নবিনামা
সায়ীদ আবুবকর
★★★ ★★★
সপ্তম সর্গ
*** *** ***
দুঃখের উপর দুঃখ
*** *** ***
হঠাৎ নামলো রাত মক্কার আকাশে;
চাঁদ-তারাহীন ধু-ধু অন্ধকার হাসে
আর শুধু মানুষকে করে উপহাস।
একদল অমানুষ কেড়ে নেয় গ্রাস
মানুষের মুখ থেকে। একদল খায়,
আর-একদল মরে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায়!
কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ দিয়ে কুরাইশগণ
চাইলো ছিনিয়ে নিতে নবির জীবন।
নবির স্বজন যাঁরা আর অনুসারী,
তাঁদের ক্রন্দনে হলো মরু-বায়ু ভারী!
কাঁদে শিশু, কাঁদে বৃদ্ধ, কাঁদে নারী-নর;
আবু জেহেলের তবু গলে না অন্তর।
কেমন পাষাণ হলে, নিতে প্রতিশোধ
করা যায় ক্ষুধা-তৃষ্ণা দিয়ে অবরোধ!
মার স্তনে দুধ নেই, শীর্ণ শিশু কাঁদে;
জীবন যে পড়ে গেছে নরকের খাদে!
পুরুষরা ছুটে যায় খাদ্যের সন্ধানে;
খাদ্য নয়, সাথে শুধু হতাশাই আনে।
পাষাণ মরুতে কোনো নেই খাদ্যকণা;
যেন শুধু কালসাপ তুলে আছে ফণা
চারদিকে, করতেছে খালি ফোঁস ফোঁস;
ভয়েতে কলজে কাঁপে, বাঁচার সাহস
হারায় বিপন্ন প্রাণ। এত ভয়াবহ
ক্ষুধার যন্ত্রণা, হায়! যখন দুঃসহ
হয়ে ওঠে বেঁচে থাকা খাদ্যের অভাবে,
অসহায় লোকজন কী বা আর খাবে,
শুরু করে খেতে তারা কাঁটাযুক্ত পাতা
খেজুরবৃক্ষের; শুষ্ক চামড়াও খায়,
খায় ঘাস—এরকম হাবিজাবি, যা-তা,
খেয়ে খেয়ে লোকগুলো জীবন বাঁচায়।
আকাশে দু-হাত তুলে মহম্মদ কাঁদে।
শিশুদের আর্তনাদ, নারীর বিষাদে,
সাথীদের দুর্দশায় দুঃখে বুক ভরা।
অভিশপ্ত এইসব ঘৃণ্য পাষণ্ডরা
আর কত নিষ্ঠুরতা দেখাবে দুর্বলে?
ভাসবে মানুষ আর কত অশ্রুজলে,
হাসবে পশুর দল, করবে উল্লাস?
মানুষের 'পরে আর কত কাফেরের
চলবে রাজত্ব, যাবে সৃষ্টি করে ত্রাস
মানবমুলুকে? প্রভু! নেই কি গো এর
প্রতিকার কোনো? নেই মিথ্যার বিনাশ?
সুদিন ফিরবে কবে বনু হাশিমের?
এইভাবে কেঁদে কেঁদে করে ফরিয়াদ;
সাক্ষী তার হয়ে থাকে নিশীথের চাঁদ।
তিনটি বছর গেল কেটে এইভাবে
নিগড় নিগ্রহে। জেগে জেগে কাটে রাত
আবু তালিবের, পিতৃহীন ভাতিজার
নিত্য-পাহারায়। জানে সে, শত্রুরা তাঁর
ওঁত পেতে আছে সর্বক্ষণ, কেড়ে নিতে
তাঁর প্রাণ। তাই সে শোওয়ায় তাঁকে পাশে।
রাতে কতবার অদল-বদল করে
তাঁর শয্যা, যাতে না শত্রুরা পায় খুঁজে
ঘুমন্ত মহম্মদকে। এ-বৃদ্ধের বুকে
ভাতিজার জন্যে, আহা, এত ভালবাসা,
সমুদ্রেও বুঝি এত থাকে না সলিল!
হননি দীক্ষিত তাঁর ধর্মে; তাঁর জন্যে
তবু সমস্ত গোত্রকে নিয়ে করছেন
অবস্থান গিরি-সংকটে। এদিকে ক্ষুব্ধ
হয়ে উঠতে লাগলো আবু জেহেলের
বিরোধীরা দিন দিন মক্কাতে। তাদের
মানবিক সত্তা উঠলো বিদ্রোহ করে
বনু হাশিমের ভয়াবহ দুর্দশায়।
তারা তো তাদেরই লোক, আত্মীয়-স্বজন
তাদের, তাদেরই প্রতিবেশী! তবে কেন
দুষ্ট আবু জেহেলের ফাঁদে পড়ে তারা
মেনে নিতে গেল তারই তৈরি করা এই
জঘন্য প্রতিজ্ঞানামা? খাদ্যের অভাবে
বনু হাশিমরা যেন জীবন্ত কংকাল
হয়ে ঘোরে পথে-ঘাটে; আবুল হাকাম
দেখে হাসে। করুণ এ-দৃশ্য কত আর
দেখা যায় দুই চোখে? আমির ইবনে
লুই গোত্রের হিশাম ইবনে আমির
ছুটে গেল একদিন যুহাইর বিন
আবু উমাইয়া মাখযুমীর নিকট।
যুহাইরের মা আতেকা ছিলেন আবু
তালিবের ভগ্নী, আব্দুল মুত্তালিবের
কন্যা। হিশাম বললো, 'ওহে যুহাইর!
