নবিনামা
সায়ীদ আবুবকর
*** *** *** ***
তৃতীয় সর্গ
করুণ কিশোর
যেভাবে বৃক্ষের চারা ঊর্বরা জমিনে
দক্ষ কৃষকের নিবিড় পরিচর্যায়
বেড়ে ওঠে দ্রুত, সেইভাবে শিশুনবি
বাড়তে লাগলো আমিনার কোলে। তাঁর
জ্যোতির্ময় মুখে যে-চায় একটিবার,
সে-ই ভাবে, কোথা থেকে এ-আশ্চর্য শিশু
এলো এ-মরুর দেশে! পাড়ার ছেলেরা
মেতে ওঠে তাঁকে নিয়ে আনন্দখেলায়
প্রতিদিন। অবাক বিস্ময়ে তারা দ্যাখে,
মহম্মদ যেদিকেই যায়, মেঘ এসে
স্থির হয়ে থাকে তাঁর মাথার উপর।
তত তারা ছায়ার মতন ঘিরে ধরে
তাঁকে চতুর্দিক হতে, যেন রানী-মাছি,
যাকে ঘিরে আছে মধুপগণ মৌচাকে।
প্রতিদিন খেলা শেষে সন্ধ্যার আগেই
ফিরে যায় তারা গৃহে। হঠাৎ কী হলো
একদিন, কেঁপে ওঠে আমিনার বুক,
সন্ধ্যা বয়ে যায়, এলো না এখনো ফিরে
পুত্র তাঁর! খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দ্যাখে
খেলার মাঠের এক প্রান্তে বসে একা
কাঁদছে সে একমনে। শুধায় আমিনা,
"কী হয়েছে, বাছা, কও।" বলে মহম্মদ,
"প্রতিদিন খেলা শেষে সবারই পিতা তো
ছুটে আসে নিয়ে যেতে পুত্রকে। বলো মা,
কোথায় আমার পিতা? কেন সে আসে না
একটা দিনও? " পঞ্জরে জড়িয়ে পুত্রকে
কেঁদে ওঠে আমিনা সরবে, "হা-রে বাছা!
শুয়ে আছে ইয়াসরিবে তোমার জনক।
তোমার জন্মের আগেই নিয়েছে স্রষ্টা
তাঁকে তুলে। সমাধি দেখতে তাঁর, যাবো
আমরা শীঘ্রই। ফিরে চলো আজ ঘরে।"
যাবে মহম্মদ ইয়াসরিবে। মা আমিনা
ইয়াসরিবেরই কন্যা। ভ্রাতৃগৃহে উঠে
নিয়ে যাবে দেখাতে সমাধি— এরকমই
কথা হলো। দাদা আবদুল মুত্তালিব
পাঠালেন সাথে এক দাসী; নাম তার
উম্মে আয়মান। পিতার সমাধিস্থলে
থমকে দাঁড়ালো এসে শিশুনবি, যেন
উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তীরে এসে
কোনো ভিড়েছে জাহাজ। শেওলার মতো
ভাসলো সে অশ্রুজলে এবং কাঁপালো
আসমান নিঃশব্দ করুণ আর্তনাদে।
আমিনাও তাঁর স্বামীর সমাধি দেখে
ঝরাতে লাগলো অশ্রু— নির্বাক, নিশ্চুপ,
যেন আষাঢ়ের মেঘ মরুর আকাশে।
পুত্রের আবদারে থেকে গেল মা আমিনা
ভ্রাতৃগৃহে এক মাস। সকাল ও সন্ধ্যা
পিতার সমাধিস্থলে ছুটে যায় রোজ
পুত্র তাঁর, হাত তোলে স্রষ্টার দরবারে
আর মাগে তাঁর আত্মার মাগফিরাত।
যেদিন মক্কার পথে রওনা হলো তাঁরা,
হাঁটতে লাগলো মৃত্যু পশ্চাতে পশ্চাতে।
ছায়ার মতো সে হাঁটে পাছপাছ, যেই
পিছনে তাকায়, লুকায় নিজেকে; দেখে,
আমিনা কুঁকড়ে যায় ভয়ে। পিতৃহারা
পুত্রের চিন্তায় কলিজা শুকায়ে, হায়,
হয়ে যায় যেন খেজুরের মরা ডাল।
কিছু পথ পার হলে, আজরাইল এসে
আগলে ধরলো পথ। মহান স্রষ্টার
এ-কি খেলা নিদারুণ, সমস্ত আশ্রয়
ডুবায়ে অথই জলে, যেন মুসার মা
লোহার সিন্দুকে পুরে কোলের শিশুকে
ফেলে দিলো দরিয়ায়। পিতৃহারা শিশু
অশ্রুসিক্ত চোখে চেয়ে রইলো নিষ্পলক
প্রাণ উড়ে যাওয়া জননীর মিষ্টি মুখে।
নিরব নিথর সেই মুখে লেপ্টে আছে
কত ব্যথা, ভাষাহীন কত হা-হুতাশ
আর কত স্তব্ধ আর্তনাদ! কোনোদিন
'মহম্মদ' বলে উঠবে না ডেকে আর;
জুড়াবে না প্রাণ মধুর মায়াবী ডাকে।
'হায়, মাগো! কী করে অটবি বাঁচে, মাটি
বিনে? পানি বিনে, কী করে বাঁচে গো মীন?
আর মা বিনে, কী করে হে সন্তান? আমি
কোন্ দরদীর কাছে যাবো, এত স্নেহ,
এত মমতায় ভরা? ‘মা'—এ মিষ্টিনামে
আর কাকে ডাকবো, মা, আমি? পিতৃহীন,
মাতৃহীন— পৃথিবীতে এ-কেমন বাঁচা! '
মুখে কোনো ধ্বনি নেই, শুধু অশ্রুজলে
ভেসে চলে যেন কথা। করুণ এ-দৃশ্যে
আকাশ উঠলো কেঁদে; মরুর বাতাস
উঠলো সিক্ত হয়ে, যেন জলে ভেজা চোখ;
পড়ে গেল আহাজারি বিশ্বময় জলে
আর স্থলে। বনের হরিণ কাঁদে; কাঁদে
নাইটিঙ্গেল দূরে কোথা, যার সুরে
উথলে ওঠে মরুভূমি; সেই সুর শুনে
পথিক হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় পথে।
উম্মে আয়মান আমিনার লাশ নিয়ে
জুড়ে দেয় আর্তনাদ, বুলায় কম্পিত
হাত বোবা বনে যাওয়া এতিম নবির
পবিত্র মস্তকে বারবার, আর বলে:
"আজ থেকে আমি তোর মাতা, বাছা। তোর
জননী যে তোকে দিয়ে গেল ফাঁকি চির-
তরে! হায়, আমি কার কাছে যাবো, কাকে
গিয়ে বলবো এ-বিদেশভুঁইয়ে এই
বিপদের কথা? কে বা এসে আমাদের
করবে সাহায্য? " তার আর্তনাদ শুনে
ছুটে এলো লোকজন। জানতে চাইলো
তারা মৃত মহিলার পরিচয়। যেই
শুনলো কুরাইশ বংশের কথা আর
মৃত মহিলার শ্বশুরের নামধাম,
ভক্তিতে নুয়ায়ে দিলো শির, সাথে সাথে
ব্যস্ত হয়ে পড়লো তারা কাবার রক্ষক
কুরাইশসর্দার মুত্তালিবের পুত্রবধূ
আমিনার কবরখননে। মার সেই
বিষণ্ন কবর ভিজায়ে চোখের জলে,
ফিরে এলো নবি উম্মে আয়মানের সাথে
জন্মভূমি মক্কায়। মা-হারা বাপহারা
অভাগা পৌত্রকে বুকের অলিন্দে বেঁধে
বৃদ্ধ মুত্তালিব করে উঠলো আর্তনাদ
‘আমিনা আমিনা' বলে। তাঁর আর্তনাদে
ভিজে গেল মক্কার বাতাস। পুত্রগণ-
পুত্রবধূগণ দিতে লাগলো সান্ত্বনা;
কন্যাগণ ‘মহম্মদ মহম্মদ' বলে
কাঁদতে লাগলো জনকের সাথে সাথে।
মক্কার মানুষজন করলো এসে ভিড়,
শুনলো দুঃখের কথা কান পেতে, দেখলো
এতিম শিশুর চন্দ্রমুখ চেয়ে চেয়ে
আর দুঃখ পেয়ে ফিরে গেল তারা ঘরে।
হারিয়েছে জনক যে জন্মের আগেই,
ষষ্ঠ বছরে জননী, জন্মদুঃখী বুঝি
জগতে তাকেই বলে! ভেঙেছে কপাল
যার ঠুনকো মাটির কলসির মতো, কিসে
জোড়া দেবে সে-কপাল, কতটুকু পানি
ধরবে সে জলাধারে? পুত্রের অধিক
স্নেহে-যত্নে রেখেছিল আগলে যে-দাদা,
সেই বৃদ্ধ মুত্তালিবেরও এলো যে ডাক
পরপার থেকে। আবু তালিবের হাতে
সঁপে দিয়ে এতিম পৌত্রকে, বুজলেন
তিনি চোখ। অথই পাথারে সীমাহীন
তরঙ্গমালার মাঝখানে ভেসে চলা
কোনো কলাগাছ ধরে ভাসতে লাগলো
যেন জগতের শেষ নবি, জীবনের
অষ্টম বছরে। চাইলেন স্রষ্টা বুঝি—
ছিঁড়ে যাক সমস্ত বন্ধন, মহম্মদ
থাক শুধু বাঁধা তাঁর অদৃশ্য রশিতে,
যেন তাঁর নিষ্পাপ অন্তরে রব ছাড়া,
এক আল্লাহ ছাড়া থাকে না কিছুই, যেন
সে বুঝতে পারে তাঁর রক্ষক স্রষ্টাই,
যিনি শুধু 'কুন' বলে সৃষ্টি করেছেন
মহাবিশ্ব, সব সৃষ্টি যাঁর নির্দেশেই,
অদৃশ্য কি দৃশ্যমান, করে ওঠাবসা।
সামর্থ্যের সব দিয়ে পালতে লাগলো
পিতৃব্য আবু তালিব; পারলে পিতার
অধিক ভালবাসায় ডুবিয়ে রাখে সে
ভ্রাতুষ্পুত্রকে, সকলে পায় টের। পিতা
আবদুল মুত্তালিব দিয়েছে যে-রত্ন
তুলে তাঁর হাতে, তাঁর যত্নের কমতি
দেবে না সে হতে কোনোদিন। মহম্মদ
পায় না মোটেই টের, আছে সে চাচার
গৃহে। চাচা ও চাচীর, যেন সে চোখের
মণি। একটা নজর দেয় না কখনো
চক্ষুর আড়াল হতে তাঁরা। তাঁরা জানে,
এ এক আশ্চর্য কিশোর, জানে না মিথ্যা-
ছল-চাতুরি; দুষ্টামি-দস্যিপনা নেই
স্বভাবে কখনো তাঁর; কেমন গম্ভীর
ধ্যানমগ্ন হয়ে কাটে তাঁর কাল; যেই
তাঁকে দ্যাখে, মধুর হাসিতে তাঁর হয়ে
যায় খুন, ভালো তাঁকে না বেসে থাকে না
উপায়। জানতো আবদুল মুত্তালিব
পৌত্রের রহস্যময় ব্যক্তিত্বের কথা।
তাই সে বসাতো তাঁকে তাঁর পাশে কাবা-
গৃহের ছায়ায় তাঁর সম্মানে বিছানো
বিশেষ আসনে, যেখানে পুত্রেরা তাঁর
করেনি সাহস বসবার। জানে আবু
তালিব, তাঁর এ-ভ্রাতুষ্পুত্র একদিন
সবা'কে ছাড়িয়ে উঠে যাবে বহু উর্ধ্বে,
বনু হাশিম গোত্রের কেউ দ্যাখেনি যা
স্বপ্নেও কখনো। আবু তালিবের বক্ষে-
হৃৎপিণ্ডে, সারাক্ষণ, মহম্মদ তাই
বাবুই পাখির বাসা। মক্কাবাসীগণ
ছুটে এলো একবার আবু তালিবের
গৃহে। তারা বললো, "হে মুত্তালিবপুত্র,
শুনুন দুঃখের কথা আমাদের। গোটা
আরবভূখণ্ডে নেমেছে দুর্ভিক্ষ। বৃষ্টি
ছাড়া এইবার আমরা তো হয়ে যাবো
নিঃস্ব। চলুন, সবাই কাবাগৃহে গিয়ে
কান্নাকাটি করি একসাথে, যদি বৃষ্টি
হয়! " শুনে ভ্রাতুষ্পুত্র মহম্মদকে নিয়ে
ছুটলো আবু তালিব কাবাগৃহে। যারা
এসেছিল তাঁর বাড়ি, তারা থ হয়ে
দেখতে থাকলো আবু তালিবের সাথে
ছুটে চলা অপূর্ব সুন্দর কিশোরকে।
কে এই কিশোর, তারা করতে লাগলো
বলাবলি। কেউ বললো, তাঁরই পুত্র; যারা
জানতো, বললো তারা, ভ্রাতুষ্পুত্র তাঁর।
কাবাগৃহে পৌঁছানো মাত্রই, আশ্চর্য সে-
কিশোরকে পবিত্র কাবার দেয়ালের
সাথে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বললো
আবু তালিব। চাচার হাতের আঙুল
ধরে দাঁড়িয়ে রইলো মহম্মদ। ফর্সা
নীলাকাশ অকস্মাৎ মেঘে মেঘে গেল
ছেয়ে। সেই মেঘ ভেঙে নেমে এলো দীর্ঘ
প্রতীক্ষার বৃষ্টি ঝমঝম। এত বেশি
বৃষ্টিপাত হলো, উপত্যকা ডুবে গিয়ে
উপক্রম হলো প্লাবনের; মাঠঘাট
প্রাণ ফিরে পেয়ে হয়ে উঠলো সবুজাভ।
আবু তালিব আনন্দে করতে লাগলো
আবৃত্তি সরবে, "লোকেরা জানতো যদি
আকাশে কোথায় বৃষ্টি থাকে! কার নামে
নামে সে অমিয় বারি পৃথিবীর বুকে!
সে এমন, যাঁর চেহারার গুণে ঝরে
পড়ে রহমত। সে আমার চক্ষুমণি।"
চাচার সমস্ত কাজে দাঁড়ায় ছায়ার
মতো এসে মহম্মদ। মেষপাল নিয়ে
ছুটে যায় মাঠে। তাঁকে ঘিরে রেখে তাঁর
মেষগুলো চরে বেড়ায় কি-শান্তভাবে
আর মহম্মদ সেই ফাঁকে ডুবে যায়
যেন নূড়ি, ধ্যানের সমুদ্রে—‘সুবিশাল
এ-আকাশ কে বানালো, স্তম্ভ ছাড়াই যা
ঝুলে আছে পৃথিবীর 'পর? কে বানালো
চন্দ্র-সূর্য, পাহাড়-পর্বত? পূর্বাকাশে
সূর্য ওঠে কার নির্দেশে? পশ্চিমে অস্ত
যায় কার ইশারায়? কেন হয় দিন?
কার ভয়ে সেই দিন রাত্রি হয়ে যায়?
মনুষ্যনির্মিত মূর্তির কী সাধ্য, বিশ্ব-
ব্রহ্মাণ্ডকে ঘুরায় আঙুলে! তবু কেন
নারী-নর নিরন্তর করে যায় পূজা
প্রাণহীন লাত ও উজ্জাকে? মানুষের
কী হয়েছে, কেন তারা জীবন্ত কবর
দেয় কন্যাশিশু, নারীদের তুচ্ছ ভেবে
করে অবহেলা, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করে
তুচ্ছ অজুহাতে? মানুষের কী হয়েছে,
বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, অসভ্যতা নিয়ে
ডুবে থাকে সারাক্ষণ? হারিয়ে মানব-
সত্তা, বানিয়েছে সমস্ত নগর যেন
পশুর আগার! ভুলে গেছে দয়ামায়া;
মানুষকে হত্যা করে তুষ্ট করে যত
নষ্ট প্রেতাত্মাকে; চক্ষুহীন এ-সমাজে
নিষ্প্রাণ মূর্তিরই মূল্য বেশি মহামূল্য
মানুষের চেয়ে; কী হয়েছে মানুষের? '
ধ্যানমগ্ন মহম্মদ চক্ষু খুলে দ্যাখে
দাঁড়িয়ে দুজন লোক, সুদর্শন, শুভ্র
শ্মশ্রূধারী, সুন্দর পোশাক পরে, সারা
গায়ে ছড়িয়ে সুঘ্রাণ, করছে অপেক্ষা
তাঁর জন্যে। ইশারায় তাঁরা তাঁকে নিয়ে
চললো নির্জনে। তারপর চেপে ধরে
দু-হাত, শোয়ায়ে দিলো চিৎ করে শক্ত
মাটিতে; দিয়েই চিরে ফেললো তাঁর ছিনা।
একজন বললো আরেকজনকে, "এঁর
ভিতরের কুপ্রবৃত্তিগুলো বের করে
ফেল। ভরে দাও, অতঃপর, প্রকাশ্য ও
গুপ্ত সমুদয় জ্ঞান, বিনয়, নম্রতা,
সততা, দয়া ও উন্নত চরিত্রসহ
যাবতীয় সদগুণ।" বের করা হলো
বুকের মধ্যস্থ হতে কালো রক্ত যত।
ধুয়ে ফেলা হলো, তারপর, হৃৎপিণ্ড
শুভ্র স্বচ্ছ সুগন্ধি পানিতে। কী একটা
বস্তু, অতঃপর, দেখতে রূপার মতো,
রেখে দেওয়া হলো তাঁর বুকের ভিতর।
দিয়ে, ছিন্ন বক্ষস্থল জোড়া দেওয়া হলো
এইভাবে, বুঝাই গেল না, কেউ এসে
এইখানে মেরেছিল ছুরি। তারপর
বললো তাঁরা, "উঠে যাও। করে দেওয়া হলো
পবিত্র তোমাকে। আজ থেকে নিশ্চিন্ত ও
নিরুদ্বেগ থাকো। আল্লাহ তোমার ‘পরে
বর্ষণ করুন রহমত।" এইকথা
বলে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল তাঁরা।
পিতৃব্য আবু তালিব শোনে সব কথা।
শুনে হয়ে পড়ে আতঙ্কিত ভাতিজার
নিরাপত্তা নিয়ে।চক্ষুর আড়াল হতে
দেয় না সে তাঁকে আর। জানে সে, এ এক
আশ্চর্য কিশোর, যাঁর মাথার উপর
খাড়া হয়ে থাকে মেঘমালা, গাত্রে যাঁর
বসে না মশা ও মাছি, যাঁর সাথে মাঠে
মেতে ওঠে মেষপাল আনন্দখেলায়,
যেই তাঁকে দ্যাখে একটিবার, থ হয়ে
চেয়ে থাকে তাঁর চন্দ্রমুখে। চোখে চোখে
রাখে তাঁকে সমস্ত সময়, যাতে কেউ
করতে না পারে তাঁর জীবনের ক্ষতি।
ছোটোখাটো ব্যবসা ছিলো আবু তালিবের,
সিরিয়ার সাথে। ব্যবসার পণ্য নিয়ে
যেতে হবে সিরিয়ায়। নিচ্ছিল প্রস্তুতি
তার। মহম্মদ ছুটে এসে বলে, "চাচা,
আমাকেও নিন সাথে।" "সিরিয়া কি, হায়,
এইখানে! বহু লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে
যেতে হয় সেই দেশে। কুলাবে কি এত
লম্বা সফর, হে বাছা, শরীরে তোমার? "
তবু সে ধরেছে জিদ। আবু তালিবও
ভাবলো একথা শেষে— কার কাছে, হায়,
রেখে যাই তাঁকে? কেবা দেবে নিরাপত্তা
তাঁর? তার চেয়ে এ-ই ভালো, থাকলো সে
সাথে সাথে তাঁর। হবে না তাহলে তাঁকে
থাকতে দুশ্চিন্তায়। বাণিজ্য বহর নিয়ে
চললো কাফেলা ছুটে নির্দিষ্ট তারিখে।
এই সে প্রথম মক্কার বাইরে; তাও
বাণিজ্যের উদ্দেশে! আহা-কি উত্তেজনা,
আনন্দ-উচ্ছ্বাস পড়েছে ছড়িয়ে তাঁর
শরীরে ও মনে! ধু-ধু মরুভূমি যেন
হাতছানি দিয়ে ডাকে—আয় আয়। ছোটে
মরুর জাহাজ বাধা-বিঘ্ন পায়ে দলে,
দুর্দম, দুর্বার। তারও আগে আগে চলে
অবাক কিশোরমন ছুটে—‘হে সুদূর,
অসীম সুদূর, তোমার অচিন দেশে
আমার পায়ের চিহ্ন রেখে যাবো আমি;
তারপর একদিন তোমাকে ছাড়িয়ে
কোথায় যে যাবো, আমার তা জানা নেই।'
চলতে চলতে থামলো কাফেলা এসে,
বিশ্রামের জন্যে, বসরায়। সুপ্রাচীন
এক বিশাল বৃক্ষের নিচে তাবু গেড়ে
শরীর এলিয়ে দিলো তাঁরা। পাশে ছিলো
প্রসিদ্ধ একটি গির্জা। থাকতো সেখানে
পাদ্রী এক, জারজিস নামে। লোকে তাঁকে
ডাকতো বাহীরা বলে। থাকতো সে ডুবে
জপে-ধ্যানে রাত্রিদিন। গির্জার বাইরে
কোনোদিন আসতে দ্যাখেনি তাঁকে কেউ।
মক্কার কাফেলা দেখে, হঠাৎ সেদিন
বের হয়ে এলো সে। লোকেরা ছুটে গিয়ে
বললো, "বাহীরা! কী ব্যাপার? " সে বললো,
"মক্কা থেকে যে-কাফেলা এসেছে এখানে,
আমি তাদেরকে আপ্যায়ন করতে চাই।
কেউ গিয়ে পৌঁছে দাও আমার দাওয়াত
তাঁদেরকে।" এই বলে ঢুকে পড়লো সে
আবার গির্জায়। কাফেলার সব লোক
উপস্থিত হলো সেই গির্জার ভিতর।
বাহীরার সাজানো খাদ্যের স্তুপ দেখে
অভিভূত হলো তাঁরা। বাহীরা বললো,
"কাউকে কি এসেছেন আপনারা রেখে
পণ্যসামগ্রীর কাছে? " "একটি বালক
আছে পাহারায় সেখানে, " বললো তারা।
সে বললো, "কেউ যান, অনুগ্রহ করে
তাঁকেও আসুন নিয়ে। নিশ্চিন্ত থাকুন,
এইসব পণ্য কেউ ছুঁয়েও দেখবে না।"
মহম্মদ এসে যেই ঢুকলো সেখানে,
বাহীরা আনন্দে জুড়ে দিলো চীৎকার:
"এই তো সে সাইয়েদুল আলামিন! ওহে
শোনো, এই তো সে সাইয়েদুল মুরসালিন।"
সে-কথার মাথামুণ্ডু বুঝলো না কেউ।
সে বললো, "অনুগ্রহ করে এইবার
আরম্ভ করুন আপনারা।" কিন্তু তাঁর
চাহনির দিকে চেয়ে রইলো আবু তালিব।
জারজিস বারবার অবাক দৃষ্টিতে
দেখছিল চেয়ে চেয়ে তাঁর ভাতিজাকে।
না জানি কী মতলব আছে তাঁর মনে—
ভাবতে লাগলো সে। বাহীরা উঠে এসে
বললো তাঁর কানে কানে, " বলুন, সর্দার,
আপনার সঙ্গী এই পুণ্য বালকের
মাতাপিতা বুঝি করেছেন ইন্তেকাল? "
বললো আবু তালিব, "ঠিকই ধরেছেন,
ইন্তেকাল করেছেন তাঁরা। তবে আমি
এর চাচা। এর দেখভালের দায়িত্ব
আমারই উপর।" বললো বাহীরা শুনে,
"আপনার এ-ভাতিজা শেষ জামানার
নবি। সাবধান হয়ে যান। একে নিয়ে
যাবেন না শাম দেশে। চিনতে পারলে,
ইহুদী-খ্রিস্টানগণ ফেলবে হত্যা করে
তাঁকে।" বলে উঠলো সন্তস্ত্ আবু তালিব,
"হে রাহেব, বুঝলেন কিভাবে আপনি? "
"গিরিপথের ও-প্রান্ত থেকে এ-কাফেলা
যখন আমার দৃষ্টিতে পড়লো ধরা,
আমি দেখতে পেলাম, বৃক্ষ ও প্রস্তর
সিজদা করছে তাঁকে। তৌরাত কিতাবে
এরকমই আছে, যখন আখেরি নবি
বৃক্ষসমূহের পাশ দিয়ে যাবে, তাঁকে
সিজদা করবে বৃক্ষেরা। আকাশে চেয়ে
দেখি, একখণ্ড মেঘ ছায়া দিতে দিতে
এগিয়ে চলেছে কাফেলার সাথে সাথে।
কি-আশ্চর্য, বৃক্ষের তলাতে এসে যেই
থামলেন আপনারা, দেখতে পেলাম,
বৃক্ষের উপর এসে স্থির হয়ে গেল
সেই মেঘ। আমার এখানে আপনারা
আসার পরও সে-মেঘ দেখলাম সেই
বৃক্ষের উপর হয়ে আছে স্থির। ফলে
আমার বিশ্বাস হলো, কেউ একজন
রয়ে গেছে সেখানে, যে এই রহস্যের
কেন্দ্রবিন্দু। অতঃপর আমাদের ডাকে
সাড়া দিয়ে, সে যখন আসতে লাগলো
আমাদের কাছে, স্থির সেই মেঘ দেখি
ছুটতেছে তাঁর সাথে সাথে। আপনার
ভাতিজা নিশ্চয় সেই ভাগ্যবান নবি,
যাঁর চেহারা দেখার জন্যে এতকাল
চাতকের মতো পথ চেয়ে আছি আমি।
দেখুন, পবিত্র পৃষ্ঠদেশে তাঁর, দেয়া
আছে নবুয়তের সিল (যা দেখতে ছোট্ট
আপেলের মতো) দু-স্কন্ধের মাঝখানে।
পুণ্য বাইবেলে এরকমই আছে লেখা।
হে কাফেলার সর্দার, সত্তর পাঠিয়ে
দিন তাঁকে মক্কায়। ইহুদী-খ্রিস্টানেরা
যদি নবি বলে চিনতে পারে তাঁকে, তাঁর
উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে নেকড়ের মতো,
তাঁকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত হবে না
ক্ষান্ত তারা। সাবধান, হে আবু তালিব! "
ভাতিজাকে নিয়ে ফিরতে না ফিরতেই,
সশস্ত্র রোমান সৈন্য, সাতজন, ছুটে
এলো বাহীরার কাছে। "হে বাহীরা, বলো,
শেষ জামানার নবি সম্বন্ধে কী জানো
তুমি? রোমসম্রাটের নির্দেশে আমরা
হয়রান হয়ে খুঁজতেছি তাঁকে। শেষ
নবি নাকি এসে গেছে পৃথিবীতে; এই
কথা জানতে পেরেছি আমরা। আমরা
হত্যা করে ফেলবো তাঁকে, যদি খুঁজে পাই।"
বললো বাহীরা হেসে, "বৃথাই তোমরা
হয়রান হয়ে খুঁজতেছো তাঁকে। যদি
সত্যিই ঈশ্বর পাঠিয়ে থাকেন বিশ্বে
তাঁর পছন্দের শেষ নবি, তাহলে তো
তিনি নিজেই দেবেন তাঁর নিরাপত্তা;
জগতের সাধ্য কার, হত্যা করে তাঁকে! "
বাহীরার কথা শুনে হতাশ সৈন্যরা
যে-রাস্তায় এসেছিল, সেই রাস্তা ধরে
গেল ফিরে, যেন হিংস্র মাজা ভাঙা সাপ।
------
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem