প্রস্তরখন্ড 2
অনিবার্য জন্মদাগ ভেসে যায় মানভুমের ঘনিষ্ট দেহে
জৈবিক সন্ধ্যার কান্নামাখা জলে। প্রতিশ্রুতিময় বেঁচে থাকা
ক্রমাগত ভেঙে ভেঙে যায় বহুদূর আকাশের মেঘদেশে।
খেজুর গাছের বুকে জ্যোৎস্না আসে অন্তিম বিশ্বের শব্দছুঁয়ে।
ব্যর্থতার মধ্যরাতে কুয়াশার মৃত জলকণা অন্ধকার
অস্তিত্বে ভাসতে ভাসতে প্রাচীন অশ্রুর ভেতর হেমন্তের
গান গায়। ব্যক্তিগত রাত্রের শূন্যতা ভেঙে আদিম সৃষ্টিতে
নিজেকে জাগায়। উৎসের প্রান্তর ঝরে যায় আদিম গহ্বরে।
বৃত্তের ভেতরে ডাহুক- ঝিঁঝিঁর ক্ষয়- মৃত্যু- বিরোধিতা; চিল
শকুনের দৃষ্টিতে বিপন্ন হয়ে দেখেছে তাদের উপকূলে
প্রকৃতির সীমাহীন বিপরীতে শুয়ে আছে অপদেবতারা।
বসন্ত শেষের শুকনো পলাশ মরে যায় বহু স্বাদ রেখে।
প্রাকৃত বীজের ভেতর নিহিত সুর পাহাড়ের মনে ঘোরে।
নিজস্ব রাত্রির গভীর তরঙ্গে শরীরের পাথুরে প্রকৃতি
চৈত্রের আলোর উজ্জ্বল রোদ্দুরে যেতে চেয়েছিলো একদিন।
বিশ্বাসের স্থির ভূমিতে নির্জনে রাঙ্গা মাটি— মায়াধুলো
হাতে নিয়ে বলে আহা এ আমার জন্মভূমি —দেহগর্ভে বাজে।
ভালোবেসে অঘ্রানের অপরূপ রূপে দেখে শিকড়ের মাটি।
নিরন্ন শিশুর ডাকে বিচ্ছিন্নের সকল যন্ত্রণা নেমে আসে
উদাসীন সন্ধ্যার আকাশে। সূর্যের ডুবন্ত রূপ পড়ে থাকে
প্রান্তরের দেহে। সেইখানে ছায়ার ভেতর তারা চেয়ে থাকে
একমুঠো উচ্ছিষ্টের দিকে। বৃদ্ধ পৃথিবীর বিষন্ন গোধূলি
বারবার দিগন্ত আড়াল করে। স্নেহের সীমান্তে কাঁটাতার;
কে ঘুচাবে এই অন্ধকার! যদিও দধিচি অসংখ্য প্রদীপ
জ্বেলেছিল অস্থি মাংসে এই রূঢ় রুক্ষ মহাশূন্যের অতলে।
বাবলা কাঁটার ফাঁকে সুর্য ডোবা আলো মাটির নুড়িতে মেশে।
গেঁয়ো শেয়ালের ডাকে শব্দের মন্থন বুড়ি পুকুরের জলে
ভেসে গিয়ে শ্মশানসন্ধ্যার ঝোপে নিজস্ব মুদ্রায় মিশে যায়।
মৃত্যুর কুয়াশা স্বাদ জেগে থাকে তারই স্তব্ধ পাতার আড়ালে।
ধূসর ছায়ার অর্ধনারীশ্বর চিরস্থির শূন্যে চিরকাল
স্বাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। বাউল সুরের বাতাসে জন্মের গূঢ়
অভিমান বৃহৎ ভূখণ্ডে প্রাচীন সত্তার আদিস্রোতে আজো
ফিরে যেতে চায়। একদিন সাঁঝপাখি যজ্ঞিডুমুর গাছের
থেকে উড়ে গিয়ে দেববাতাসের শরীরে স্বচ্ছন্দে মিশে যেতো।
নদীর কিনারে ভাঙ্গা রৌদ্ররেখা আকন্দফুলের শবদেহে
নিজেকে জড়ায়। গোধূলির দামোদর ডাকে তার ধ্বনিজালে।
শীর্ণ পাতাগুলি বিকেলের বিবর্ণ জলের সঙ্গে কথা বলে।
পাতাহীন গাছের কঙ্কাল মুমূর্ষু জোড়ের ধারে পিতৃত্বের
প্রতিশব্দে দাঁড়িয়ে থেকেছে সময়ের চেতনার পরিনত
ইতিহাসে যেখানে জন্মের নাভি জন্মকে মঞ্জুর করেছিলো
একদিন। ফাল্গুনের আত্মা গণতান্ত্রিক রাতের অন্ধকারে
নীরবে বিকিয়ে গেছে পৃথিবীর গলিত শবের শেষদেশে।
ঘ্রাণহীন শীতল জীবন তবু পৃথিবীতে বয়ে আনে প্রেম।
দলমার ভূমিতলে সুবর্ণরেখার প্রতিধ্বনি খেলে যায়
করোটি কঙ্কালে। বিগত হলুদ কোনো শতাব্দীর জন্মভ্রূণে
আদিম বিকার ছিলনা কোথাও। হাজারীবাগের একরোখা
বিমূর্ত সন্ধ্যার ছায়ায় পাখির সঙ্গীতে বিস্তীর্ণ মালভূমি
গভীর ঘুমের ভেতর স্মৃতি ও বিস্মৃতির স্বপ্নে জালাভর্তি
মহুয়ার গন্ধে নিজস্ব দ্বীপের সরল সভ্যতা গেঁথেছিলো
প্রজন্মের গায়ে। অন্ধকার জরায়ুর বলিরেখা ভেদ করে
আদি নাভিমূল থেকে উঠে আসে চায়বাসা -জীবন্ত স্তব্ধতা।
ক্ষয়িষ্ণু পাথর পরিচিত শিলাখন্ডে অসমাপ্ত পর্বসন্ধি
আজ দীর্ঘতম হাড় - ক্রমাগত তার দৃশ্যপট বদলায়।
শালবনে নদীর শরীরী শব্দ জৈন মন্দির চত্বরে ভাসে।
জলের অতলে স্থির তৃতীয় চোখের তীক্ষ্ণ পথে নদীতটে
শ্মশান সংলগ্ন গ্রামদেশ দেখেছিলো বিষন্ন চৈতন্যে ভরা
দেহ ও আত্মার দ্বন্দ্ব। মাঠের ফসলে তখনো মাতৃত্ব খেলে।
ঝর্নার ব্যথিত জল ঘিরে পাথুরে পাতার শালের জঙ্গলে
মুন্ডাদের অশ্রুত শব্দের দুঃখস্রোতে দামোদর বয়ে যায়।
সমূহ নদীতে সময়ের স্বরে পিতৃপুরুষের প্রেত কাঁদে।
রক্তের ভেতর ধুমল পাহাড় তারই তলে পলাশের মৃত
অরুণাভ প্রজাপতিফুল শুয়ে থাকে স্তব্ধ মাটির উপর ।
করতলে কার্তিকের হাহাকার কান্নার অদৃশ্য রক্তপাত
মৃত্যু আর অপমৃত্যুর নির্জন বেদনা ব্যাকুল করে যায়।
বাস্তুভূমি- ঘরবাড়ি, ফসলের মৃত মাঠ ক্ষুধিত নাভির
অনন্ত প্রান্তরে কাঙালী মায়ের অবিরত পরাভব দেখে।
আকাঙ্ক্ষার শাখা প্রশাখা স্রোতের বিপক্ষে নিশ্চল হয়ে যায়।
ধূসর যুগের অস্পষ্ট রহস্যময় স্পষ্ট ক্ষয় কুয়াশার
আদিম ভিতরে ক্রমাগত নিচু হয়ে ভেঙে পরে ভূখণ্ডের
সত্তার শেকড়ে হিম অন্ধকারের বিবর্ণ শব্দের মতন।
ক্লেদাক্ত রক্তের উৎসমুখে চেতনার মধ্যরাতে সন্তানের
স্বাভাবিক জন্মে দেখেছিলো সচ্ছজলে আলোর কণিকা ভাসে।
শাদা জ্যোৎস্না ঘিরে তামাকের পোড়া গন্ধ ক্ষীণ অক্ষম নদীর
কুয়াশার ঝোপে জমে থাকে। গোপন অশ্রুর অতীত রাতের
জলে আজো শালগ্রামশিলা ভিজে আছে মাদল মেঘের কোলে।
পৃথিবীর প্রথম রাত্রির বুকে সৃষ্টির মরমী সুরে দীর্ঘ
স্নেহের আশ্রয়ে এই সাঁওতালি মাঠে বহু ফসল ফলেছে।
যন্ত্রণার নিঃস্ব রাতে দহনবেলার পশ্চিমের শান্তকথা
ছায়ামাখা প্রান্তরের প্রাচীন গল্পের ভাঙ্গা দেহে সেইলিপি
লেখা আছে। পাহাড়ের কোলে গোধূলি জননী বেদনার রাতে
জন্মবীজ ছড়িয়ে আদিম হেমন্ত রাত্রির পাতার মতন
সমগ্র সত্তায় নিজেকে ছড়ায় গেঁয়ো পৃথিবীর প্রত্নদেহে
যেখানে নক্ষত্র আলোর নিঃসঙ্গ কঙ্কাল গভীর রোদ্দুরের
সহজ দর্শনে বেঁচে থেকে জন্মের ঘনিষ্ট মুহূর্তকে ডাকে।
সময়ের জীবিত নিশ্বাস আত্মকথা পাখির পালকে উড়ে
গিয়ে অবেলার অবসাদ মুছে দেয় আলোজন্মের বিবরে।
বনচাঁড়ালের বনে বুড়ো শিমুলের ডালে মিহি সন্ধ্যা বসে;
তারই তলে জীবনের মরুভূমি নির্জন শ্মশানকলসির
জলে কাঁপে। শূন্যতার সকল মুহূর্ত অশ্বত্থের ডালে বসে
চিরন্তন অস্তিত্বের ব্রহ্মান্ডের রক্তজলে তার চিহ্ন খোঁজে।
হৃদয়ের অসংখ্য শুকনো শিরা উপশিরা বিমূর্ত মৃত্যুর
ছায়াময় সবুজ পাতার বীজরসে তার রূপ রেখে যায়।
মলিন আলোর বিবর্ণ জ্যোৎস্নায় রাখালের প্রাচীন ধুলোর
শব নিরুদ্দেশ হয়। কুয়াশার বিষন্ন মন্দিরে ফাল্গুনের
নিবিড় শরীরে পূর্বপুরুষের নীল অন্ধকার বাঁশবন
থেকে উঠে এসে শ্মশান জোড়ের জল ছুঁয়ে আজো কথা বলে।
বিরহ ভূমির বেদনার নশ্বর সন্তান ফিরে ফিরে আসে
পাহাড়ি রোদ্দুরে তাদের আকাঙ্ক্ষা চৈত্রের চৈতন্য চেয়েছিলো।
ভাঙ্গা চন্ডিমণ্ডপের নিঝুম ধ্বংসের দৃশ্য ক্ষয়ে ক্ষয়ে কাঁদে।
ব্যক্তিগত দুঃখ গুলি ফেলে এসে তারা ঘর বাঁধে শরীরের
ঘ্রাণে। আত্মার সবুজ দ্বীপে পোয়াতি ধানের গর্ভে জেগে থেকে
পশ্চিম আকাশে সুদূরের কণ্ঠস্বরে শতাব্দীর আত্মীয়তা
খুঁজে এই ভূখণ্ডটুকুর শেষ টানে। অনেক ধ্বংসের পর
তারা জেগে আছে। অবসরের একান্ত দিনে ক্লান্তির চূড়ান্ত
ছায়া জীবনের যন্ত্রণা ছুঁয়েছে এই শুষ্ক শূন্য চরাচরে ।
বুড়ি কংসাবতীর ঘুমন্ত দেহে বজ্রভূমির নিঃসঙ্গ জলে
নিষাদের কান্নামাখা মুখ ভাসে। জন্মান্ধ পাখির অশ্রুস্মৃতি
একান্ত নিজস্ব পথে ঝরে; আজন্ম ঘুমিয়ে থাকা এই গ্রামে।
নৈঃশব্দ্য শব্দকে অতিক্রম করে আকাশের দিকে ছুটে যায়।
গভীর গহ্বরে অনন্ত রাত্রির দহন বিস্মিত স্নায়ুগ্রন্থি
জাগিয়ে প্রাকৃত ধুলোর প্রবাহে বহু জন্মের নিবিড় দাগ
রেখে উড়ে যেতে চেয়েছিলো। আত্মজের বুকে চিরকাল তারা
অঘ্রাণের ফসলের প্রতিশ্রুতি রেখে গেছে। আদি আষাঢ়ের
নীল কুয়াশার অন্ধকারে; বিপরীত স্রোতের অন্তরে শেষ
আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে অবিরল দিয়ে গেছে মাটিতে জন্মের স্বাদ।
নীহারিকাছিন্ন ভূখণ্ডের মায়াবী উষ্ণতা সময় সীমানা
পার হয়ে রক্তের অতল গহ্বরের ভিতরে স্থিরতা চেয়ে
পৃথিবীতে কোনো এক বিকল্প বোধের জন্ম দিতে গিয়ে আজো
দিনান্তে পায়ের ছাপ রেখে যায় মাটির মনের চেতনায়।
মহাশূন্যে পৃথিবীর ঋণ রেখে ব্যথিত বিশ্বের জন্মজলে
তারা ফিরে আসে পাহাড়ি পথের বাঁকে হেমন্তের মাতৃত্বের
স্বাদ নিতে। অন্তহীন আত্মনিবেদনে মহাকালের অনন্ত
সত্তা ছুঁয়ে মরুগানে জন্মভূমির আদিম উৎসে ঘুমিয়েছে
প্রান্তিক পল্লীর বহু ঋতুর আঁধারে। হাহাকার বাতাসের
শোক মেখে পাষাণের দেশে নরকের শরীরের অপচ্ছায়া
তাদের জীবনে জীবনের অন্তিম অজ্ঞতা দিয়ে পৃথিবীতে
পীড়নের অভিজ্ঞতা গেঁথেছিলো বেদনার পার্থিব প্রদেশে।
তবু মরণের পরে স্বজনের শান্ত সংসারে ফিরতে চেয়ে
করোটির দগ্ধ কঙ্কাল বিশ্বাসে ভাসিয়েছে আদি দামোদরে।
স্বপ্নের ভিতরে শুয়ে থাকা শৈশব পাতায় পাতায় নির্জনে
নূপুরের শব্দ শোনে। মুরিনদীর শীতের স্রোত প্রতিরাতে
ইথারের মতো ভাসে। বিপুল শূন্যের উপর নক্ষত্র আলো
সহস্র সন্ধ্যার কথা বলে যায়। জ্যোৎস্না রাতে প্রাচীন পাথরে
মন্দিরের শিলালিপি সময়ের শেষচিহ্নে স্থির হতে চায়।
বিমূর্ত অস্তিত্বে মৃত্যুর দুঃসহ ধ্বনি সৃষ্টির সকল শর্তে
দুর্লভ আলোর দিকে নিজেকে নিক্ষিপ্ত করে পৃথিবীর ধুলো -
মাটি-স্রোতে -বেঁচে থেকে পুনরায় জীবনের অভিজ্ঞতা চায়।
দীর্ঘ অক্ষমতা রেখে তবু তারা ভেসে গেছে নিবিড় অন্তিমে।
চেতনার গূঢ় গ্রন্থি দেহাতীত প্রাণস্রোতে ব্যাকুলতা রেখে
নিঃশব্দে রাত্রির বিবর্তনে দামোদরের একান্ত অন্তরঙ্গ
অন্ধকার নদীজলে আকাঙ্ক্ষার আর্দ্র প্রতিবিম্ব রেখে যায়।
পৃথিবীর প্রাচীন হরফে, ধূ ধূ মাঠের মায়াবী বৃত্তে তারা
দেখেছিলো গৃহস্থের শালিক চড়ুই বহু ব্যর্থতার পর
আজো ব্রহ্মান্ডের স্বাদে বেঁচে আছে। পানকৌড়ি জলহাঁস খেলে
পাকা ফসলের গন্ধে। পূষ্যানক্ষত্রের আলো কাঁসাই কুমারী
নদীজলে এলে টুসুগানে পৌষলক্ষী জাগে। কুমারী মনের
আকাঙ্ক্ষা অজলা মাটি থেকে দূর দিগন্তের ভোরে মিশে যায়।
লালমাটি মেঠোপথে পলাশের রাঙ্গাডাঙ্গা আজন্মের স্তব্ধ
অন্ধকারে একাকী বিচ্ছিন্ন হয়ে শেকড়ের শেষ আলোটুকু
ভিক্ষে করে নির্জন অস্পষ্টতার দিকে চলে যায় বহু দগ্ধ
ক্ষতের শূন্যতা নিয়ে।কালের বিষাদী ধ্বনি নিষাদের দেহে
অশ্রু পতনের ছবি আঁকে। তবু অশ্বনদী থেকে উঠে আসে
সূর্যপুত্র কর্ণ। জননীর বুকে এই দৃশ্য বহু রোদ্দুরের
পর আজো গাঢ় হয়ে আছে। সূর্যাস্তে পাখির কঙ্কাল অনার্য
পুকুরের জলে নিজের শাশ্বত মাটিগন্ধে এই ধূ ধূ হৃদয়ের
শিখরভূমিতে সন্তানের জন্ম দিয়েছে সৃষ্টির অফুরন্ত
জ্ঞানের বাতাসে। পাহাড়ি পাখির কোলাহলে নিজেকে নিজেই
স্পর্শ করে বারবার শূন্যতা ভেঙেছে আদিস্বরে বেঁচে থেকে।
তারপর প্রাচীন ছবির মতো নিজেকেই নিজে জাগিয়েছে।
অথৈ শূন্যতার সকল বাসনা মানুষের ঘ্রাণে চিরকাল
জেগে থাকে ক্ষয়ের ভেতর। যদিও দিনান্তে মাদলের শব্দে
একফালি রোদ বিষাদের মুখোমুখি শুয়ে থাকা সময়কে
জাগিয়েছে। অবিশ্রান্ত রক্তের আঘাতে শূন্য মালভূমি জুড়ে
তৃতীয় বিশ্বের নিঃস্ব জঠরে তিতির ডেকে যায়। শ্মশানের
অন্ধকারে পড়ে থাকে লক্ষীর উঠোন-পিপাসিত সন্ধ্যাদ্বীপ।
সমূহ স্মৃতির আলো জীবনের এমন নির্জন পরাভবে
আরো ক্ষয়ে যায় ক্ষয়ের গভীরে। শিলাখণ্ডে মানুষের সত্তা
সময়ের শিকড়ে শিরায় জন্মের নির্ভুল দিগন্তকে ছুঁয়ে
মাটির মেধাকে উর্বর করতে চেয়েছিলো। তাদের স্বপ্নের
ভেতর কাঙ্ক্ষিত শীতার্ত নদীটি বয়ে যায়। মেঘমাখা মাঠ
ভরা ফসলের ক্ষেত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে বুকের গহ্বরে।
তবু মাঝরাতে কোনো এক দেবগন্ধ বাতাসকে ঘিরে রাখে।
হেমন্ত রাত্রির প্রাকৃত কল্লোল মাতৃমুখ অধিকার করে
আদি শূন্যতার কণ্ঠস্বরে ডেকে নেয় নিজের শিশুকে তার
মায়াবী আঁচলে। আধো অন্ধকারে ভাসমান অন্তিম শরীর
তারই অন্তরঙ্গ মায়াজালে আবার মেঘেরপাড়ে জেগে ওঠে।
বেদনার শুষ্কদেহে নাভিমূলের মরমী অধিকারে নদী
বৃক্ষলতা- ধানদূর্বা চেয়েছিলো তারা ম্লান দুঃখের রাত্রিতে।
সূর্যাস্তের গৈরিক সন্ধ্যায় দেশের নিহিত আদি সভ্যতার
ঘনিষ্ট সকালে ভাতের প্রাচীন প্রতিবিম্বটুকু বেঁচে থাকে।
ফুটিফাটা মাঠ-পোড়ো ঘর-বাঁশের ছাউনি- মহুয়ার বন
ছুঁয়ে হেঁটে যায় জলশূন্য নদীপথ। নীরবে একাকী তীব্র
শোকঅশ্রু এমন প্রান্তরে জন্মের সকল দৃশ্য দিনশেষে
গোধূলির দেশে ফসলের ছবি আঁকে। নৈঃশব্দ্যের বেদনায়
তবু পৃথিবীতে প্রাণ আসে আলোকিত প্রদেশের অপেক্ষায়।
পোয়াতি পদ্মের গন্ধে টের পায় হাড়ের ভেতর রাজপথে
অরণ্য ছড়িয়ে আছে। তারপর জেগে ওঠে নিজের শরীরী
তাপের বিশ্বাসে। রুক্ষ শুষ্ক পাথরের ভূমিকে অমর করে
জ্যোৎস্না রাতে। দূর দিগন্তের হাহাকার আশাহত চেতনার
মাটিকে উর্বর করে উদ্ভিদের ঘ্রাণে। ছায়াঘন রোদ্দুরের
করুন হৃদয়ে। দিকচিহ্নহীন শব্দময় ধুলোর আড়ালে
জৈন মন্দিরের নিথর ভাস্কর্য গুলি অবেলার রক্তস্রোতে
দেখেছে অজস্র অভিমান। বিবর্ণ অভ্যাসে স্মৃতি উড়ে যায়
তবু কোনো এক পরাস্ত সন্ধ্যার চেতনায় স্থবিরতা থেকে
মানুষের মন চলে যায় অন্ধকারের অতীত ধারাভাষ্যে।
সেইখানে দিনলিপি সূর্যের পশ্চাৎপটে অজ্ঞাত তরঙ্গে
নিজেকে নিজেই অনুভব করে পৌঢ় হয়। মৃতের ফলকে
শান্ত হাত পাথরের সঙ্গে কথা বলে। জীবনের তীব্রতম
শোকে কুলহারা এই জনপদ জীবনকে নিলামে উঠিয়ে
অনর্গল ভেসে যায় চিতার ধোঁয়ায়। কৃষ্ণতম মৃত্যু পথে
তবুও আগুন রেখে যায় অসম্ভব অন্ধকারের শরীরে।
বিবর্তনে হিম ও রোদ্দুর শুধু অবসাদ এনেছিল ঘরে।
পৃথিবীর প্রত্নঘুম আজো মৃত পাখিদের শব ছুঁয়ে আছে।
নশ্বর শরীর সৃষ্টির উৎসাহে জেগে থেকে দেখেছিলো তার
বিচ্ছিন্ন জীবন শকুনের করতলে গাঢ় হয়ে বসে আছে।
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem