প্রায় ঘন্টা খানেক পর, ডাঃ লাহিড়ীর সহকারী চিকিৎসক আমাদের কাছে এলেন। উনি বাবার উদ্দেশে বললেন-
'ডাঃ মুখার্জী, মিসেস মুখার্জীকে আমরা বেডে দিয়ে দিয়েছি।'
ব্যস্ত হয়ে বাবা ওনাকে জিজ্ঞেস করলো-
'কেমন আছে ও।'
'ভালো। ভাইট্যালস বেশ স্টেবল।'
খবরটা দিয়েই ডাক্তারবাবু অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বাবা আমাদের উদ্দেশে বললো-
'চলো, দর্পণের কাছে যাই আমরা।'
OT-র অন্য প্রান্তে, গাইনি ওয়ার্ড। সেই ওয়ার্ডে ঢুকতেই, বাঁ দিকে কতকগুলো কেবিন। আর ডানদিকে নার্সিং স্টেশন। আর অদূরে বড় একটা হলঘর। সেখানে সারি সারি রোগীর বিছানা।
দর্পণ কোথায় তা বুঝতে না পেরে, বাবা এদিক ওদিক চেয়ে দেখলো। এক তরুণী নার্স কাছেই ছিলেন। উনি বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন-
'দর্পণ চ্যাটার্জীকে খুঁজছেন? '
বাবা মৃদুস্বরে বললো-
'হ্যাঁ। ও কোথায়? '
তরুণী নার্সটি তিন নম্বর কেবিনটির দিকে ইঙ্গিত করলেন। কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো বাবা। কিন্তু দু পা গিয়েই হটাৎ থেমে গেলো বাবা। তারপর মায়ের দিকে চেয়ে বাবা বললো-
'তোমরা যাও আগে।'
দর্পণের মাকে সঙ্গে নিয়ে কেবিনে ঢুকলো মা। তারপর আমাদের দিকে চেয়ে মা বললো-
'তোমরাও এসো।'
ঘরে ঢুকে দেখি, দর্পণ ঘুমুচ্ছে। ওর চোখ দুটো বন্ধ। মুখ ফ্যাকাশে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওর দু হাতে, দুটো নল লাগানো। একটাতে ব্লাড ট্রান্সফিউশান চলছে। অন্যটাতে ফ্লুইড। আর সঙ্গে ওষুধ।
এখনো ব্লাড চলছে মানে, বেশ রক্তক্ষরণ ঘটেছে ওর। ওর কপালে হাত দিতে গিয়ে হটাৎ থেমে গেলো মা। মুহূর্তের জন্য, মা বাবার দিকে চেয়ে দেখলো। বাবা বললো-
'ছুঁয়ে দেখো, উঠে কিনা! '
মা ওর কপালে হাত রাখতেই, চমকে উঠলো দর্পণ। মায়ের দিকে চেয়ে দেখলো ও। ওর বিবর্ণ মুখ যেন আরও বেশি বিবর্ণ হয়ে উঠলো। ডুকরে কেঁদে উঠলো ও। মা ওর হাতটা চেপে ধরলো।
দর্পণের মা দর্পণকে জিজ্ঞেস করলো-
'কি কষ্ট হচ্ছে, মা? '
দর্পণ ওর মায়ের দিকে চেয়ে রইলো। কিন্তু কোন কথা বলতে পারলো না ও। ওর চোখ থেকে কেবল বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো।
এবার ওর কাছে গেলাম আমি। টিসু দিয়ে ওর চিবুক মুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই, ও ওর পেটের দিকে চেয়ে দেখলো। তারপর আর্তনাদের সুরে ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
'আমার বাচ্চা কোথায় অমল? আমার বাচ্চা! '
নিজেকে কেমন যেন অবশ মনে হলো। টিস্যুগুলো আমার হাত থেকে খসে পড়লো। বিন্দু বিন্দু জল আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো। দর্পণের হাত চেপে ধরলাম আমি। তারপর বললাম-
তুমি আগে সুস্থ হয়ে উঠো, দর্পণ।
দর্পণ আবার আর্তনাদ করে উঠলো-
'আমার বাচ্চা? '
ওর প্রশ্নের কোন উত্তর করতে পারলাম না আমি। এমন সময় নার্সকে সঙ্গে নিয়ে ডাঃ লাহিড়ী ঘরে ঢুকলেন। উনি দর্পণের কপালে হাত রেখে বললেন-
'এটা দুর্ঘটনা মা। আগে সুস্থ হয়ে উঠ তুই। তারপর অনেক বাচ্চার মা হবি তুই।'
দর্পণ কোন কথা বললো না। কেবল ঘরের সিলিংয়ের দিকে অপলকে চেয়ে রইলো ও। তখনো বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ছে ওর চোখে থেকে। ডাঃ লাহিড়ী নার্সের দিকে চেয়ে বললেন-
'সুকন্যা, দর্পণের ভাইট্যালসগুলো চেক করো তো।'
নার্স ব্লাড প্রেসার আর টেম্পারেচার মাপলেন। তারপর ডাঃ লাহিড়ীর দিকে চেয়ে বললেন-
'ব্লাড প্রেসার ১০০/৫৮, পাল্স ৯০, আর টেম্পারেচার ৯৭.৬'
ডাঃ লাহিড়ী এবার দর্পণকে জিজ্ঞেস করলেন-
'কিরে, এখন কোন কষ্ট হচ্ছে তোর? '
দর্পণ কোন কথা বললো না। কেবল সিলিংয়ের দিকে চেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো ও। ডাঃ লাহিড়ী কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন দর্পণকে। তারপর মৃদুস্বরে উনি বললেন-
'এবার তোর ড্রেসিংটা একটু চেক করবো, মা? '
সিলিংয়ের দিকে চেয়েই ঈষৎ একটু ঘাড় নাড়লো দর্পণ। সম্মতিসূচক। বাবা আর বিদুদা মুহূর্তের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নার্স দর্পণের পেটের আবরণ একটু উন্মুক্ত করলেন। সেদিকে চেয়েই ডাঃ লাহিড়ী বললেন-
'ড্রেসিং বেশ শুখনোই রয়েছে।'
ডাঃ লাহিড়ী এবার বাবার উদ্দেশে ডাক দিলেন-
'ডাঃ মুখার্জী ভিতরে আসুন।'
বিদুদাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা ঘরে ঢুকলো। বাবা ঘরে ঢুকতেই, ডাঃ লাহিড়ী বাবাকে বললেন-
এখনো পর্যন্ত সবই ঠিক রয়েছে। দিন দুয়েক অবজার্ভ করার পর নিয়ে যান ওকে।
ডাঃ লাহিড়ী এবার দর্পণকে জিজ্ঞেস করলেন-
'কিরে, কিছু দরকার তোর? '
দর্পণ কোন কথা বললো না। কেবল ওর পেটের দিকে চেয়ে দেখলো ও।
ডাঃ লাহিড়ী আবার বেশ কিছুক্ষণ দর্পণের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন-
'বেশ, আজ যাচ্ছি। কাল সকালে দেখতে আসবো তোকে।'
দর্পণ হাত জড়ো করে ডাক্তারকে নমস্কার জানানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। ওর দু হাতে দুটো নল লাগানো। সেগুলোতে টান পড়লো। ডাঃ লাহিড়ী ব্যস্ত হয়ে বললেন-
'না না, নমস্কার করতে হবে না। আগে তুই বিশ্রাম নে।'
নার্সকে সঙ্গে নিয়ে, ডাঃ লাহিড়ী চলে গেলেন।
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem