পানি নিয়ে যাও সাথে। শেষ হলে, নিয়ে
যেও এসে ফের। কিংবা আমি যাবো।' শুনে
বিচলিত মহম্মদ বলে ওঠে, 'না, না,
সে তো ঢের উঁচু। কিভাবে সম্ভব, তুমি
উঠবে সেখানে পায়ে হেঁটে? তার চেয়ে
আমিই বরং নিয়ে যাবো এসে এসে।'

তবু কি খাদিজা শোনে? গেছে মহম্মদ,
দুই দিন হয়ে গেল; রোকেয়া-যয়নব
বারবার এসে বলে, 'বাবা কই, ও মা? '
কী দেবে উত্তর! এতদিন সে তো এক
দিন পরপর এসেছিল; এবার কী
হলো! কেন তাঁর ফিরতে অযথা দেরি?
যে-খাবার গেছে নিয়ে, চলার তো কথা
নয় এত দিন! মানুষটা অন্যদের
মতো কেন নয়? কেন সে থাকে না
শুধু ডুবে ঘরকন্না, ব্যবসা-বাণিজ্য
আর পৃথিবীর সব আনন্দ-আহ্লাদে?
কেন তাঁর এত ধ্যান, এত নিমগ্নতা
মানুষে-স্রষ্টায়? পৃথিবীর সব বোঝা
মাথার উপর তুলে নিয়ে, কে বলেছে
তাঁকে, ছটফট করতে রাতদিন? খাদিজা
শুধায় নিজেকে নিজে, 'সে কি কোনোদিন
দিয়েছে তোমাকে ব্যথা, কথায় কি কাজে?
স্ত্রীর অধিকার থেকে করেছে বঞ্চিত?
কী খারাপ তুমি দেখেছো চরিত্রে তাঁর? '
খাদিজার গণ্ডদেশ ভিজে যায় জলে।
সে যেন চীৎকার করে বিশ্বকে শোনাতে
চায়, 'মানুষের মধ্যে সে শ্রেষ্ঠ মানুষ;
পুরুষের মধ্যে সে পুরুষোত্তম; যদি
সুন্দরের কথা বলো, কুসুমও সুন্দর
নয় তাঁর চেয়ে। কোকিল কি তাঁর চেয়ে
মিষ্টভাষী? সহস্র জীবন যদি থাকতো
আমার, আমি তা দিয়ে যেতাম যে তাঁকে
ভালবেসে চিরকাল, তবুও তো তাঁকে
ভালবাসার সাধ মিটতো না কোনোদিন।'

থমথমে রাত। চাঁদ-তারাদের দেখা
নেই আসমানে। চতুর্দিক দেখে নিয়ে,
সাবধানে দু-পা টিপে টিপে নিজঝুম
নিশীথের ঘিরকুট অন্ধকার চিরে
জাবালে নুরের দিকে ছুটলো খাদিজা,
যেন ঝড়, লুকিয়ে আঁচলে খানাপানি।
তাঁকে কি হুতোম পেঁচা মুখ ভেংচিয়ে
দিয়েছিল একবারও ভয়? তাঁর পাছে
লেগেছিল কোনো ফেউ? সে কি ভয় পেয়ে
গিয়েছিল থমকে হঠাৎ একবারও
ভীষণ সে-অন্ধকারে? মহম্মদ যার
হৃদয়ে-দুচোখে নক্ষত্রের মতো জ্বলে,
কাকে সে ডরায় আর মর্ত্যে ও অমর্ত্যে?
কত রাত হয়েছিল, যখন সে একা
এ-গুহা সে-গুহা খুঁজতে খুঁজতে শেষে
পেয়ে গিয়েছিল তার প্রাণের স্বামীকে?
তাঁকে দেখে মহম্মদ হয়েছিল বুঝি
বিস্ময়ে নির্বাক, নাকি দুচোখের পানি
ফেলে খাদিজার নাম ধরে করেছিল
হেদায়েতের প্রার্থনা স্রষ্টার দরবারে?
হায়, পুণ্যা নারী, কে বলে তোমাকে ভীরু?
কে তোমাকে কয় অবলা অক্ষমা? তুমি
পারো, সবই পারো, পুরুষের মতো পারো;
কখনো অধিক পারো পুরুষের চেয়ে।
প্রণয়ে তোমার কেউ নেই সমকক্ষ,
জানে তা জগৎবাসী। তোমার ও-বক্ষ
ধরে এত প্রেম, মিলনের এত ক্ষুধা,
যেন তা সমুদ্র! কষ্টক্লিষ্ট এ-বসুধা
স্বর্গের অধিক হয়ে ওঠে সুধাময়,
যদি তুমি ভালবাসো। তোমার হৃদয়
যদি এসে ছুঁয়ে দেয় আমাদের বুক,
সেরে যায় সব জ্বালা, সমস্ত অসুখ।

তিনটি বছর গেল কেটে। মাঝে মাঝে
চলে যায়; পনের দিন কি এক মাস
পর আবার সে ফিরে আসে। ধ্যান তাঁর
হয়ে ওঠে যত গাঢ, তত সে থাকতে
চায় আরো একা। খাদিজা খাবার নিয়ে
দিয়ে দিয়ে আসে নূরে জাবালের 'পর
রাত্রির আঁধারে। পুরো রমজান মাসই
থাকবে সে গুহাতে এবার। এ-বছর
চল্লিশে করেছে পদার্পণ; চোখেমুখে
ছড়িয়ে পড়েছে আরো জ্যোতি; আরো বেশি
উঠেছে সুন্দর হয়ে, খাদিজা তা টের
পায়। বাতাসে সে পায় যেন বেহেস্তের
ঘ্রাণ। প্রাণ তার ‘পেয়েছি পেয়েছি' বলে
করে ওঠে চীৎকার বুকের ভিতর,
আর তত স্বামীর কল্যাণ-কামনায়
হয়ে পড়ে অস্থির। নির্ঘুম জাগে রাত।
সোমবার দিবাগত রাত্রি। ছয় শত
দশ সালের একুশে রমজান। সব-
কিছুই সর্বত্র হয়ে আছে কি-রকম
নির্বাক নিশ্চুপ! থেকে থেকে সমুদয়
নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে, কারা সব যেন
করে যাচ্ছে কানাঘুষা দিকচক্রবালে
কী নিয়ে, কে জানে! খাদিজার মন বলে,
কী যেন চলেছে ঘটতে এ-মহাবিশ্বে;
চমকে চমকে তাই উঠছে আকাশ,
ছুটছে সুমিষ্ট ঘ্রাণ পূর্ব ও পশ্চিমে।

নুরের নহর আছড়ে পড়েছে সব
সুপ্ত জনপদে। পাহাড়-পর্বত, ধু-ধু
মরুভূমি, খেজুরবাগান আর দূর
দিগন্তবিস্তৃত মানুষের মানচিত্র
স্বর্গীয় আলোয় করতেছে থইথই।
ময়ূর জুড়েছে নাচ। হরিণের পাল
ঘুম ছেড়ে বনে করতেছে ছুটোছুটি।
মরুর বাতাসে উঠেছে নিশীথে ভেসে
নাইটিঙ্গেলের সুর। আকাশের চাঁদ
হয়ে গেছে হতভম্ব বিশ্বময় দেখে
নুরের তুফান। কত কাল আগে, হায়,
তুর পাহাড়ের কোলে জ্বলে উঠেছিল
এরকম মহাজ্যোতি? অবাক আকাশ
আকাশে বসে তা ভাবে। হেরা গুহা আজ
বুঝি সে-জ্যোতির খনি! ছিলো মহম্মদ
অথৈ ধ্যানে ডুবে। আচমকা জিব্রাইল
নুরের শরীরে দাঁড়ালো সামনে এসে;
আলোকচ্ছটায় তাঁর, বিজলির মতো
চমকে উঠলো মাশরিক-মাগরিব।
বললো সে বজ্রস্বরে, 'পড়ো! ' মহম্মদ
সভয়ে উঠলো বলে, 'আমি তো পড়ি না! '
তা শুনেই জিব্রাইল বেঁধে নিলো তাঁকে
পবিত্র পঞ্জরে; তীব্রতর আলিঙ্গনে
করে দিলো বুকে ব্যথা। তাঁকে ছেড়ে দিয়ে
বললো আবার, 'পড়ো! ' মহম্মদ বলে,
'পড়তে পারি না আমি।' ফেরেস্তা তখন
পুনরায় তাঁর সাথে আলিঙ্গন করে
এত জোরে চাপ দিলো, কষ্ট হলো তাঁর।
ছেড়ে দিয়ে ফের, বললো সে তাঁকে, 'পড়ো! '
মহম্মদ তবু বলে, 'আমি তো পড়ি না।'
ফেরেস্তা আবার বেঁধে নিলো তাঁকে বুকে।
বুক থেকে বুকে পেন-ড্রাইফের মতো
লাগলো চালান হতে মহাপুণ্য বাণী,
যা ছিলো রক্ষিত লওহে মাহফুজে। ব্যথা
দিয়ে সারা বুকে, ছাড়লো আবার। ফের
বললো সে, 'পড়ো! ' তখন সে তাঁর সাথে
কণ্ঠ মিলিয়ে পড়তে লাগলো সশব্দে:
'ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খলাক।
খলাকাল ইনসানা মিন আলাক।
ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম।
আল্লাজি আল্লামা বিল কালাম।
আল্লামাল ইনসানা মা'লাম ইয়া'লাম।
--পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি
করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে
দানা বাঁধা রক্তপিণ্ড হতে। পড়ো, আর
তোমার পালনকর্তা বড়ই দয়ালু,
যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের দ্বারা।
শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, জানতো না
যা সে।' পবিত্র এ-বাণী অবতীর্ণ হলো
যেই, সমস্ত জগৎ পড়লো সিজদায়
নুয়ে। মাথা তুলে দেখতে পেলো না আর
শুভ্র সে উজ্জ্বল জ্যোতি। ভয়ে তাঁর কেপে
উঠলো সমস্ত শরীর। ধাতস্থ হয়ে
ছুটে চললো সে খাদিজার কাছে। তাঁকে
গিয়ে বললো আড়ষ্ট কণ্ঠে, 'হে খাদিজা,
আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে ফ্যালো! দ্রুত
আমাকে চাদর দিয়ে দাও ঢেকে! ' তাঁর
কথামতো ফেললো খাদিজা তাঁকে ঢেকে
গরম চাদরে। কিছুক্ষণ পর সবই
স্বাভাবিক হয়ে এলো। ত্রস্ত কণ্ঠে তবু
বললো সে, 'হে খাদিজা, আমার কী হলো! '
খাদিজা বললো, 'বলো, কী দেখেছো তুমি?
বলো, কী ঘটেছে? কিসেরই বা পাচ্ছো ভয়? '
হেরার ঘটনা বললো সে আদ্যপ্রান্ত।
অতঃপর 'হায়, আমার কী হলো! ' বলে
করতে লাগলো হাহুতাশ। বললো সে,
'হে খাদিজা, আমার তো জীবন নিয়েই
হচ্ছে আশঙ্কা।' খাদিজা বললো সদর্পে,
'কক্ষনো না! আল্লাহর কসম, কক্ষনো না!
হে আবুল কাশেম, করবেন না আল্লাহ
লাঞ্ছিত তোমাকে। তুমি তো সদ্ব্যবহার
করো আত্মীয়ের সাথে। দুঃস্থ-দুর্বলের
দায়িত্ব বহন করো। নিঃস্বকে সাহায্য
করো। মেহমানদের মেহমানদারি
করো। ঋণগ্রস্তদের ঋণের জোয়াল
তুলে নাও নিজ কাঁধে। যারা সত্যপথে
চলে, তাদেরকে সহায়তা করো তুমি।
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে করবেন না
অপদস্ত।' এই বলে নিয়ে গেল তাঁকে
ওরাকা ইবনে নওফিল ইবনে আসাদ
ইবনে অবদুল উযযার নিকট,
যে-ছিলো চাচাতো ভাই খাদিজার। তাঁর
পাণ্ডিত্যের কথা জানতো সবাই। তিনি
লিখতে ও পড়তে জানতেন ইবরানী
ভাষা; ছিলেন বিশুদ্ধ খ্রিস্টান-ধর্মের
অনুসারী; হয়ে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ ও
অন্ধ। খাদিজা বললো তাঁকে, 'ভাইজান,
আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। সে
কী সব বলছে ও অস্থির হয়ে পড়ছে।'

বললেন ওরাকা, 'ভাতিজা, কী দেখেছো
তুমি? আর বলো, কী হয়েছে তোমার? '
সে বললো সমস্ত ঘটনা খুলে। শুনে
মহাবিস্ময়ের সাথে বলে উঠলেন
ওরাকা, 'ইনি তো জিব্রাইল, আল্লাহর
সেই দূত, আগমন করতেন যিনি
মুসার নিকট! আসফোস! আমি যদি
সেদিন যুবক থাকতাম! আফসোস!
আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম,
যেদিন তোমার জাতি তোমাকে তোমার
জন্মভূমি থেকে বের করে দেবে! ' শুনে
জিজ্ঞাসা করলো মহম্মদ, 'সে-কি! এরা
বের করে দেবে আমাকে স্বদেশ থেকে? '
বললেন ওরাকা, 'হ্যাঁ, তারা বহিষ্কার
করবে তোমাকে। অতীতে তোমার মতো
যাঁরাই আল্লাহর বার্তা নিয়ে এসেছিল,
তাঁদের সবার সাথে এরকমই করা
হয়েছে। হে মহম্মদ, সে সময় যদি
বেঁচে থাকি, আমার সর্বস্ব দিয়ে আমি
তোমার সাহায্য করে যাবো।' কিন্তু এর
কিছুদিন পরই, মৃত্যু হয়ে যায় তাঁর।

--

POET'S NOTES ABOUT THE POEM
A Bengali epic
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Sayeed Abubakar

Sayeed Abubakar

Jessore / Bangladesh
Close
Error Success