নীলাঞ্জনা - (একটি অভাগিনীর গল্প) Poem by Rahul Shil

নীলাঞ্জনা - (একটি অভাগিনীর গল্প)

কুন্তল গ্রামে তখন খরা ছিলো। একটি ফসলও ফলেনি। কৃষকশ্রেণির মধ্যে যেন আত্মহত্যার এক প্রতিযোগিতা শুরু হলো! কে কার আগে মরবে! এদিকে জমির যা হাল তাতে তাদের ঋণ শোধ তো দূরের  কথা নিজে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে ।  হাহাকার আর আত্মহত্যার প্রবনতাই দেখা যাচ্ছে কুন্তলের প্রতিটি পরিবারে। ঠিক সেই রূপভাবে একটি দারিদ্র্য এবং নিষ্ঠুর ভাবে দাঁত কামড়ে বেঁচে আছে  নীলাঞ্জনার ছোট্ট একটা পরিবার। পরিবার বলতে শুধু নীলাঞ্জনা আর তাঁর বাবা। নীলাঞ্জনার পিতা হরিচন্দ্র  মাথার ঘাম পায়ে  ফেলে নিজের সংসারকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জায়গা বলতে শুধু বিঘে ছয় জমিনই আছে তাঁর। এটার সকল কাগজপত্র ব্যাংকের অধিকর্তার নিকট জমা আছে। যার পরিবর্তে সে পঁচিশ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু গত ৫ বছর নাগাদ খরার জন্যে ফসলের অনেকটাই লোকসান হয়েছে। যার জন্য ঋণশোধ করা খুবই কষ্ট সাধ্য ব্যাপার।যদিও ব্যাংক অধিকর্তা  লিখিত নোটিশ পাঠিয়েছেন। কিন্তু কি আর করার, সবকিছুই এখন ভগবানের হাতে। বৃষ্টি এলেই রক্ষে। কিন্তু তাঁর আর শেষ রক্ষে হলোনা। শত চেষ্টার পরও ওই টাকা শোধ করতে পারেনি। তাই ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী হরিচন্দ্রকে ভিটেবাড়ি ছাড়তেই হবে। ব্যাংক নোটিশ পাঠিয়েছে যে দশ দিনের মধ্যেই তাঁদের ভিটে ছাড়তে হবে। যেদিন তিনি সম্পূর্ণঋণ শোধ করে দিতে পারবেন সেদিন তারা ভিটেবাড়ি ফেরত দেবেন।

হরিচন্দ্র এখন নিরুপায়। একা এই ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন তা তিনি স্থির করতে পারছেন না। তখন নীলাঞ্জনা  সবে মাত্র দশে পারা দিলো। বয়সে ছোট্ট হলেও  ভালো-মন্দ বিচার করার  মানসিকতা কিছুটা হয়তো জন্মেছিলো। বাবার কষ্টের পরিমাণ বোঝার ক্ষমতাটা হয়তো কম ছিলো। এই ছোট্ট মেয়ে নীলাঞ্জনার শৈশব যে এতো দুঃখে কাটবে তা তিনি কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। এখন তো নীলাঞ্জনার দৌড়ানো-খেলানোর বয়স। আর এখনই তাকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে! ভগবানের এ কোন বিচার!   মা মরা মেয়েটার এই বাবাটাই তো সব। কিন্তু এই দুর্যোগের সময় দিনে একবেলা খেয়ে পেটে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। খরার জন্য ফসল ফলতে না পারায় কাজও মিলছেনা তাঁর।  এদিকে আবার ভিটেবাড়ি চলে যাওয়ার চিন্তা। কোনো মতেই তো শেষ রক্ষে হচ্ছেনা। আর মাত্র এক দিন বাকি। ভোর হলেই ভিটে ছাড়তে হবে তাদের।

কিন্তু ভগবান যে এতোটাও নিষ্ঠুর না তা আরেকবার  প্রমান করে দিলো।  তাঁর এই কষ্টের কথা জানতে পারে দূর সম্পর্কের একটি ভাই। তাই ভাইয়ের কথায়  সর্ব শান্ত হয়ে  সামান্য কিছু অর্থ জোগাড় করে  হরিচন্দ্র তাঁর মেয়ে নিয়ে চলে যায় এক ব্যাস্ততম শহরে। যেখানে তাঁর ভাই থাকে। নতুন শহর, নতুন পথ, নতুন জীবন সব মিলে কেমন যেন অচেতন হয়ে আছে সবকিছু। ভাইয়ের সহযোগিতা নিয়ে এই আদম নগরীতে কোনো মতে মাথা গুজার মতো ঢাই মিলল একটি ছোট্ট ঘরে। হরিচন্দ্র নীলাঞ্জনাকে খুব ভালোবাসতো। তিনি কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। তাই তিনি ভাবলেন, যেভাবেই হোক মেয়েকে তিনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে তুলবেন, তাতে তাঁর যেটুকু পরিশ্রম করার সে করবে। কিন্তু এখন নীলাঞ্জনাই তাঁর সবকিছু। সেই মতে হরিচন্দ্র  কয়েকমাস পর  নীলাঞ্জনাকে ছোট্ট একটি স্কুলে ভর্তি করালো। অর্থের পরিমাণ কম হওয়াতে মেয়েকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াতে পারেনি। তাতে মনে সামান্য কষ্ট হলেও তিনি জানেন যে নীলাঞ্জনা এই বাংলা মিডিয়াম থেকেও ভালো ফলাফল করে নিতে পারবে। আর ভালো জায়গায়ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।

নীলাঞ্জনাকে মানুষ করার লক্ষ্যে এবং সংসারের হাল ধরতে তিনি একটি ছোট্ট দোকানে কাজ করতেন। দারুন ভাবে ফলাফল করতে থাকে নীলাঞ্জনা। সামান্য রোজগার কিন্তু খরচ বেশি হওয়াতে নীলাঞ্জনার পড়াশোনায় অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছিল। নীলাঞ্জনাও  বাবার কষ্টটাকে বেশ বুঝতে পারতো। ধীরে ধীরে নীলাঞ্জনাও বড়ো হতে লাগলো।বাবার কষ্ট দূর করার একমাত্র কাজ হলো বাবার সকল স্বপ্ন পূরণ করা। এটা নীলাঞ্জনা সবসময় বুঝতে পারতো। তাই বাবার জন্য কিছু করার উদ্দামতা সবসময়ই তাঁর মধ্যে দেখা যেতো।নীলাঞ্জনা সবে মাত্র মাধ্যমিক দিয়েছে। পরীক্ষায় প্রথম স্থানও অধিকার করেছে।  কিন্তু মেয়ে তো তাই  কিছু করতে পারতোনা, সবে মাত্র ষোল বছর। তাই ভাবলো বাবাকে একটু তো সাহায্য করতেই হয়। কিন্তু কোনো কাজই তো জানতোনাসে। কাজ বলতে ছোট্টবেলায় বাবার সাথে বাঁশ-বেতের জিনিস বানাতে শিখেছিল। তবে তেমন ভালো করে শিখতে পারেনি। কিন্তু সে স্থির করলো যে সে বাঁশ-বেতের জিনিস তৈরী করবে। তারজন্য সে সামান্য বাঁশ-বেতের কাজ শুরু করে কিছুটা অর্থ উপার্জন করতো। তাতে পড়াশোনার খরচের চাপটা কিছুটা কমে যায়। বাবা বেশ বুঝতে পারতো যে মেয়ে এখন বড়ো হয়ে গেছে। এভাবে অনেক কষ্টে বাবা-মেয়ে দুজনে৫টি বছর কাটিয়ে দেয়। 

নীলাঞ্জনাও এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, আর কলেজেও সে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে। কিন্তু এখনো তাঁর সেই কুন্তল গ্রামের কথা মনে আছে। এখনো মনে আছে ছোটবেলার সেই শৈশব,   যেখানে তার শৈশবের অনেক স্মৃতি রয়ে গেছে।  এখনো মনে আছে সেই ভিটে, যেখানে সে খেলা করতো তার বাবার সাথে। এখনো মনে পরছে সেই কথা যখন তাদের ভিটেবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল এবং তখনও ঠিক মতো কেটে উঠতে পারেনি তাঁর শৈশব।  তাই সে ঠিক করলো যে তাকে আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে যাতে সে তাঁর পৈতৃক ভিটে ফিরিয়ে আনতে পারে যেটা ব্যাংক তাদের কাছ থেকে হস্তক্ষেপ করে নিয়েছে। সে এখন আই.এস পরীক্ষা দেবে ঠিক করলো। তার জন্য সে  দিনরাত পরিশ্রম করতে থাকে এবং সর্বশেষ সে আই.এস পরীক্ষায় ২য় স্থান লাভ করে। নীলাঞ্জনা এখন আই.এস অফিসার। তাঁর জীবনে এখন আর কোনো দুঃখ নেই। শত কষ্টের পরিনতি ঘটল এখন। নীলাঞ্জনা তাঁর পৈতৃক ভিটে উদ্ধার করেছে।তাই বাবা হরিচন্দ্রকে নিয়ে কুন্তল গ্রামে চলে যায়। সেই শস্য-শ্যামলা, সেই নদীর কলরব, পশুপাখিদের সাথে কাটানো সেই দিন, সেই আমবাগান  যেখানে সে বন্ধু দের সাথে লুকোচুরি খেলতো, সবকিছুই তাঁর শৈশবকে যেন আবার জাগিয়ে দিলো।এখন নীলাঞ্জনার সকল স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেলো। বাবার স্বপ্নকে পূরণ করতে পেরে নীলাঞ্জনা খুব খুশি। এখন বাবাকে আর কোনো কষ্ট করতে হয় না। এখন বাবাকে দেখাশোনা, তাঁর সকল দায়িত্ব নীলাঞ্জনাই পালন করছে।

Friday, November 16, 2018
Topic(s) of this poem: story
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Rahul Shil

Rahul Shil

Mirza, Udaipur, Gomati, Tripura
Close
Error Success