এটা কী রকম, আমরা উদর পুরে
তৃপ্তিসহকারে খাওয়াদাওয়া করছি,
উত্তম পোশাক পরিধান করছি, আর
বনু হাশিমরা খাদ্যাভাবে, বস্ত্রাভাবে,
অর্থাভাবে জীবন্মৃত অবস্থায় দিন
যাপন করছে? চলছে যে-দুরবস্থা
তোমার মামার বংশে, তা তো তুমি জানো! '
হিশামের কথা শুনে উঠলো ক্রন্দন
করে যুহাইর। সে বললো, 'সে তো ঠিক।
কিন্তু এ-ব্যাপারে একা আমি কী করতে
পারি কও? থাকতো আমার সঙ্গে যদি
আরো কেউ, এই একরারনামা আমি
ফেলতাম ছিঁড়ে।' বলে উঠলো হিশাম,
'তাহলে তোমার সঙ্গে থাকছি আমিই।'
যুহাইর বললো, 'বেশ। তাহলে এখন
খুঁজে বের করো তৃতীয় ব্যক্তিকে।' শুনে
ছুটলো হিশাম মুতইম বিন আদির
কাছে। সে বললো, 'হে মুতইম! তুমি তো
বনু হাশিমের দুর্দশার কথা জানো।
তাদের আত্মীয় হওয়া সত্তেও তুমি
কী করে এখনো চুপ করে আছো? কেন
বলছো না কথা এই চুক্তিপত্র নিয়ে,
দিয়েছে যা তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে? '
সে বললো, 'হে হিশাম! কিন্তু আমি একা
কী করতে পারি? ' হিশাম বললো, 'শোনো.
আরো একজন আছে।' সে বললো, 'কে সে? '
হিশাম বললো, 'যুহাইর বিন আবু
উমাইয়া মাখযুমী।' সে বললো, 'বেশ।
এখন সন্ধান করো চতুর্থ ব্যক্তিকে।'
ছুটলো হিশাম আবুল বোখতার বিন
হিশামের কাছে। তাকেও বললো গিয়ে
একই কথা। সে বললো, 'কোনো সমর্থক
আছে আর এ-ব্যাপারে? ' হিশাম বললো,
'আছে।' সে বললো, 'কে সে? ' হিশাম বললো,
'মুতইম বিন আদি, যুহাইর বিন
আবু উমাইয়া মাখযুমী আর আমি।'
সে বললো, 'বেশ। তাহলে এখন তুমি
খুঁজে বের করো পঞ্চম ব্যক্তিকে।' শুনে
ছুটলো হিশাম যামআ বিন আসওয়াদ
বিন মুত্তালিব বিন আসাদের কাছে।
তাকেও বললো সেই কথা, আর সেও
হয়ে গেল রাজী। তারপর একত্রিত
হলো তারা হাজুনের নিকট এবং
অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো কাবায় ঝুলানো
একরারনামা ছিঁড়ে ফেলার ব্যাপারে।
যুহাইর বললো, 'এ-ব্যাপারে প্রথমে
আমিই খুলবো মুখ।' পূর্ব-কথামতো
সকালে হাজির হলো তারা কাবাগৃহে।
যুহাইর সমস্ত শরীরে তাঁর সাদা
কাপড় জড়িয়ে বায়তুল্লাহ প্রদক্ষিণ
করলো সাতবার। তারপর সমবেত
লোকদের সম্বোধন করে সে বললো,
'ওহে মক্কাবাসীগণ! আমরা উদর
পূর্তি করে তৃপ্তিসহকারে খাওয়াদাওয়া
করবো, উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ পরে
ঘোরাফেরা করবো আর বনু হাশিমরা
ধ্বংস হয়ে যাবে। হয়েছে নিষিদ্ধ করা
সব ধরনের কেনাবেচা, লেনদেন
এবং ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের সাথে।
আল্লাহর কসম! সে-পর্যন্ত আমি বসে
থাকতে পারি না, যে-পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলা
না হচ্ছে অন্যায়-উৎপীড়নমূলক
এই অঙ্গীকারপত্র কাবাগৃহ থেকে।'
উঠলো চীৎকার করে আবুল হাকাম,
'হে যুহাইর! বলছো ভুল কথা তুমি।
উজ্জার শপথ! কিছুতেই দেবো না তা
হতে।' বললো যামআ বিন আসওয়াদ,
'আল্লাহর কসম! তুমিই বলছো ভুল।
কিসের এ-অঙ্গীকারপত্র? যে-সময়
এটা লেখা হয়েছিল, আমাদের কোনো
ছিলো না সম্মতি! এটা নিয়ে সন্তুষ্টও
ছিলাম না আমরা।' বলে উঠলো আবুল
বোখতারী, 'তুমি ঠিকই বলেছো, যামআ।
ছিলো না সম্মতি আমাদের এই চুক্তি-
পত্রের ব্যাপারে। আর এখন তা মান্য
করতে আমরা বাধ্য নই।' মুতইম
বিন আদি বললো, 'তোমরা ন্যায়ানুগ
কথাই বলেছো। এর বিপরীতে যারা
কথাবার্তা বলে, তারাই বলছে ভুল।
আমরা ঘৃণ্য এ-প্রতিজ্ঞাপত্রের প্রতি
অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছি।' সাথে সাথে
বলে উঠলো হিশাম ইবনে আমির,
'কুরাইশগণ! এরাই তো ঠিক কথা
বলছে। আমরা পক্ষপাতদুষ্ট এই
অঙ্গীকারপত্রটির প্রতি অসন্তুটি
প্রকাশ করছি।' ধূর্ত আবুল হাকাম
বলে উঠলো, 'বুঝেছি! বুঝেছি! গত রাতে
সাজানো হয়েছ্ এটা গোপনে কোথাও
কথাবার্তা বলে। ' তখনি হঠাৎ গেল
আবু তালিবের কণ্ঠ শোনা। সে বললো,
'কুরাইশগণ! আমার ভ্রাতুষ্পুত্রের
কাছে বার্তা এসেছে, অঙ্গীকারপত্রের
সমস্ত লেখাই কীটেরা ফেলেছে খেয়ে।
একমাত্র আল্লাহর নাম ছাড়া কোনো
শব্দই সেখানে নেই অবশিষ্ট। যদি
প্রমাণিত হয় মিথ্যে তাঁর কথা, তবে
কথা দিচ্ছি, তোমাদের মাঝখান থেকে
সরেই দাঁড়াবো আমি। তখন তোমরা
যা ইচ্ছা করবে তাই। কিন্তু তাঁর কথা
যদি সত্য হয়, তাহলে তোমরা দীর্ঘ
অবরোধ সৃষ্টি করে আমাদের প্রতি
যেসব অন্যায় করে আসছো, তা হতে
বিরত থাকতে হবে।' কুরাইশগণ
বললো, 'হে নেতা! অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত
কথাই বলেছেন আপনি। আপনার
কথার সত্যতা দেখবো আমরা।' ক্রুদ্ধ
আবুল হাকাম অবতীর্ণ হয়ে গেল
লোকদের সাথে বাকযুদ্ধে। তারা বলে
উঠলো, 'আমরা অবশ্যই দেখতে চাই
সে যা বলছে তা সত্য কিনা।' একজন
ছুটে গিয়ে সেই অঙ্গীকারপত্রখানা
নামিয়ে আনলো কাবার দেয়াল থেকে।
সত্যিই তো, কোনো লেখা অবশিষ্ট নেই
আল্লাহর নাম ছাড়া, কীটেরা ফেলেছে
সব খেয়ে! সেটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো
করে উত্তেজিত লোকজন মারলো ছুঁড়ে
আবু জেহেলের মুখের উপর। রাগে-
অপমানে গজ গজ করতে করতে
দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চললো ক্ষুব্ধ
আবুল হাকাম নিজের বাড়ির দিকে।
মুক্তির আনন্দে ফিরতে লাগলো নিজ
নিজ গৃহে সব, ছিলো যাঁরা এতদিন
বন্দী গিরি-সংকটে। কুরাইশদের
যারা তাদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে ছিলো
উৎসাহী, তারা এসে জানাতে লাগলো
স্বাগত; এবং যারা ঘোর দুশমন,
আগের মতোই ফেরালো তাদের মুখ
আপন গহ্বরে। শত্রুদের শত ক্রোধ,
শত বাঁধা-বিপত্তি সত্তেও দিকে দিকে
ছড়িয়ে পড়েছে ইসলাম। দিন দিন
এ-সত্য সর্বত্র উঠতেছে ফুলেফেঁপে,
যেন ক্রমবর্ধমান জালি লাউ; কিংবা
এ যেন এমন এক জলোচ্ছ্বাস, যত
বেশি তুলে দেওয়া হয় বাঁধ তার আগে,
তত বেশি ভয়াবহ হয়ে সে ডোবায়
অরণ্য-নগর-গ্রাম। কত বীর, কত
জ্ঞানী, কত বিত্তবান—হামজা, ওমর,
উসমান—ইতোমধ্যে হয়েছে দীক্ষিত
এই সত্যে! মহম্মদ এখন একটা
শক্তি; ফুঁ দিয়ে যাবে না উড়িয়ে দেওয়া।
এদিকে আবু তালিব বার্ধক্যের ভারে
জবুথবু। ভাবতে লাগলো কুরাইশ-
নেতৃবৃন্দ, এরকম অবস্থায় যদি
আবু তালিবের মৃত্যু হয়ে যায় আর
তারপর যদি হত্যা করে ফ্যালে তারা
তাঁর ভাতিজাকে, লোকেরা বলবে, 'হায়,
তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে তো দিয়েছিল
তারা ছেড়ে, আর এখন যখন হয়ে
গেল আবু তালিবের মৃত্যু, সে-সময়ই
তাঁকে ধরে হত্যা করে ফেললো তারা।' দিতে
থাকবে ধিক্কার লোকজন এইভাবে।
তাই তারা আবু তালিবের কাছে গিয়ে
বললো, 'হে আমাদের নেতা! আমাদের
মধ্যে মান-মর্যাদার যে-উচ্চ আসনে
আপনি অধিষ্ঠিত, সে-সম্বন্ধে আপনার
জানা আছে, আর আপনার বর্তমান
অবস্থাও আপনার জানা। আমাদের
ভয় হচ্ছে, জীবনের অন্তিম পর্যায়ে
গেছেন আপনি পৌঁছে। যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত
ও মতদ্বৈততা দীর্ঘ দিন ধরে চলে
আসছে আমাদের ও আপনার প্রিয়
ভাতিজার মধ্যে, সে-সম্বন্ধে তো আপনি
জানেন। আমরা চাচ্ছি, তাঁর কাছ থেকে
আপনি একটা অঙ্গীকার নিয়ে নিন।
সে-অঙ্গীকার তাঁর ও আমাদের মধ্যে।
সেটি এরকম—সে কখনো আমাদের
ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করবে না,
আমরাও তাঁর ধর্মের উপর কোনো
হস্তক্ষেপ করবো না।' ভাতিজাকে ডেকে
বললো আবু তালিব, 'মহম্মদ! এঁরা
তোমার জাতির সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ।
তোমার জন্যই তাঁরা এসেছে এখানে।
তাঁরা চাচ্ছে, তুমি একটা অঙ্গীকার করো,
তোমার আনীত ধর্ম নিয়ে এঁরা কোনো
প্রকার কটাক্ষ করবে না, অনুরূপ
তুমিও এঁদের ধর্ম নিয়ে করবে না
কটাক্ষ।' মহম্মদ বললো, 'হে পিতৃব্য!
এমন কথার প্রতি কেন তাদেরকে
আহ্বান জানাচ্ছেন না, যে-কথা তাদের
জন্য বড়ই কল্যাণকর? ' সে বললো,
'কোন্ কথার উপর বলছো আমাকে
আহ্বান জানাতে, হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র? '
মহম্মদ বললো, 'এমন এক কথার
প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি আমি, মেনে নিলে
গোটা আরব তাদের অধীনস্থ হয়ে
যাবে আর অনারব যারা, একদিন
তাদের উপরও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে
তাদের রাজত্ব।' তাঁর এই কথা শুনে
হতভম্ব হয়ে গেল কুরাইশগণ।
নেমে এলো বুদ্ধি তাদের হাঁটুতে। তারা
চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো একে-
অপরের মুখ। লোভে চোখের কোটর
থেকে বের হয়ে আসতে চাইলো চোখ,
যেভাবে বিয়ের ভোজ-উৎসবে খেতে
বসা মেহমানদের পাতে ঢেলে দেওয়া
মাংসের রসালো হাড় দূর থেকে দেখে
ক্ষুধার্ত কুত্তার চোখ ফেটে যেতে থাকে।
কৌতূহলী হয়ে ওঠে আবুল হাকাম।
সে বললো, 'আচ্ছা, বলো তো সে কথাটি কী?
তোমার পিতার কসম! কথাটি যদি
সত্য হয়, তাহলে একটা কেন, রাজী
আছি আমরা দশটা কথাও মানতে।'
মহম্মদ বললো, 'তাহলে আপনারা
বলুন—আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নেই,
এবং আল্লাহ ছাড়া যার উপাসনা
করেন, তা বর্জন করুন।' তারা শুনে
হাতে হাত মারতে মারতে আর তালি
দিতে দিতে বলতে লাগলো, 'মহম্মদ!
তুমি এটাই চাচ্ছো যে, আমরা সমস্ত
আল্লাহর জায়গায় শুধুমাত্র এক
আল্লাহকে মেনে নেই। তোমার ব্যাপার
সত্যিই ভীষণ আশ্চর্যজনক।' তারা
উন্মাদের মতো লাফাতে লাফাতে চলে
গেল একথা বলতে বলতে, 'সমস্ত
আল্লাহর শপথ! এ-ব্যক্তি তো তোমাদের
একটা কথাও মানতে প্রস্তুত নয়!
চলো আমরা অটল থাকি আমাদের
বাপদাদাদের ধর্মে এবং অপেক্ষা
করতে থাকি, যে-পর্যন্ত না তাঁর আর
আমাদের মধ্যে কোনো ফয়সালা হচ্ছে।'
কুরাইশগণ নতুন নতুন ফাঁদ
পাততে লাগলো ভেবে ভেবে। তীব্র ঘৃণা
আর মরণ কামড় ছাড়া কিছু নেই
দেওয়ার তাদের। মহম্মদ আর তাঁর
অনুসারীদের যেখানেই তারা পায়,
করতে লাগলো অপদস্ত। মারপিট
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-শাসানি জুটতে লাগলো
অহরহ তাঁদের অদৃষ্টে। মুখ বুজে
তারা সয়, নিশীথে জানায় ফরিয়াদ
হাত তুলে আসমানে, আর গোনে দিন
বারুদের মতো জ্বলে উঠবার। ‘হায়,
ভালবেসে যদি এত সুখ, কেন এত
নিপীড়ন বিনিময়ে? তোমাকে পাওয়ার
জন্যে হে সুন্দর, কন্টকে কন্টকে যদি
রুধিরাক্ত হয় সারা হাত, তাই হোক!
হে গোলাপ, তোমার সুন্দর মুখখানা
দেখে দেখেই তো সয়ে যেতে পারি সব
কন্টকের খোঁচা, বিষজ্বালা, শোকতাপ! '
আল্লাহ-প্রেমিকদের নিরব ক্রন্দনে
ভিজে যায় এইভাবে রাতের বাতাস।
এক দুঃখ সারে; তৎক্ষণাৎ আরেক
দুঃখ এসে করে ফ্যালে শয্যাশায়ী—এই
কালচক্রে ঘুরছে জীবন অবিরাম।
তবু সে এমন হিমালয়, যার শির
জানে না আনত হতে, আকাশের দিকে
চেয়ে থাকে অনিবার। দুঃখ দিয়েই তো
শুরু হয়েছিল এ-জীবন! পিতৃহারা,
জন্মের পূর্বেই। পিতার শীতল স্নেহে
অবগাহনের হয়নি সুযোগ তাঁর।
মাতাকে হারালো, যখন বয়স ছয়।
অষ্টম বছরে হারালো সে পিতামহ।
জুটলো আশ্রয় আবু তালিবের গৃহে।
পিতার অধিক ভালবাসা-স্নেহ দিয়ে
পিতৃব্য যে তাঁর ভুলালো সমস্ত শোক;
আগলে রাখলো তাঁর হৃদয়ের ওমে,
যেভাবে মুরগি চিলের ছোবল থেকে
বাঁচায় বাচ্চাকে। যখন বিপক্ষে গেল
সমস্ত আরব, দাঁড়ালো সে পাশে এসে
দুর্লঙ্ঘ দুর্গের মতো; বক্ষ পেতে দিয়ে
ঠেকালো সে শত্রুর বল্লম। সেই চাচা
মহর্ষি আবু তালিব পুনরায় তাঁকে
অনন্ত এতিম করে বুজলো দুচোখ
চিরতরে। ‘হায়, চাচা! দেখিনি পিতাকে;
কিন্তু আমি জানি না তো, আল্লাহর জমিনে
কোন্ পিতা আছে, এরকম ভালবাসে,
সমস্ত সম্বল দিয়ে যেভাবে আপনি
ভালবেসে গেছেন এতিম ভাতিজাকে।
হাশরের ময়দানে, ভয়ঙ্কর সেই
বিচারের দিনে, আপনার জন্য আমি
সুপারিশ করতেই থাকবো, যতক্ষণ
পর্যন্ত না বাধাপ্রাপ্ত হবো আমি। শুধু
একবার কেন গেলেন না বলে মুখে—
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ', বংশ-গৌরবের
মিথ্যে ভয়ে? ' পিতৃব্যের নির্বাক সমাধি
ভেজাতে লাগলো মহম্মদ এইভাবে
চোখের পানিতে আর নিরব ক্রন্দনে।
গিরি-সংকটের অন্তরীণাবস্থা শেষ
হওয়ার ছয় মাস পর মারা যায়
আবু তালিব। এবং দুই মাস পর
খাদিজাও বুজলো দুচোখ। হায় দুঃখ!
দুঃখের উপর দুঃখ, ব্যথার উপর
ব্যথা পড়তে লাগলো আছড়ে আছড়ে;
যেভাবে ঝড়ের আগমনে ফুঁসে ওঠে
সমুদ্রের পানি, তারপর দল বেঁধে
আছড়ে আছড়ে পড়ে নির্বাক সৈকতে।
শোকে যে প্রস্তর হলো বুক! জীবনের
অনন্ত সঙ মহান স্রষ্টার ডাকে
চললো অনন্তপারে, প্রাণের পতিকে
ফেলে রেখে মক্কার হিংস্র পশুদের
মাঝখানে। পঁচিশ বছর প্রাণভরে
দিয়েছে সে ভালবাসা; রাখেনি কিছুই
অধিকারে তাঁর, দু-হাত উজাড় করে
দিয়েছে স্বামীকে তাঁর সমস্ত সম্পদ,
উপহার ছয়টি সন্তান, আর তৃপ্ত
করেছে প্রথম মুসলিম হয়ে। আহা,
হয়নি কখনো এরকম, হয়েছে সে
রুষ্ট পতির উপর, দিয়েছে সে তাঁকে
ব্যথা! শুধু আজই জীবনের প্রথম ও
শেষ ব্যথা দিয়ে, আল্লাহর উপর সঁপে
দিয়ে স্বামী ও সন্তান, বেহেস্তের হাসি
হাসতে হাসতে, যেন বলতে বলতে
একথা, একাকী চললো অনন্তপারে--
'আবুল কাশেম, হে আমার প্রাণপতি
এবং আমার প্রাণাধিক প্রিয় নবি,
দেখা হবে জান্নাতে, যেখানে থাকবে না
দুঃখ-কষ্ট, নিপীড়ন-অত্যাচার, কেউ
এসে করবে না অপমান, মারবে না
মুখে থুতু, সবার উপর প্রতিষ্ঠিত
হবে তোমার সম্মান, তাই দেখে আমি
ছুটে গিয়ে বলবো তোমাকে, ‘মহম্মদ!
ওহে আল্লাহর রসুল! চিনতে কি পারো,
পৃথিবীর আমি সেই খাদিজা তোমার! ''
দুচোখ সমুদ্র হয়ে শুভ্র অশ্রুজলে
ভেজাতে লাগলো তাঁর দাঁড়ি। ফাতিমার
আর্তনাদে বিধ্বস্ত হৃদয় তাঁর আরো
বেশি শব্দ করে হতে লাগলো খানখান।
মহম্মদ বলে উঠলো আপ্লুত স্বরে,
'সবাই যখন কুফরি করলো, তিনি
সে-সময় বিশ্বাস স্থাপন করলেন।
যে-সময় লোকেরা আমাকে মিথ্যাবাদী
সাব্যস্ত করলো, তখন আমাকে তিনি
সত্যয়ন করলেন। লোকেরা যখন
আমাকে বঞ্চিত করলো, তখন তিনি
তাঁর সম্পদের অংশীদার করলেন
আমাকে। মহান আল্লাহ আমাকে তাঁর
গর্ভে প্রদান করলেন আমার সন্তান।'
পিতৃব্যবিয়োগ আর পত্নীবিয়োগের
দুই ব্যথা দুমড়ে মুচড়ে দিলো তাঁর
দেহ-মন। তবু তাঁর উপর অর্পিত
নবুয়তি দায়িত্ব পালনে মহম্মদ
রইলো অটল, যেভাবে প্রচণ্ড ঝড়-
ঝঞ্ঝার মধ্যেও অটল দাঁড়িয়ে থাকে
পর্বত। এদিকে ক্ষিপ্ত পৌত্তলিকগণ
আবু তালিবের মৃত্যুতে হয়ে উঠলো
আরো বেশি আগ্রাসী। কে আছে তাদেরকে
করে প্রতিহত এ-মক্কানগরে আর?
পথে-ঘাটে, কাবাগৃহে যত্রতত্র তাই
করতে লাগলো পর্যুদস্ত তাঁকে। আর
তাঁর অনুসারীদের 'পরে নেমে এলো
কঠিন নিগ্রহ। একদিন মহম্মদ
সালাতের জন্যে গেল কাবাঘরে। তাঁকে
চতুর্দিক হতে ঘিরে ধরলো শত্রুরা।
হঠাৎ উকবা বিন আবি মুআইত
গলার চাদর ধরে সর্বোচ্চ শক্তিতে
করলো চপেটাঘাত তাঁর মুখে। ঘৃণ্য
এ-পাষণ্ড অতঃপর অভিশপ্ত হাতে
ধরলো পবিত্র কণ্ঠ তাঁর চেপে। কেউ
গিয়ে বললো, 'হে আবুবকর, আপন
বন্ধুকে বাঁচাও।' ক্ষিপ্র বেগে ছুটে এলো
আবুবকর। পাপিষ্ঠ উকবার দুই
কাঁধ ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো তাকে।
সে বললো ক্ষিপ্ত কণ্ঠে, 'হায়, লোকটাকে
তোমরা কি এজন্যই হত্যা করছো যে,
সে বলে, ‘আল্লাহ আমার প্রভু? '' তখন
পৌত্তলিকগণ মহম্মদের বদলে
ঝাঁপিয়ে পড়লো আবুবকরের 'পর,
যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র হায়েনারা
হরিণের 'পরে। বনু তামিম গোত্রের
লোকেরা খবর পেয়ে ছুটে এসে তাঁকে
করলো উদ্ধার। কাবায় দাঁড়িয়ে তারা
ঘোষণা করলো, 'ওহে কুরাইশগণ,
আল্লাহর শপথ! যদি আবুবকরের
মুত্যু হয়, হত্যা করে ফেলবো আমরা
উকবাকে, কারণ সে সবচেয়ে বেশি
দেখিয়েছে বর্বরতা।' আবুবকরের
ফিরলো যখন হুঁশ, সে বললো, 'বলো,
কেমন আছেন আল্লাহর রসুল? ' তাঁর
কথা শুনে লোকেরা ধিক্কার দিলো তাঁকে।
তারা বলতে বলতে গেল, 'যাঁর সাথে
পীরিতের জন্যে মরতে বসেছিল সে,
হুঁশ ফিরলেই তাঁর একমাত্র কথা
‘মহম্মদ'। মহম্মদ জাদুগ্রস্ত করে
রেখেছে এদের।' তার মা উম্মে খইর
বললো উদ্বিগ্ন হয়ে, 'একটু খাও, বাছা।
হয়ে নাও সুস্থ আগে।' সে বললো, 'সে-পর্যন্ত
কিছুই খাবো না আমি, যে-পর্যন্ত আমি
জানতে না পারছি আমার রসুলের
খবর।' বললো উম্মে খইর সখেদে,
'হায়, বাছা! কার কাছে গিয়ে এত রাতে
জানবো আমি তাঁর কথা? কে দেবে আমাকে
তাঁর সংবাদ? ' বললো আবুবকর,
'যাও ওমরের বোন উম্মে জামিলের
কাছে।' শুনে উম্মে খইরের কথা, ভয়
পেয়ে গেল ফাতিমা বিনতে খাত্তাব। সে
বললো পরম বিস্ময়ের সাথে, 'হায়!
কে মহম্মদ ও কে আবুবকর—আমি
তার কী জানি! ' বললো উম্মে খইর কেঁদে,
'হে উম্মে জামিল, আল্লাহর কসম! কিছু
না খেলে যে মারাই যাবে সে! এদিকে সে
খাবেও না কিছু, যতক্ষণ না জানতে
পারছে মহম্মদের কথা।' সে বললো,
'তাহলে চলুন, দেখে আসি আপনার
পুত্রকে।' মুমূর্ষু আবুবকরকে দেখে
কেঁদে উঠলো সে উচ্চৈঃস্বরে। তাঁকে দেখে
বললো আবুবকর, 'আল্লাহর রসুল
কেমন আছেন? ' সে বললো, 'তিনি ভালো
আছেন। আপনি শান্ত হোন, সুস্থ হোন।'
বললো আবুবকর, 'এ-মুহূর্তে তিনি
কোথায় আছেন? ' সে বললো, 'আরকামের
ঘরে। সুস্থ আছেন সম্পূর্ণ। হবেন না
অস্থির আপনি।' আবুবকর বললো,
'আল্লাহর কসম! কিছুই দেবো না মুখে,
যে-পর্যন্ত আমার নবিকে দেখতে না
পাচ্ছি নিজ চোখে।' নিরুপায় দুই নারী
দুই পাশ থেকে তাঁর দুই স্কন্ধ ধরে
নিয়ে চললো রাত্রির গাঢ় অন্ধকারে
আরকামের বাড়ি। তাঁকে দেখে আর্তনাদ
করে উঠলো মহম্মদ, 'হে আল্লাহ! আপনি
চিনে রাখুন, যে আবুবকরকে এভাবে
করেছে আঘাত।' অতঃপর দুই বন্ধু
আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে কাঁদতে লাগলো,
যেভাবে হারানো সন্তানকে ফিরে পেয়ে
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে মা ও শিশু। দেখে
মুসলিমগণও জুড়ে দিলো আর্তনাদ।
তারা বললো, 'হে সত্য-নবি! এইভাবে
কত আর মার খেতে থাকবো আমরা? '
মহম্মদ বললো তাঁদের, 'ধৈর্য ধরো।
নিশ্চয় আমার রব চূড়ান্ত বিজয়
দান করবেন তোমাদের। তাড়াহুড়ো
কোরো না। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে।'
চাতক পাখির মতো গভীর বিশ্বাসে
চেয়ে রইলো তাঁরা দূর আকাশের দিকে,
মূলত যেখান থেকে নামে পানি, শান্তি
আর পৃথিবীবাসীর সমস্ত ফয়সালা।
এমন দুঃসহ নিপীড়ন এইবার
চালাতে লাগলো কুরাইশগণ, তাঁকে
তিষ্ঠতে দিলো না দুই দণ্ড; আত্মরক্ষা
ও আত্মসম্মান রক্ষায় রাখলো তাঁকে
ব্যতিব্যস্ত করে। হেন কোনো ভাষা নেই,
করে না বর্ষণ তাঁর ‘পরে; হেন কোনো
নেই নিকৃষ্টতা, তাদের দুর্ব্যবহারে
ওঠে না যা ফুটে! একদিন ভোর বেলা
ঘর থেকে বের হতে না হতেই, এক
বর্বর জঙলি কুরাইশ ছুটে এসে
এক ঝুড়ি মাটি তাঁর মাথার উপর
দিলো ঢেলে। সেই অবস্থায় মহম্মদ
ফিরে এলো বাড়ি। হু-হু করে কেঁদে ওঠে
ফাতিমা, নন্দিনী তাঁর; মোছে তাঁর
সুবর্ণ মস্তক আর জোড়ে আর্তনাদ,
'ওহে কুরাইশগণ! একটু লজ্জিত
হও। চিন্তা করো, কার সাথে এরকম
করছো তোমরা। চিনতে পারোনি তাঁকে।'
মহম্মদ বলে, 'ক্রন্দন কোরো না, মাগো!
সর্বশক্তিমান প্রভু মহান আল্লাহ
তোমার পিতার হেফাজতকারী।' চলে
দিন এইভাবে। শুনতে চায় না কথা
কেউ। কাউকেই যায় না সত্যের পথে
ডাকা। পলকে পলকে প্রতিরোধ, তীব্র
আক্রমণ মুহূর্তে মুহূর্তে, যেন কোনো
ঝড়ো দুর্যোগের রাতে আসমান থেকে
ধেয়ে আসা মুহুর্মুহু বজ্রপাত। তাই
মহম্মদ ভাবে, মক্কার বাইরে গিয়ে
যদি মানুষকে যেতো ডাকা, হয়তো বা
লাভ হতো এর চেয়ে; মানুষ হয়তো
শুনতো সত্যের কথা, মেনে নিতো তাঁর
ধর্ম। এই ভেবে একদিন যায়দ বিন
হারিসাকে নিয়ে চললো সে তায়েফের
উদ্দেশে। সেখানকার বিখ্যাত কবিলা
সাকিফের তিন নেতা, ছিলো তিন ভাই:
আমর বিন ওমাইর সাকাফীর পুত্র
আবদে ইয়ালিল, মাসউদ ও হাবিব।
মহম্মদ তাদেরকে জানালো আহ্বান
মহান স্রষ্টার একত্ববাদের দিকে,
এবং বললো, 'আমি আল্লাহর রসুল।
মানুষের কল্যাণ এনেছি আমি বয়ে।'
শুনে অবজ্ঞার সুরে বললো আবদে
ইয়ালিল, 'আল্লাহ রসুল করে যদি
পাঠিয়েই থাকেন তোমাকে, দেখাও তো
কাবার গেলাফ ফেড়ে! ' তাচ্ছিল্যের সাথে
বললো আরেক ভাই, 'তোমার আল্লাহ
নবি বানানোর জন্যে পায়নি কাউকে
আর খুঁজে? ' বললো তৃতীয় ভাই, 'আমি
বলবো না কোনো কথাই তোমার সাথে।
যদি তুমি সত্যিকার হয়ে থাকো নবি,
তাহলে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করা মানে
জ্বলন্ত বিপদ ডেকে আনা। আর যদি
মিথ্যাবাদী হও, তাহলে তোমার সাথে
কথা বলার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
অতএব আমাদের এ-শহর থেকে
দূর হও এক্ষুণি।' এভাবে সাকিফের
নেতাদের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে
ঘুরতে লাগলো মহম্মদ তায়েফের
গোত্র থেকে গোত্রে। দশ দিন দশ রাত্রি
এ-গোত্রে সে-গোত্রে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হলো
বারবার। বিক্ষুব্ধ তায়েফবাসীগণ
তাঁকে তাড়ানোর জন্যে বজ্জাত কিশোর-
যুবকদের লেলিয়ে দিলো অবশেষে।
তাঁকে লক্ষ্য করে ছুঁড়তে লাগলো তারা
প্রস্তর, বৃষ্টির মতো। আঘাতে আঘাতে
উঠলো সে দিশেহারা হয়ে। তাঁর পুণ্য
বেহেস্তী শরীর হয়ে গেল রক্তাক্ত। সে
দৌড়াতে লাগলো সেই অবস্থায় সাথী
যায়দকে নিয়ে। যায়দ ঢালের মতো
রক্ষা করতে গিয়ে তাঁকে, হয়ে গেল শেষে
নিজেও রক্তাক্ত। অভিশপ্ত বাহিনীর
হাত থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিলো তাঁরা
এক আঙুরউদ্যানে। ক্লান্ত-শ্রান্ত তাঁরা
বিশ্রামের জন্যে বসে পড়লো মাটিতে।
হাত তুলে বলতে লাগলো মহম্মদ,
'হে আমার আল্লাহ, অনন্ত দয়াময়!
আপনার কাছে আমি আমার শক্তির
দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও মানুষের
কাছে আমার নিজস্ব মূল্যহীনতার
অভিযোগ প্রকাশ করছি। হে দয়ালু,
আপনি দুর্বলদের রক্ষাকারী আর
আমারও প্রতিপালক; আমার তো কেউ
নেই আপনি ছাড়া! প্রভু, আমাকে কাদের
নিকট অর্পণ করলেন? এ-কেমন
শত্রুর নিকট ন্যস্ত করলেন, যারা
শুধু অমার্জিত ভাষায় গালি-গালাজ
করছে এবং করে দিতে চাচ্ছে ব্যর্থ
আমার সত্যের সাধনাকে? এ-কেমন
অনাত্মীয় দুশমনদের হাতে, প্রভু,
সমর্পণ করলেন আমাকে? হে প্রভু!
তাতে কোনো দুঃখ নেই, যদি আপনি রুষ্ট
না হন আমার উপর। আপনার তুষ্টি
আর আপনার ইচ্ছা আমার মাথার
মণি। যদি সন্তুষ্ট থাকেন আপনি, তবে
কিসের পরোয়া করি আর! হে আল্লাহ,
আপনার সেই আশ্চর্য জ্যোতির আমি
আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা মুহূর্তেই
দূর করে দেয় সমুদয় অন্ধকার
আর চতুর্দিক করে তোলে উদ্ভাসিত।
আপনার উপরই ন্যস্ত আখেরাত আর
পৃথিবীর সমস্ত বিষয়। আপনি ছাড়া
কারো কোনো শক্তি নেই মর্ত্যে ও অমর্ত্যে।'
তাঁদের এ-হেন দুরবস্থা দেখে, সেই
আঙুরক্ষেতের মালিক উতবা বিন
রাবিয়াহ তার ক্রীতদাস আদ্দাসকে
পাঠালো ক্ষেতের এক গোছা ফল দিয়ে।
মহম্মদ ‘বিসমিল্লাহ' বলে যখন তা
আরম্ভ করলো খেতে, বললো আদ্দাস,
'এ-অঞ্চলে কারো মুখে এমন কথা তো
শুনিনি কখনো! ' মহম্মদ তার কাছে
তার ধর্ম ও জন্মস্থানের কথা জানতে
চাইলে সে বললো, 'আমি খ্রিস্টান এবং
নিনাওয়ার বাসিন্দা।' বললো মহম্মদ,
'তাহলে তো তুমি সৎ-ব্যক্তি ইউনুস
বিন মাত্তার গ্রামেই বাস করো? ' শুনে
বিস্মিত আদ্দাস বলে উঠলো, 'আপনি
কিভাবে জানলেন তাঁর কথা? ' মহম্মদ
বললো, 'আমিও তাঁরই মতো নবি। আমি
তাঁর ভাই।' একথা শুনেই তাঁর দিকে
ঝুঁকে পড়লো সে আর তাঁর হাতে-পায়ে
করলো চুম্বন। তা দেখে তার মালিক
উতবা বিন রাবিয়াহ তাকে ডেকে নিয়ে
করলো ভর্ৎসনা। বললো, 'লোকটা দেখি
বিগড়িয়ে দিলো তোমাকেও! ' সে বললো,
'হে আমার মনিব। এমন এক কথা
তিনি বলেছেন আমাকে, যা নবি ছাড়া
পৃথিবীর জানে না কেউই।' 'হে আদ্দাস, '
বললো উতবা, 'দেখো, সে যেন তোমাকে
তাঁর ধর্মে নিয়ে না যায়! তোমার ধর্ম
তাঁর ধর্ম থেকে, জেনো, অনেক উত্তম।'
আঙুরউদ্যান থেকে বের হয়ে এসে
হাঁটতে লাগলো মহম্মদ যায়দকে
নিয়ে মক্কা-অভিমূখে। যখন কারনে
মানাযেলে এসে পৌঁছোলো তাঁরা, মহান
আল্লাহর নির্দেশে জিব্রাইল এসে বলে
উঠলো, 'হে মহম্মদ! আপনার জাতি
আপনার সাথে যে-নিষ্ঠুর আচরণ
করেছে, আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেছেন।
আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার কাছে
তিনি, পর্বতসমূহ নিয়ন্ত্রণকারী
ফেরেস্তোগণের সাথে। এখন আপনি
যদি চান, তাহলে এক্ষুণি তায়েফের
দু-পাশের পাহাড়গুলোকে তাঁরা এক
করে দিয়ে পিষে মেরে ফেলবেন সব
তায়েফবাসীকে।' মহম্মদ বললো, 'না।
তা চাই না আমি। বরং আমার আশা,
মহান আল্লাহ এদের ভিতর থেকে
এমন বংশধর সৃষ্টি করবেন,
যারা তাঁর উপাসনা করবে এবং
কাউকেই তাঁর অংশীদার ভাববে না।'
'মারহাবা! মারহাবা! ' বলতে বলতে
ফিরে গেল ফেরেস্তারা। দু-চোখের জলে
ভাসায় যায়দ তাঁর বুক আর বলে,
'এমন দয়ার নবি এলো যার ঘরে,
কী করে সে কোন্ প্রাণে প্রস্তরে প্রস্তরে
করলো রক্তাক্ত তাঁর পবিত্র শরীর?
আমরা তো পর্বতের মতো আছি স্থির
এ-বিশ্বাসে— বিজয়ী হবেন তিনি তাঁর
দুশমনদের 'পরে এবং আল্লাহর
শ্রেষ্ঠত্ব সবার 'পরে হবে প্রতিষ্ঠিত।
মজলুম বেঁচে আছে, জালিমই তো মৃত।'
চলেছে মক্কার দিকে দুই মুসাফির
বিধ্বস্ত শরীরে। যায়দ বললো, 'ওহে
আল্লাহর রসুল! কিভাবে প্রত্যাবর্তন
করবেন মক্কায়? কে দেবে আপনার
নিরাপত্তা সেখানে? ' বললো মহম্মদ,
'হে যায়দ, যে-অবস্থা তুমি দেখছো, এর
সুরাহা নিশ্চয় হবে। আল্লাহতায়ালা
তাঁর মনোনীত ধর্ম মানবজমিনে
প্রতিষ্ঠিত করে ছাড়বেন আর তাঁর
নবিকে দেবেন চূড়ান্ত বিজয়। তিনি
যা চান, তা ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।'
মক্কার নিকটবর্তী হেরা পর্বতের
পাদদেশে এসে থেমে গেল মহম্মদ।
তারপর খুযায়া গোত্রের এক লোক
মারফত সংবাদ পাঠালো আখনাস
বিন শারিকের নিকট, যেন সে তাঁকে
আশ্রয় প্রদান করে। সে জানালো, তার
পক্ষে তা সম্ভব নয়। সংবাদ পাঠালো,
এরপর, সুহায়েল বিন আমরের
কাছে। সেও অস্বীকার করলো আশ্রয়
দিতে তাঁকে। এরপর সংবাদ পাঠালো
মুতইম বিন আদির নিকট। শুনে
সে বললো, 'ঠিক আছে।' মুতইম নিজে
অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে তাঁর পুত্রগণ
ও সম্প্রদায়কে ডেকে বললো, 'তোমরা
অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে কাবার নিকট গিয়ে
অবস্থান করো, কেননা মহম্মদকে
আশ্রয় দিয়েছি আমি।' এরপর তাঁকে
মক্কায় আসার জন্যে পাঠালো খবর।
মহম্মদ যায়দকে সঙ্গে নিয়ে চলে
এলো কাবাগৃহে। মুতইম বিন আদি
তাঁর অশ্বের পিঠের উপর দাঁড়িয়ে
ঘোষণা করলো, 'ওহে কুরাইশগণ,
শুনে রাখো, মহম্মদ বিন আব্দুল্লাহকে
আশ্রয় দিয়েছি আমি। কেউ যেন তাঁকে
উত্যক্ত না করে আর।' মহম্মদ সোজা
হাজরে আসওয়াদের কাছে গিয়ে তাতে
চুম্বন করলো। তারপর দু-রাকাত
সালাত আদায় করলো। তখন তাঁকে
নিয়ে মুতইম বিন আদি পৌঁছে দিলো
তাঁর গৃহে। আবুল হাকাম ছুটে এসে
বললো, 'তুমি কি কেবলি আশ্রয় দিলে
তাঁকে, নাকি তুমিও মুসলমান হয়ে
গেছো? ' সে বললো, 'না, তা নয়। আমি শুধু
আশ্রয় দিয়েছি তাঁকে।' তখন বললো
আবুল হাকাম, 'তুমি তাঁকে যা দিয়েছো,
হে মুতইম, আমিও তাঁকে তা দিলাম।'
----
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem