নবিনামা
সায়ীদ আবুবকর
*** *** *** ***
প্রথম সর্গ
আবির্ভাব
আমাকে ভিজিয়ে দাও ক্ষমার বর্ষণে;
তাঁর পুণ্য নাম মুখে আনার আগেই
এ-বুক বিদীর্ণ করে করো কাওসার;
দু-ঠোঁটে বাজার আগে মহম্মদ-ধ্বনি,
এ-ঠোঁট বানিয়ে দাও বেহেস্তের বাঁশি;
কাব্যের লালিত্যে তাঁকে ছোঁয়ার আগেই
পুষ্পের বাগান করো আমার মস্তিষ্ক,
কেবলি যেখান থেকে উড়বে সৌরভ,
যে-সৌরভে স্বর্গমর্ত্য হবে সুরভিত!
আমি গোনাহগার, প্রভু; তবু তাঁর প্রেম
এ-হৃদয়ে ফল্গুধারা দিয়েছে বহায়ে,
যাঁকে তুমি ভালোবাসো, যাঁর জন্যে তুমি
করেছো সৃজন সব কুল-মাখলুক,
মিলিয়েছো বক্ষ তুমি মিরাজের রাতে
যাঁর বক্ষদেশে; তুমি তাঁর প্রশংসায়
হয়েছো মুখর মহাপবিত্র কিতাবে,
জানে তা জগৎবাসী। তুমি যাঁর স্তুতি
করো হে জগৎপতি উচ্ছ্বসিত স্বরে,
আমি কোন্ ছার, থাকি নির্লিপ্ত নির্জীব,
হবো না নিমগ্ন তাঁর মহাগুণগানে!
যদি কও, ‘তুচ্ছ তুই, গাহিবি কিভাবে
এত উচ্চ গাথা! '; তবে এই তুচ্ছজনে
দাও ঢেলে শক্তি তুমি মহাশক্তিধর,
প্রজ্ঞার, প্রেমের আর কাব্য-কৌশলের।
তোমার শক্তির কথা কিবা আমি কবো,
যে-তুমি নির্মাণ করো শুধু ‘কুন' বলে
জমিন ও খাম্বাহীন সপ্ত আসমান
ছয় দিনে, মহাশূন্যে; যে-তুমি রেখেছো
সৃষ্টি করে এরকম জন্তু অগণন
তোমার জিম্মায়: করে যদি অকস্মাৎ
বিদ্রোহ কস্মিনকালে এ-মহাবিশ্বের
সব সৃষ্টি একসাথে, একটি যদি ছাড়ো,
মুহূর্তেই ফেলবে খেয়ে একটিমাত্র গ্রাসে
তাবৎ সৃষ্টিকে; তুমি মহাজাদুকর,
একই মৃত্তিকা থেকে ওঠাও উদ্ভিদ
কত না জাতের, দিচ্ছে কেউ মিষ্টি ফল,
কেউ তিতে, কেউ টক; আবার তাদের
ডালে ডালে, কাণ্ডে কাণ্ডে, পাতায় পাতায়
কি-বিচিত্র রঙ! সাত সমুদ্রের পানি
হতো যদি কালি, প্রশস্ত জমিন হতো
লিখবার খাতা, অরণ্যের তরুরাজি
লেখার কলম; তোমার শক্তির কথা
শেষ করা যেতো না তো লিখে! সে-শক্তির
এক অণু-পরমাণু ধ্বংস করে দেবে
মুহূর্তেই, পারমাণবিক চুল্লি যত
আছে পৃথিবীতে; রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের
উল্টে যাবে চোখ বিস্ময়ে, আতঙ্কে। সেই
তুমি হানো যদি কৃপাদৃষ্টি এ-অধমে,
আমার কবিতা হয় আনন্দসাগর,
আছড়ে আছড়ে পড়বে যার ঢেউ-উপঢেউ
মানবহৃদয়ে। দেব ও দেবীর স্তুতি
মহাকাব্যে এতকাল করেছে কবিরা
নতশিরে; আমার উন্নত শির, প্রভু,
জানে না প্রণত হতে, তোমার সত্তার
কাছে ছাড়া; রাত্রিদিন তোমার সিজদায়
পড়েছে হুমড়ি খেয়ে অস্তিত্ব আমার
মহাত্রাসে; কী আছে অন্তরে তুমি জানো—
তুমি তা দিও না, নাথ, যদি তা অনিষ্ট
বয়ে আনে এ-জগতে, তোমার রশ্মিতে
বরং বিশুদ্ধ করে তাই তুমি দাও,
আছে যাতে সুকল্যাণ, তোমার সন্তুষ্টি
আর যুগ-যুগান্তরে মানবচিত্তের
মহাশুদ্ধি, মুক্তি আর আনন্দআহার।
জগৎ উঠলো কেঁপে। বসন্তবাতাস
তুললো হৃদয়ে দোলা। শত শতাব্দীর
প্রতীক্ষাপ্রহর ভেঙে করে খান খান
নতুন নক্ষত্র এক, ক্ষণিকের জন্যে,
মক্কার আকাশে হলো উদিত হঠাৎ,
বিদ্যুতের মতো দিলো, যার ঝলকানি,
ধাঁধিয়ে দুচোখ সব ঋষি-মণীষীর।
ছুটে গিয়ে সেই রাত্রে জনৈক ইহুদী
মদিনার দুর্গ-শিরে জুড়লো চীৎকার:
'ইহুদিসমাজ, শোনো! ' সুপ্ত লোকজন
ছুটে এলো উর্ধ্বশ্বাসে, 'কী হয়েছে কও।
কী জন্যে গাধার মতো করছো চীৎকার? '
সে বললো, 'পুণ্য রাত্রি আজ; এ-রাত্রিতে
উঠে গেছে আহমদ নামের নক্ষত্র।
খোদার কসম, আমি দেখেছি সচক্ষে
উদিত হতে তা দূর মক্কার আকাশে।
ইহুদীদের দুর্ভাগ্য, তাদের রাজত্ব
হয়ে গেল হস্তচ্যূত আজ হতে; হায়,
তাদের ভিতর থেকে আসবে না আর
নবী কোনোদিন! তাদের নিকট থেকে
নবুয়ত চিরতরে নিলো যে বিদায়! '
বললো সবাই, 'কী বুঝাতে চাও তুমি? '
সে বললো, 'এসে গেছে সর্বশেষ নবি
মানুষের মধ্যে। খোঁজো মক্কা নগরীর
কোনো রমণীর গর্ভে জন্ম নেছে কিনা
কোনো পুত্রশিশু আজ শেষ রজনীতে।'
ইহুদিবণিক এক বললো আক্ষেপে,
'বদ-নসিব আমাদের, যদি সত্য হয়
তোমার একথা। সূর্য ওঠার আগেই
হয়ে যাবো রওনা আমি ব্যবসার কাজে
মক্কার উদ্দেশে। তোমরা নিশ্চিত থাকো
আমি এর সন্ধান নেবোই। যদি এর
একচুলও অন্যথা করি, তবে বলতে পারো
মিথ্যে ছিলো আমার মা, এবং পিতাও।'
লোকেরা বাহবা দিলো তার কথা শুনে।
কুরাইশ-সর্দার আব্দুল মুত্তালিব
উঠলো নিশীথে জেগে ধড়ফড় করে।
শুনলো সে আসমানে কিসের গর্জন,
যার প্রতিধ্বনি তাঁর হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে
আছড়ে পড়তে লাগলো রাতের বাতাসে।
দৌড়ালো সে উদ্ভ্রান্তের মতো সে-শব্দের
পাছপাছ, যেভাবে দৌড়ায় বজ্রধ্বনি
বিজলির পশ্চাতে। থমকে দাঁড়ালো সে
পবিত্র কাবার সম্মুখে। অদ্ভুত কাণ্ড
দেখলো সে নিস্তব্ধ নির্বাক—নড়তেছে
খর্জুরপত্রের মতো রাত্রির বাতাসে
কাবাগৃহ। অন্তরাত্মা উঠলো তাঁর কেঁপে
ভয়ে। রক্ষক সে এ-গৃহের; গোত্রপতি;
মক্কানগরীর সর্বোচ্চ সর্দার; তাঁর
হাতে জগতের শ্রেষ্ঠ উপাসনালয়
কাবার স্বর্ণের চাবি, মূর্খ আবরাহা
যে-ঘর ভাঙতে এসে ধ্বংস হয়ে গেছে,
বিশাল হস্তীবাহিনী তার হয়ে গেছে
নিশ্চিহ্ন, ঝঞ্ঝার মতো ধেয়ে আসা ক্ষুদ্র
আবাবিল পাখির নিক্ষেপ করা তুচ্ছ
নুড়ির আঘাতে; সে-দৃশ্য স্মরণ করে
ভাবতে লাগলো বৃদ্ধ কাবার রক্ষক:
'কার ভয়ে নড়ে আজ খোদার সে-ঘর?
পারেনি ভাঙতে যা রাজাবাদশারা, বিনা
যুদ্ধে কেবলি বাতাসে পড়বে তা ধসে
রাত্রির আঁধারে? ' তাকালো সে কৌতূহলে
কাবার ভিতর; দেখলো সমস্ত মূর্তি—
আল-লাত, আল-উজ্জা, মানাত, হুবাল,
মালাক্বেল, বাল্শামিন, দুশারা, নের্গল,
মানাফ, আতারসামাইন, রুদা, সাদ,
শামস, কুযাহ, আরা, আবগল, নুহা—
পড়েছে উপুড় হয়ে; হতভম্ব হয়ে
তাকালো আরবনেতা ঊধর্বাকাশে: দেখলো,
শুভ্র শিরস্ত্রাণ পরে অজস্র ফেরেস্তা
নিম্ন আসমানে এসে করতেছে পাঠ
খোদার তসবিহ। ভীতসন্ত্রস্ত অন্তরে
ফিরিয়ে আনলো দৃষ্টি মর্ত্যে; দেখলো সে
রুদ্ধবাক, বৃক্ষরাজি কেবলামুখো হয়ে
নুয়ায়ে দিয়েছে শির। দিব্যদৃষ্টি তাঁর
খুলে গেল অচিরাৎ; দেখলো দিব্যচোখে,
পড়েছে উপুড় হয়ে বিশ্বময় যত
মহামূর্তি মন্দিরে মন্দিরে; আর যত
স্বর্ণসিংহাসন দেশে দেশে, অহঙ্কার,
ক্রোধ, রক্তপাত আর মৃত্যু দিয়ে মোড়া।
তাহলে কি এ-রজনী মহাবিপ্লবের
দিতেছে ইঙ্গিত দিকে দিকে? সিরিয়ার
রাজসিংহাসন হয়ে আছে কেবলামুখো,
যেন কেউ পরম বিশ্বাসে পড়ে আছে
শান্তি-সিজদায়। পারস্যের দিকে ফিরে
দেখলো তার শ্বেতপ্রাসাদ কাঁপতেছে থরথর
আর তার মহামূল্য রাজসিংহাসন
পড়েছে হুমড়ি খেয়ে, যেন কার ভয়ে।
রোমসাম্রাজ্যের দিকে ফিরে দেখলো সে
দিব্যচোখে একই দৃশ্য কি-বিস্ময়কর!
যত দ্যাখে. তত বৃদ্ধ আরব-সর্দার
হয়ে যায় হতভম্ব। মহাঘোর এসে
করেছে আচ্ছন্ন তাঁকে; চক্ষু জুড়ে তাঁর
উথলে পড়েছে আলো; বুকে অস্থিরতা;
শরীরে কম্পন। অদৃশ্য আওয়াজ এলো
আসমান থেকে ভেসে, 'ভয় পেয়ো না হে,
কুরাইশ নেতা।' দৃষ্টি তাঁর গেল ছুটে
আমিনার গৃহে। প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র
চলে গেছে পরপার গর্ভবতী স্ত্রীকে
রেখে ধরাধামে। ঘনিয়ে এসেছে তাঁর
প্রসবের কাল। আরব-সর্দার তিনি;
রেখেছেন পাহারায় প্রসিদ্ধ ধাত্রীকে,
সাথে আরো কিছু নারী, রাত্রিদিন, যাতে
সন্তান ও মাতা থাকে নিরাপদে। যেই
চক্ষু তাঁর ছুঁলো গিয়ে আমিনার গৃহ,
দেখতে পেল সে আম্বর মিশ্রিত জলে
ভেসে যাচ্ছে চারদিক আর তীব্র নুরে
জ্বলজ্বল করা তাঁর ঘরের উপর
ও গৃহের চতুর্দিকে অচেনা অসংখ্য
সুদর্শন পাখি করতেছে উড়াউড়ি
ছন্দময়, যেন উড়ছে না, করছে নৃত্য
শূন্যে, যেভাবে সমুদ্রে নাচে ঊর্মিমালা।
দেখে তা, বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল পথে
গোত্রপতি। ফিরে এলো সংজ্ঞা যেই, উঠে
দাঁড়ালো সে এক লাফে, যেন রণাঙ্গনে
ভূপাতিত কোনো বীর। দাঁড়িয়ে, পড়লো
ভীষণ অস্থির হয়ে আরব-সর্দার
পুত্রবধূ আমিনার গৃহ-অভ্যন্তরে
কী ঘটতেছে, দেখতে সচক্ষে। অজানা
আশঙ্কায় কাঁপছে খালি বুক। কাছে গিয়ে
জুড়লো চীৎকার ‘আমিনা! আমিনা! ' বলে:
'তুমি কি জাগ্রত? থাকলে উত্তর দাও।'
ছুটে এসে দাঁড়ালো প্রকাণ্ড নরমূর্তি
এক, পথরুদ্ধ করে; বলে উঠলো সে
জলদগম্ভীর স্বরে, 'প্রবেশ নিষেধ! '
'কে এ নরাধম, কয় প্রবেশ নিষেধ
আরবনেতাকে, যিনি কাবার রক্ষক,
যার নামে পূর্ব ও পশ্চিমে নরনারী
ভক্তিতে নুয়ায় মাথা! সর্বোপরি আমি
আমিনার শ্বশুর; এ গৃহেরও মালিক! '
বলে ওঠে মনে মনে বৃদ্ধ মুত্তালিব।
কিন্তু তার তীক্ষ্ণ অগ্নিকয়লার মতো
চোখে চোখ রাখতেই অন্তরাত্মা তাঁর
হয়ে গেল হিম। চাইলো সে, দৌড়ে গিয়ে
টেনে তোলে নিদ্রা থেকে মক্কার সমস্ত
লোক; অতঃপর জানায় চীৎকার করে
ভয়ঙ্কর এইসব ঘটনার কথা
রুদ্ধশ্বাসে। কিন্তু তাঁর কণ্ঠ অকস্মাৎ
হয়ে গেল স্তব্ধ; গলা দিয়ে কোনো কথা
হলোই না বের; প্রস্তরের পায়ে হেঁটে
অগত্যা কাবার দিকে চললো সে ফিরে।
এদিকে আমিনা গেল ঘুম থেকে উঠে।
প্রসবের ব্যথা বুঝি উঠবে এখনই;
ধাত্রী শিফা, উম্মে আয়মান, উসমান
ইবনে আলআসের মাতা— বিভোর নিদ্রায়
পার্শ্বঘরে। প্রিয় পতি আব্দুল্লাহর মুখ
উঠলো হঠাৎ ভেসে স্মৃতির পর্দায়।
গর্ভে তাঁর পুত্র রেখে আহা-কি করুণ
ঘুমিয়ে আছেন তিনি মদিনার বুকে,
যে-ঘুম কখনো, হায়, ভাঙবে না আর!
জন্মের আগেই তাঁর বংশের বাতি
হয়েছে এতিম! সে-কথা স্মরণ করে
আরব সাগর দিলো বহায়ে দুচোখে।
তখনই শুনতে পেল আসমান হতে
ভেসে আসা প্রচণ্ড আওয়াজ, কি-মধুর—
‘হে নবি-জননী, আহলান সাহলান।'
শুনে কাঁপতে লাগলো বুক। পরক্ষণে
দেখতে পেল একটি অনিন্দ্য সুন্দর পাখি,
কুক্কুটের মতো কায়া, কি-ঘ্রাণ সর্বাঙ্গে,
ঢুকে পড়লো উড়ে এসে ঘরের ভিতর।
অতঃপর শুভ্র তার বেহেস্তি ডানায়
স্পর্শ করলো তাঁর শির। সেই স্পর্শে গেল
কর্পূরের মতো উড়ে মনের সমস্ত
ভয়-ভীতি, আর বয়ে গেল আনন্দের
শিহরণ দেহ-মনে। অপূর্ব পাখিটি
উড়ে গেল একটু পর অনন্ত আকাশে।
সাথে সাথে প্রবেশ করলো এসে এক
দিব্য পুরুষ। মূলত ফেরেস্তা। স্বহস্তে
করালো সে পান মিষ্টি শরবত এক
গ্লাস, দুগ্ধ আকৃতির, যেন বা অমৃত।
তাঁর প্রস্থানের পরপরই আমিনার
প্রশস্ত ললাট হতে বিচ্ছুরিত হয়ে
উঠে গেল জ্যোতি এক, ঊর্ধ্বাকাশে। তার
পরপরই পরমা সুন্দরী তিন নারী
স্বর্গীয় সজ্জায় উপস্থিত হলো এসে।
তাঁরা কারা জানতে চাইলে, আসলো উত্তর:
'বিবি হাজেরা, আসিয়া আর মরিয়ম
আমাদের পরিচয়। স্রষ্টার নির্দেশে
আগমন আমাদের। হে পবিত্র, ধন্যা,
মহিয়সী নারী, পাবেন না ভয়। নারী-
কুলের আপনি অহঙ্কার। জগতের
সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ রয়েছে আপনার
গর্ভে। আপনার পরিচর্যায় আমরা
হয়েছি প্রেরিত।' নেচে উঠলো তনু-মন,
একথা শুনেই, ময়ূরের মতো, তাঁর।
স্রষ্টার প্রশংসাগানে মেতে উঠলো সে
প্রফুল্ল অন্তরে, যেন নাইটিংগেল।
হঠাৎ আসলো ভেসে গায়েবি আওয়াজ:
'শিশুটিকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে
রাখো।' তীব্র সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে
আছড়ে পড়লো এসে পাহাড়ে-পর্বতে,
জমিনে, সমুদ্রে, জীবনের কোলাহলে।
আমিনা 'হে খোদা, রক্ষা করো তাঁকে' বলে
জানালো আরজি স্রষ্টার দরবারে। বিশ্বে
পড়ে গেছে যেন সাজসাজ রব; পুষ্পে
পড়েছে তাবৎ কুসুমকানন নুয়ে;
উতলা বাতাস উথলে উঠেছে গন্ধে;
তারার মিছিলে ডুবে গেছে আসমান;
সমুদ্রে সমুদ্রে উত্তাল জলেরা নীল
ঢেউ তুলে তুলে নাচতে নাচতে আছড়ে পড়ছে
উদাস সৈকতে; মরা মাঠে রাতারাতি
হঠাৎ উঠেছে গর্জে সবুজ শস্যেরা;
ময়ূর পেখম মেলে জুড়ে দেছে নৃত্য
দল বেঁধে গহিন অরণ্যে; হরিণেরা
কি-ফূর্তিতে করতেছে ছুটোছুটি মিষ্টি
জ্যোৎস্নায়! জলদেশে মৎস্যেরা নেচে নেচে
তুলে যাচ্ছে আনন্দের ঢেউ। নেই কেউ
পৃথিবীতে, প্রাণী-তরু-জিন কি ফেরেস্তা, সুখে
ওঠেনি উল্লাস করে। স্বপ্নভেজা চোখে
দেখলো আমিনা পারস্যের সুনির্মিত
রাজপ্রাসাদের দ্বাদশ গম্বুজ গেল
ভেঙে খান খান হয়ে; পড়লো উল্টে যত
রাজাবাদশার তখত-তাউস আলিশান;
ফেরেস্তারা আসমানজুড়ে জুড়ে দেছে
স্রষ্টার প্রশংসাকীর্তন। আনন্দে বুজে
এলো চোখ আমিনার। চক্ষু খুলে ফের
তাকালো সে যেই, দেখতে পেল আরো কিছু
অনিন্দ্য সুন্দরী নারী রূপার তশতরি
হাতে করলো প্রবেশ ঘরে, থরে থরে
সাজানো যা কস্তুরি, আম্বর ও মেশকে;
সুগন্ধে উঠলো মৌ মৌ করে সারা ঘর।
অতঃপর তাঁর গৃহ-'পরে, দেখলো সে,
করতেছে উড়াউড়ি অপূর্ব সুন্দর
কিছু পাখি, যা সে দ্যাখেনি কখনো আগে;
তা দেখেই জুড়ালো অন্তর তাঁর সুখে।
তখনি শুনতে পেল 'মারহাবা! মারহাবা!
আপনার আগমন শুভ হোক! '-ধ্বনি
দিগ্বিদিকে। এ-কি হর্ষোল্লাস! আহা, এ-কি
উন্মাদনা বিশ্বময়! ভূলোক দ্যুলোক
দুলছে উল্লাসে, যেন মহাপেন্ডুলাম।
নাচছে সপ্ত আসমান, খোদার আরশ
প্রচণ্ড পুলকে। এসে গেছে মহাশিশু,
আমিনার নয়নপুত্তলি ধরাধামে!
বাজাও আনন্দ-ভেরি; হাঁকো হায়দরি
হাঁক; নাচো ফণা তুলে যেন শঙ্খ-চূড়;
গাও কণ্ঠ ছেড়ে যেন বসন্তের পিক—
'মারহাবা! মারহাবা! আপনার আগমন
শুভ হোক।' দেখলো আমিনা রুদ্ধবাক,
বাতিহীন তাঁর গৃহ জ্যোতির্ময় করে
পূর্ণিমার চাঁদ যেন আসমান ছেড়ে
নেমে এলো মৃত্তিকায়। মাতা মরিয়ম,
হাজেরা, আসিয়া তুলে দিলো একসাথে
জগতের শ্রেষ্ঠ ধন, মরুর ভাস্কর,
মানুষের মুক্তিদাতা, গরিবের বন্ধু,
বিশ্বের সম্রাট, শিশিরের মতো পুণ্য
নয়নজুড়ানো স্বর্ণশিশু তাঁর কোলে।
তাঁর মুখপানে চেয়ে খুশিতে আমিনা
ছেড়ে দিলো অশ্রুজল এই বলে: 'বাছা,
এসেছো এতিম হয়ে আকাশের চাঁদ;
হারিয়েছো পিতা তুমি জন্মের আগেই,
যে-ছিলো আরবদেশে সবচেয়ে সুন্দর
বলিষ্ঠ পুরুষ, পড়েছিল যাঁর প্রেমে
আরবের যত নারী; কিন্তু ছিলো তাঁর
উত্তম চরিত্র; ছিলো সে লাজুক, ধর্ম-
পরায়ণ আর সৎকর্মশীল; তাঁকে
বাসতো না ভালো, ছিলো না এমন কেউ
মানবমুলুকে। আমি তাঁর ঘরে এলে
মূর্ছা গিয়েছিল শোকে সব সুন্দরীরা;
জগতে আমার চেয়ে কেবা ছিলো সুখী!
বারো মাসই ছিলো বসন্ত আমার ঘরে;
ভাবতে কে পেরেছিল কবে, জলজ্যান্ত
এমন মানুষ আচমকা বিধবা করে
চলে যাবে এইভাবে! হায়, আব্দুল্লাহ,
প্রাণের পতি হে, দেখে যাও, কে এসেছে
আমাদের ঘরে, কী রত্ন আমাকে তুমি
করে গেছো দান! দেখে যাও সশরীরে।'
পতি হারানোর ব্যথা একদিকে; আর
একদিকে সন্তান পাওয়ার সুখ; ব্যথা
আর সুখ জ্বলজ্বল করতে লাগলো
মুক্তার দানার মতো তাঁর সিক্ত চোখে।
চতুর্দিকে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি সিম্ফনির
মতো বাজতে লাগলো--'হে নবি, সালাম
আলাইকা! ' রুদ্ধবাক আমিনা তা শোনে
আর পরম বিস্ময়ে চেয়ে থাকে এক-
দৃষ্টে আশ্চর্য শিশুর পবিত্র আননে।
চোখের জ্যোতিতে তাঁর হয়ে গেছে সারা-
ঘর উদ্ভাসিত, ছোট্ট সুঁই হারালেও
পাওয়া বুঝি যাবে খুঁজে! সে-ঔজ্জ্বল্যে স্পষ্ট
দেখা যেতে লাগলো সিরিয়ামুলুক। তাই
দেখে বিস্ময়াভিভূত মাতা আওড়ায়
মনে মনে: ‘এ-কি রত্ন, এ-কি মণিহার,
এ-কি অমূল্য বৈভব বিধবার ঘরে
পাঠালে, হে প্রভু! হে পরওয়ার দেগার,
যা দিয়েছো, বইবার শক্তি তুমি দাও;
দাও এ-শিশুর নিরাপত্তা অষ্টযাম
নিজ হাতে ডানে-বামে, পূর্বে ও পশ্চিমে,
জমিনে-আকাশে, নির্জনে ও কোলাহলে।
তুমিই তো শ্রেষ্ঠ রক্ষক, তুমিই দাতা;
তোমার হুকুম ছাড়া নড়ে না পল্লব
ডালে, বয় না বাতাস, ওঠে না আকাশে
সূর্য; তুমিই আমার একান্ত আশ্রয়।'
হঠাৎ আকাশ হতে একখণ্ড মেঘ
দুগ্ধশুভ্র, নেমে এলো বিদ্যুতের বেগে;
আমিনার কোল হতে তুলে নিয়ে সেই
মেঘ হৃৎপিণ্ড তাঁর, গেল উড়ে দূর
সুনীল আকাশে; যে-দিকেই যায়, ছোটে
পাছ পাছ মাতৃ-হৃদয়। ঘোষিত হলো
অকস্মাৎ ঊর্ধ্বাকাশে জলদগম্ভীর
স্বরে: ‘নিয়ে যাও একে পূর্ব ও পশ্চিমে;
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাও সমস্ত দেশ,
উদ্ভাসিত হয় যাতে বৈশ্বিক আলোয়
অন্তরাত্মা তাঁর।' বিশ্বচরাচর ঘুরে
শুভ্র সেই মেঘ ফিরে এলো উৎকুণ্ঠিতা
আমিনার কাছে, যেন সহস্র বছর
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে কেটে গেছে তাঁর, যেন
হারিয়ে জীবন বেঁচে উঠেছে সে ফের
অলৌকিকভাবে। তখনই তিনটি লোক,
যেন তিনটি সূর্য একসাথে, ঢুকে পড়লো
তাঁর ঘরে। পানিভর্তি স্বর্ণের গামলা
ধরে ছিলো একজন হাতে, একজন
রেশমি কাপড়ে মোড়া রহস্যের আংটি
আর একজন পশমী কাপড়। তাঁর
কোল থেকে তুলে নিয়ে সুকান্ত শিশুকে
করালো গোসল সেই পবিত্র পানিতে
প্রথম লোকটি। তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি
আংটিটি খুলে চেপে ধরলো শিশুটির
দু-স্কন্ধের মাঝখানে; এঁকে দিলো চিহ্ন
নবুয়তের। অতঃপর তৃতীয় ব্যক্তিটি
আচ্ছাদিত করে তাঁকে পশমী কাপড়ে
তুলে দিলো ফের আমিনার কোলে; দিয়ে,
পবিত্র জবান তাঁর রাখলো শিশুর
কর্ণ-'পর; অতঃপর বললো অস্ফুট-
স্বরে, 'ওহে আল্লাহর রসুল! মহানবী!
কতই না ভাগ্যবান আপনি, গায়েবের
এমনই এলেম দেওয়া হলো আপনাকে,
দেওয়া হয়নি কাউকে যা ইতোপূর্বে।
আর সুসংবাদ নিন, যারা আপনাকে
মেনে নেবে নবি বলে, ঈমান আনবে
আপনার উপর, কেবল তারাই হবে
আপনার উম্মত; হবে তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত
আর বেঁচে যাবে দোজখের অগ্নি থেকে।'
বৃদ্ধ মুত্তালিব বসে ছিলো কাবাগৃহে
রুদ্ধবাক। রাত্রির ঘটনা বারবার
ঘুরপাক খাচ্ছিল মস্তিষ্কে। অকস্মাৎ
ছুটে এলো একদল লোক উর্ধ্বশ্বাসে;
বললো, 'সর্দার, সুসংবাদ নিন! খুবই
খুশির খবর! আপনার পুত্রবধূ
প্রসব করেছে এক রাজপুত্র; চন্দ্র-
সূর্য নিভে গেছে তাঁর রূপে।' শুনে দৌড়ে
গেল গোত্রপতি আমিনার ঘরে। তুলে
নিয়ে কোলে তাঁর প্রাণের পৌত্রকে, ছেড়ে
দিলো অশ্রুজল আর বলতে লাগলো
উচ্চকণ্ঠে, 'হে আরববাসী, দেখে যাও
মৃত আব্দুল্লাহ ফিরে এসেছে মক্কায়।
দ্যাখো, কি সুবর্ণ সূর্য উঠেছে আকাশে!
এমন সুখের দিন আসেনি কখনো
পৃথিবীতে আর। যাও, যেখানে যে আছে,
ডেকে আনো কাবাগৃহে।' এই বলে নেতা
ছুটলো কাবার দিকে। কাবার চাদরে
ঢেকে ফেলে যেন চাঁদ, স্রষ্টার দরবারে
করলো সে ফরিয়াদ, 'এতিম শিশুকে
নিজ জিম্মায়, হে সর্বশক্তিমান, রক্ষা
কোরো তুমি। রেখো একে তোমার নজরে।
সমস্ত অশুভ থেকে, অকল্যাণ থেকে
হেফাজত করে, এ-শিশুকে কোরো তুমি
তোমার গোলাম, তোমার গৃহের দাস
আর মানুষের মুক্তিদাতা।' সকলেই
'আমিন! আমিন! ' বলে উঠলো সমস্বরে।
বললো গোত্রপতি, 'আগামী সপ্তম দিনে
দেয়া হবে আকিকা পৌত্রের। আমন্ত্রিত
সকলে।' তখনি ছুটে এলো ঊর্ধ্বশ্বাসে
জনৈক ইহুদী। সে বললো, 'শিশুটিকে
একটিবার দেখতে দাও আমাকে হে।' যেই
দেখলো চেয়ে চাঁদের চেয়েও দীপ্ত তাঁর
মুখখানি একনজর, জ্ঞান হারিয়ে সে
পড়ে গেল কাবাগৃহে। ত্রস্ত মুত্তালিব
তড়িঘড়ি প্রাণের পৌত্রকে বুকে নিয়ে
ফিরে গেল আমিনার গৃহে। লোকজন
ঘিরে রেখেছিল ইহুদীকে। ফিরে এলে
সংজ্ঞা, উঠলো সে বলে, 'কুরাইশগণ!
খোদার কসম, জেনে রাখো, এই শিশু
বিশ্ব জয় করে নেবে একদিন। তাঁর
সে-বিজয় ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর
প্রান্তে প্রান্তে দাবানলের মতো। আফসোস,
মহাভাগ্যবান বনী ইসরাইলগণ
হারিয়ে ফেললো নবুয়ত চিরতরে! '
অতঃপর জানতে চাইলে সে শিশুটির
মাতৃ-পিতৃপরিচয়, লোকেরা করলো
অস্বীকার বলতে, বরং তারা তাকে
ইহুদীর চর বলে গালমন্দ করে
করলো বিদায়; অতঃপর দৌড়ে গিয়ে
সব কথা জানালো আরব-সর্দারকে।
মা-আমিনা ভয়ে জুড়ে দিলে আর্তনাদ,
হুঙ্কার ছাড়লো মুত্তালিব ব্যাঘ্রকণ্ঠে:
'লাত ও উজ্জার কসম, আমার প্রিয়
পৌত্রের উপর কেউ বদ-দৃষ্টি দিলে,
আমরা তার উপড়ে ফেলবো চোখ। কুরাইশরা
ভীরু-কাপুরুষ নয়। তাদের নারী ও
শিশুদের নিরাপত্তা দিতে প্রয়োজনে
অস্ত্র ধরবে তারা।' উপস্থিত লোকজন
বলে উঠলো সমস্বরে, 'আমরা প্রস্তুত।'
আমিনার ক্রন্দন থামলো সব শুনে।
প্রথা অনুযায়ী ঠিক সপ্তম দিনেই
আড়ম্বর অনুষ্ঠান করে দেয়া হলো
আকিকা পৌত্রের। কুরাইশ-সর্দার দাদা
মুত্তালিবের আমন্ত্রণে সহস্র মানুষ
যোগ দিলো ভোজ-উৎসবে। অতিথিরা
তৃপ্তিসহকারে খেলো আর প্রশংসায়
ভরে তুললো মক্কার বাতাস। অতঃপর
জানতে চাইলো তারা, 'ওহে প্রিয় নেতা,
কী নাম পৌত্রের রাখলেন অবশেষে? '
বৃদ্ধ মুত্তালিব বলে উঠলো দীপ্ত কণ্ঠে,
'মহম্মদ।' 'মহম্মদ! কি-নতুন নাম!
আমরা শুনিনি আগে।' 'হ্যাঁ, নতুন বটে।
মহম্মদ মানে প্রশংসিত। আমি চাই
আমার এ-পৌত্র যেন প্রশংসিত হয়
সর্বদা সবখানে। আকাশ ও জমিনের
সকলেই যেন থাকে মুখর সতত
আমার নাতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসায়।'
'আমিন! আমিন! ' বলে উঠলো সকলে।
এদিকে স্বপ্নের মধ্যে শুনলো আমিনা
কেউ যেন বলছে তাঁকে, 'হে নবির মাতা,
রাখো এ-শিশুর নাম ‘আহমদ', যাতে
সর্বোচ্চ প্রশংসাকারী হয় সে স্রষ্টার।'
আমিনা রাখলো নাম ‘আহমদ', দাদা
মুত্তালিব ‘মহম্মদ'। ‘মহম্মদ' হলো
প্রশংসিত; ‘আহমদ' প্রশংসাকারী।
এভাবেই দোলনায় শুয়ে দুই নামে
হয়ে উঠলো পরিচিত জামানার নবী,
আব্দুল্লাহর পুত্র, আমিনার চক্ষুমণি,
আরবের মহাঅন্ধকারে নিমজ্জিত
মানুষের মুক্তিদাতা, বিশ্বের সম্রাট,
জন্ম যাঁর বারো রবিউল আউয়াল,
রোজ সোমবার, পাঁচ শ সত্তর সালে।
-----
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem