আ মরি বাংলা ভাষা Poem by Rajat S Bhattacharya

আ মরি বাংলা ভাষা

আ মরি, বাংলা ভাষা!

কখন যে ঘটে গেল নিঃশব্দ বিপ্লব,
ধিকি ধিকি জ্বলা ছাইয়ের নিচে আগুনের মত।
কেউ দেখল না, নেভানর চেষ্টা ত কেউ করল-ই না ।
হল তার সুদুর প্রসারী প্রভাব ।
আমরা হারালাম প্রাণ খুলে গাইবার অধিকার,
"মোদের গরব মোদের আশা,
আ মরি, বাঙলা ভাষা"।
সে ভাষা-সুন্দরী হারিয়েছে তার সৌন্দর্য,
দুর্দমনীয় অশিক্ষা, স্বভাবসিদ্ধ ঔদ্ধত্য আর অপসংস্কৃতির প্রভাব পড়ল তার ওপর,
এক দিন তার রূপ ছিল সত্যইআ মরি, অপরূপা।
একদিন সে পরত অলংকার,
শব্দ বিকৃতি, শব্দ দুষণ রোগে ভুগছে সে আজ ।
প্রশমন না করা অপভ্রংশ, অপমিশ্রন, অপপ্রয়োগএখন মারাত্মক আকার নিয়েছে,
তার আত্মা কি করে জানি না সহ্য করে যাচ্ছে তার এই কুরূপ।
হয়ত বাকবন্ধ করতে পারছেনা বাক্যবাগীশ সেই ‘শ্লীলতাহানিকারীদের' |
হয়ত, নিঃশব্দে সহ্য করে চলেছে বিকৃতমস্তিস্ক অসুরের অ্যাসিডহানায় ঝলসান মুখমন্ডল নিয়ে নির্দয়, উদাসীন, আত্মকেন্দ্রিক এই সমাজে |
একসময় তার ঐশ্বর্য ছিল অতুলনীয়া রানীর মতো,
তার বাক্য, লেখন প্রাণে জাগাতসাড়া |
নিয়ে অসত আনন্দের জোয়ার,
নেচে উঠত মন শুভ নিনাদে,
কিম্বা দুঃখক্লিস্ট করে দিত অশুভ, অনাহুত অবাঞ্ছিত কোনো বার্তার সঠিক অর্থবহ হয়ে ।
কানের ভিতর দিয়ে মরমে পৌছে আকুল করত প্রাণ,
কি সুললিত, কি মধুময়, কি ছন্দময়, কি অর্থবহ,
অথচ কি সরল আমাদের আ মারি বাংলা ভাষা!

তাইত বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন্‌, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন-
ঐ ফুলেরই মধুর রসেসুখে বেঁধেছিলেন মধুর বাসা ।
বাজিয়ে রবি তাঁরবীণে, এনেছিলেন মালা, জগৎ জিনে।
সহজ, সরল, ব্যাকরণের কচ-কচি ছাড়া
এমনশক্তিশালী, সুমধুর, সুললিত ভাষা কি আছে আর?
ESPERANTO?
ধূমকেতুর মত সে বিজ্ঞানভিত্তিক ভাষা তৈরি হয়েছিল একশো পঁচিশ বছর আগে,
তার পর সে মিলিয়ে গেছে কোথায় তার শুধু শীর্ণকায় এক লম্বা ল্যাজ প্রবাহমান রেখে।
নানা ভাষা, উপভাষা ভাষীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব রোধে এক চোখের ডাক্তারের নিরলস চেষ্টায় তৈরি হল সেই একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাষা।
সহজতম, সরলতম ভাষা।
এক জনের মস্তিষ্ক কি করে এত বিজ্ঞ হয়?
মেধা, প্রজ্ঞা, অধ্যবসায়, একাগ্রতা,
নানা ভাষায় প্রখর ব্যুৎপত্তি, যৌক্তিকতাবোধ,
পৃথিবীতে বিরল এসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী পোল্যান্ডের ডাক্তার জামেনফ
একান্ত প্রচেষ্টায় তৈরি করলেন.....
নিষ্কলুষ, পৃথিবীর একমাত্র আন্তর্জাতিক, বৈজ্ঞানিক ভাষা।
একমাত্র ভাষা যা শিক্ষিত মনুষ উদ্ভাবিত!
সে সহজতম কিন্তু আক্ষেপ যে তার নেইআত্মা,
সে শুধু অনায়াসে লেখা, পড়া, কথোপকথন, ভাব আদানপ্রদানের সহজ উপায় করে দেয় নানা ভাষীদের মধ্যে |
এখন সেই বাঙলা রানীই বলে এমন বাক্য যার কোনটাই যেন শেষ হয় না শব্দ বিকৃতি ছাড়া।
গোটা শব্দটা বাঙালি হৃদয়ে চিরাস্হায়ী হয়ে গেছে |
ওটা তো পান সুপরির বিশেষণ ছিল,
এখন সে পুরো, সারা, সর্ব, নিখিল কে সরিয়ে একছত্র সম্রাট।
যেন শাহ জাহানকে সরিয়ে, দারা শিকো কে মেরে ঔরংজেবের দিল্লি দখল।
গোটা পান, গোটা সুপরি হতে পারে,
তাই বলে গোটা দেশ, গোটা বিশ্ব?
কষ্ট হয় ভাবতে, রবি ঠাকুর যদি লিখতেন
আঁধার রাতে গোটা ধরা, যেদিন করে প্রবঞ্চনা...
কিম্বা সুবিনয় রায় গান করেন, গোটা ভূবন হারলেম আমি যে...
বাঙলা ভাষা - সাহিত্যের অতীতের দিকপালরা কখনো গোটা এই ম্লেচ্ছ শব্দ প্রয়োগ করেছেন বলে দেখিনি।
কিন্তু এখন একঘেঁয়ে 'গোটা', 'এবং ', ' পরবর্তীকালে ' ছাড়া বাক্য তৈরিই হয় না।
সংবাদে থাকে দেহাতি প্রবাদ বাক্য,
যাতে মনে হয় ভাষাটাকে নিঃস্ব, কাঙ্গাল হিসেবে জাহির করতে বাংলাভাষীরা যেন সর্বস্ব পণ করেছে।
সঠিক গুরু প্রদত্ত বিদ্যা ও তার অধ্যাবসায় সহ অভ্যাসই
জ্ঞান, প্রজ্ঞা, আত্মপ্রত্যয়, আত্মসম্মান, বিনয়, উদারতা ইত্যাদি সুকুমার মনোবৃত্তির বিকাশে শুধু সাহায্য করতে পারে।
গুরুশিষ্যের মধ্যে প্রভেদ সাগর থেকে সংকীর্ণ হয়ে শীর্ণকায়া জল স্রোতে পরিণত হয়েছে।
তাই তৎপ্রদত্ত বিদ্যা মনের পরিধি বাড়াতে বিশেষ সহায়ক হয় না।
সেহেতু এখন উচ্চকণ্ঠে অর্থহীন কলরব ই শোনা যায়।
যা শ্রোতাকে ভারাক্রান্ত করে, আনন্দিত করে না।
বিদ্বজ্জনদেরঅবলীলায় গাইতে শোনা যায়,
কত যে মন হর মনই তাহা জানে,
গন্যমান্য, দেশবরেণ্য এঁদের মাথায় কি করে মন-ই হয়ে গেল MONOI?
ভুলের গড্ডালিকা চলেছে অবিশ্রান্ত, কেন চলেছে তা তোজানতে পারে না।
slangবা অপভাষাভাষাকে বিভুষিত করে না,
করে তাকেবিকৃত, অ্যাসিড পোড়া মুখের মত।
থাক্ না ওতে অ-বিদ্বজ্জনদের একাধিপত্য,
সংবিধান তো দিয়েইছে সে অধিকার,
চলুক সমান্তরাল ভাষা তাদের মুখে,
যা হয়ত দেয় তাদের অনাবিল আনন্দ।
আর মূলস্রোত বাঙলা ভাষা থাক না রাজরানী হয়ে, ক্ষতি কি?
বাঙলা ভাষার জনকেরা অপত্য স্নেহে বাঁধেন নি তাঁদের গুনধরদের উত্তর পুরুষদের,
তাই নির্দিষ্ট করে দেন নি শব্দে ধ্বনিপ্রাধান্যের অবস্থান, অর্পিত করেন নি কঠিন শব্দ-ভাগের রাশ,
দিয়েছিলেনশব্দের অর্থবহ আর শ্রুতি মধুর প্রকাশের স্বাধীনতা।
ভেবেছিলেন বাঙালির তো এত কথা আছে,     
এত গান আছে, এত প্রাণ আছে,
এত সুখ আছে,  এত সাধ আছে,
(তাই)প্রাণ হয়ে থাকে ভোর।
তা নিয়ে তারা নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে বলে যাবে সেই ভাষায় কথা শুধু সুকৃতি, শ্রুতিমধুর করে।
না, এতে যে সাধনার দরকার, তার জন্য আকুলতা আর সময় কই?
শব্দের বিশ্লেষণ করে তার অর্থ না করল তার প্রকাশ পঙ্গুত্বে ভোগে,
শুনে শুনে শুধু শব্দ আহরণের বিপদ এটা।
তাই তো বিদ্দ্বজনদেরও আগামীকালকে গতকাল বলতে শোনা যায়;
দুঃসাহস যে আছে!
দেবব্রত বিশ্বাস বাঙালিকে শিখিয়েছিলেন শব্দের উচ্চারণ,
যাতে তার প্রানপ্রতিষ্ঠিত অর্থ মর্মে পৌছায়, পল্লবগ্রাহী, অবোধ্য, অসার না থেকে ।
কিন্তু খুব দুঃখ হল যখন তিনি গাইলেন মধ্যদিনে যবে গান....
এত সুন্দর গান, তাঁর ঈশ্বরদত্ত কন্ঠ আর সুবিবেচিত সুগায়কীতেও শুনতে পারি না,
অবাক হলাম এই ভেবে, কি করে তিনি একাকীকে গাইলেন EKAKI?
সারা জীবন তাঁর কেটেছে পণ্ডিতমন্য বিদ্বজ্জনেদের একাংশের শত্রুতায়,
তাই কি তাঁর এই বশ্যতা স্বীকার?
কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হল না,
ভয়কে মুক্ত করে,
আপন মাঝে শক্তি ধরে নিজেকে জয় করতে পারলেন না।
ম্লেচ্ছদের কাছে হার মানতে হল ।
আজ কাল আর রেডিওতে শোনা যায় না অরূপ রতন, তাহার নামটি রঞ্জনা, ডাকঘর...
শোনা যায় না আহা মরি সে সব শব্দের ঝংকার,
উচ্চারণশৈলি, শব্দ চয়ন,
আজ ভিড় করে আসে অপভ্রংশ, বিকৃত উচ্চারণের সারি,
গোটা, সারোদা, যোৎ সামান্যো |
অমিতাভ বচ্চনের ঈশ্বরদত্ত কন্ঠে যখন EKLA চলরে শুনি,
তখন কর্নকুহর বন্ধ করে দিতে হয়,
কি শ্রুতিকটু লাগে।
প্রোথিতযশরা কি অবলীলায় "আমিও EKAKI, তুমিও EKAKI" গেয়ে যান,
গণি গণি হয়ে যায় গুনি গুনি!
বাংলায় তাই চলেছে পল্লবগ্রাহিদের যুগ।
এখন সারদা হয়ে যানসারোদা, যৎ সামান্য
হয়ে যায় যোৎ সামান্যো, অভিধান হয়ে যায় ওভিধান,
আঁধারের মাঝেও যারা সবেচেয়ে বেশি দেখতে পারে তাদের কন্ঠে শোনা যায় "যোতো মোত, তোতো পোথ,
এমন কি তথাকথিত সুশিক্ষিতের মুখেও।
পল্লিগীতির গায়ক ভাবলেন এখন বিদ্দ্বজ্জনেরা অ কে ও উচ্চারণ করেন,
তাই তিনি গাইলেন "ও আমার দোরোদী আগে জানলে....
হ্যাঁ, আগে জানলে প্রথমেই কানে তুলো দিয়ে দেওয়া যেত।
একসময় মান্না দে নির্ভুল ভাবে তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছেন "হয়ত তোমার জন্য",
বা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সুললিত কণ্ঠে গেয়েছেন "একটা গান লিখ আমার জন্য"'
এখন উচ্চশিক্ষিতরাও বলে "জোন‍্যো"। জলকে বলে জোল ।
সবার রাগ যেন অ -র ওপর না হয় সুভাষ বসুর ওপর, কিন্তু কেন?
অশিক্ষা যেন চিবিয়ে খাচ্ছে।
মূর্খ প্রশাসনের দ্বারা ঝেটিত হয়ে সংস্কৃত বিদায় হওয়ার পর তো আর কোনো মাষ্টারমশাই নেই। তাই শুনে শুনে আহরিত মূর্ছা যাওয়া শব্দের মালা গেঁথে যায় এখন বাঙালিরা।
বিশ্বব্যাপী অমূল্য তাথ্যজালে ঝোলানো হচ্ছে উর্বর মস্তিস্কের গবেষণা প্রসুত তথ্য,
ঈশ্বরী পাটনী, পুরুষ না মহিলা? ?
আনিল, জিজ্ঞাসিল এখন এদের মাথায় লিঙ্গ নির্দেশ করে না,
তাই সচিত্র সব গবেষণা ফল জালে!
"অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
শুধু চলে আগাছার মত বেড়ে ওঠামশক আর কর্কট স্বরূপ চরিত্র।
সংবাদ শুরু হয় অপকর্ম আর অপমৃত্যু দিয়ে আর শেষ হয় তা দিয়েই।
বিষাদময় কথাবার্তা আর সংবাদে সম্পৃক্ত পরিবেশেমন আনন্দিত হবার খোরাক পায় না।
বিপুলা পৃথিবীতে কত কি শেখার কত কি জানার,
কিন্তু ঘরকুনো, কুপমন্ডুক হয়ে থাকা যেন আত্মার শান্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভাষার সঙ্গে চরিত্রের সৌন্দার্যাও চলে গেছে।
বিদ্যাসাগরকে পিটিয়ে, সংস্কৃতকে কুড়ুল মেরে বিদায় করে জাত এখন নিরঙ্কুশ।
যদি সংস্কৃতের সম্পূর্ণ সমধর্মী অবয়বনিয়ে রাশিয়ানরা ওদের ভাষাকে হৃদয়ের চির উজ্জ্বল শশী করে রাখতে পারে,
আমরা কেন পারিনি?
যদিও আর সব ভাষা সারা বিশ্বে ইংরেজির কাছে মাথা নিচু করে তাকে ব্যবহারিক ভাষার মর্যাদা দিয়েছে,
তবুও তারা নিজেদের ভাষার স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে চলেছে আর সব ব্যাপারে।
ইংরেজিরপ্রচলন ছিল না পাঁচ দশক আগেপৃথিবীর বেশির ভাগ স্থানে,
তাকে তখন ম্লেচ্ছ হিসেবেই গণ্য করত সবাই।
কোনো এক কুক্ষণেকোন যুগে এক কুপণ্ডিত
বাংলায় অপভ্রংশের সূচনা করেছিলেন কেউ জানে না।
সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা ছিল পৃথিবীর এমন এক ভাষা যা, যে-কোনো শব্দকে লিখে সুচারু রূপে প্রকাশ করতে পারত,
কিন্তু তা পারে না, কারণ প - বর্গের ব (B)আর য - বর্গের ব (V)একাকার করে পরের জন কে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে সেই জন্ম লগ্নেই।
বাঙালি তাই very good কে লেখে ও বলে ভেরি গুড!
কেন? ভাষা যখন তৈরীই হল সংস্কৃতের অনুকরণে তবে দুই ব কে আলাদা আকৃতি দেওয়া যেত না উচ্চারনের পার্থক্য নির্দেশ করতে?
সংস্কৃতের মত একটাকে পেট কাটা করে দিলেই হত। ৰ আর ব ব্যাস।
কিন্তু তা না করে স্রষ্ঠারা আর সব নকল করে একটিতে তাদের নিজস্বতা দেখাতে গেলেন কেন বোঝা অসম্ভব।
তাতে তারা বাংলা ভাষাতে এই আজন্ম পঙ্গুত্বের খুঁত রেখে দিলেন।
বাংলা ভাষার ধ্বনি বিকৃতি শুরু অশিক্ষিত, অপটু রসনা থেকে।
ভাল সব ভাষায় আছে স, শ, ষ ঠিক যেমনটা আছে বাংলায়।
কিন্তু বাংলায় এদের উচ্চারণ লাগাম ছাড়া। যে যেমন খুশি ওদের উচ্চারণ করে যদিও ওদের মধ্যে অতিস্পষ্ট প্রভেদ আছে,
যা সু- উচ্চারণে শব্দের আসল রূপ ঘোষণা করে।
বিকৃতি শব্দের সৌন্দর্য্য আর অর্থের ওপর আঘাত আনে।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাতত্ত্বে অন্ত্যস্ত ব আর বর্গীয় ব নিয়ে তথা স শ ষ এদের একিকরণ নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন, কিন্তু কোন বিধান দেন নি।
এমন কি অন্ত্যস্ত ব যে "আসামী" ভাষায় আছে তারও উল্লেখ করেছেন।
বস্তুতঃ বাংলা ভাষা ছাড়া প্রায় সব ভাষায় ই এরা বিরাজমান স্বমহিমায়।
কিন্তু বাংলায় এরা ব্যতিক্রমী বিপ্লবী কেন?
তিনি লিখেছেন স কটা যুক্ত বর্নেই নিজস্ব ভাবে প্রকট হয় যেমন মস্ত, ব্যস্ত, প্রশস্ত ইত্যাদি।
এ ছাড়া এর আর কোন অস্তিত্ব নেই।
কিন্তু নৈরাজ্য প্রেমীরা তার ব্যতিক্রম করার পথই বেছে নিয়েছে,
সেটাই তো তাদের কাছে প্রগতির পথ!
কাজী তাই লিখে গিয়েছেন
"আমি দুর্ব্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি মানি নাকো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম, ভাসমান মাইন! "
আসলে ধ্বনি পরিবর্তন নাকি ভাষার প্রাণ, এটাকে ধ্রুব মনে করে প্রাজ্ঞরা অনিয়মিত শব্দ কে নিয়মিত করেছেন ব্যাকরণে জোড়া তালি লাগিয়ে।
শৃঙ্খলে বাঁধা সংস্কৃতের নাকি মৃত্যু ঘটেছে তার জন্য।
কিন্তু রাশিয়ান, জার্মান এসব ভাষাতে তো উচ্চারণ সংস্কৃতের মত ধ্রুব, তাদের তো মৃত্যু হয় নি?
আসলে একটা ছুতো চাই যাতে প্রাণ খুলে ভাষার বিকৃতি ঘটিয়ে যা খুশি বলে যাবার স্বাধীনতা ত চাই,
সে যেমন করেই হক।
আজকাল অবশ্য সাম বাজারের সসি বাবু সসা খেতে খেতে সসরিরে সর্গে গমন করেছেন এরকম বাক্য শোনা যায় না; ভাগ্যিস!
যদি সময় কে শময় ই বলতে হয় তবে ওর বানানটা পাল্টে দিলেই তো হল। আকাশ তাতে পড়বে না।
যত গোলমাল ত ওই দন্ত্য - স কে নিয়েই,
কেউ ওর মূল উচ্চারণ সহ্য করতে পারে না।
তাকে নির্বাসন দিলেই তো হল,
তাকে ছদ্মবেশে রাখার দরকার কোথায়?
তার আসল রূপ তো অগোচরেই থাকে।
যদি অন্ত্যস্ত - ব কে আমরা বিদায় করতে পারি নিঃসংকোচে, নির্লজ্জভাবে তবে দন্ত্য - স কেও কেন
পারা যাবে না?
তাতে আকাশ ত আরো বেশি ভেঙে পড়বে না কারণ তার উপস্থিতি তো অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে।
সংস্কৃত বাক্য বাংলা উচ্চারণে হয়ে যায় শুরো অশি কৃতবিদ্য অশি দর্শনীয় অশি পুত্রক, যশ্মিন কুলে তমোতপন্নগজশ্তত্র ন হন্যতে ।
তার বর্ণময় প্রকাশ পায় অশিক্ষিত পুরোহিতদের মুখনিঃসৃতপুজামন্ত্র বা অঞ্জলি পড়ানোর সময়।
খুব সুললিত শোনায় কি?
কিন্তু তার পরিবর্তন তো সম্ভব নয়।
হাতে উপস্থিত রয়েছে ছুতো -"সবাই তা বলে"।
সেই যে, তাতস্য কুপোয়মিতি ব্রুবানা কাপুরুষাঃ ক্ষারম জলম্ পিবন্তি।
সবাই যেটা করে বা বলে তা সাধারণতঃ ভুল কারণ অজ্ঞানি গুরুর মুখ নিঃসৃত বানীকেই ধ্রুব তারা করা এখনকার প্রবণতা।
সংসার সমুদ্রে পথহারা হতে যেন সবাই ভালোবাসে।

এই বর্গী আক্রমণ থেকে বাংলা ভাষাকে একমাত্র পরিত্রাণ করতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ,
কিন্তু তিনিও সে ফাঁদে পা দিয়েছিলেন,
তাঁর ইংরেজি নামের বানান এর প্রমাণ।
বিবেকানন্দ ভুল করেন নি, অরবিন্দ করেছেন।
দুটোকেই একরকম অক্ষর দেয়াই প্রথম ভুল, সব ভাষাতেই যেমন ও দুটোর আকার আলাদা তখন সৃষ্টি কর্তারা এই ভুল করেলেন কি করে?
সংস্কৃত পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যার অক্ষর আর ধ্বনির সমন্বয় সর্বোৎকৃষ্ট এবং তা সব ধ্বনির আক্ষরিক রূপ দিতে সক্ষম।
তার অক্ষর আর ধ্বনির মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই আক্ষরিক বা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে।
তাইত সংস্কৃতে স্বর আর ব্যঞ্জনবর্ণের এত কুলীন ব্যবহার!
তা দিয়েই হয় সংস্কৃতে মধুর বাণীরসুর - ছন্দের মূর্ছনা।
রবি ঠাকুরের কবিতায় দুটো শব্দের পারস্পরিক স্থান পরিবর্তনে যা দাঁড়ায় তাই এখন সেই নিবিড় ঘন আঁধারে জাজ্বল্যমান ধ্রুবতারা।
"আমরা চলি পিছন পানে কে আমাদের বাধবে, রইল যারা সমুখ টানে, কাঁদবে তারা কাঁদবে।"
এক সময়ের সবকিছুর পুরোধা এই জাতের আজ কি শোচনীয় অবস্থা, আজ তার চিহ্ন নেই কোথাও,
না দেশে, না বিদেশে।
কদিন পরে হয়ত ছাতিম তলার ফলকের ও সংস্কার হবে,
উনি আমার প্রানের আরাম....
উনি, ওনার এর যুগ এখন.
সংস্কৃতকে বিদায় করেছি সগৌরবে,
থাকত না হয় সেই চিরায়ত স্বল্পব্যবহৃতভাষা, বাংলা ভাষীদের আর সব অপরিহার্য্য গৃহশিক্ষকের একজন হিসেবেই।
ক্লাসের উপস্থিতির নুনতম হার নাই বা মেনে নিলাম ১০%.
রক্ষা তো পেত উচ্চারণ, মদ্যপ হত না মদ্যপ্।
......
রহমত অনাবশ্যক চন্দ্রবিন্দু যোগ করে হাতিকে নাহয় বলত হাঁতি,
বিদ্যের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া, বাঙলা না জানা বিদেশীর মুখে তা জুড়ে দিয়ে কি হাসির খোরাক জুগিয়েছিলেন আমাদের রবিবাবু!
আজ নব বঙ্গে নব যুগের চালকদের উচ্চারনে আর বিকৃত রুচির শব্দ চয়নে কি লিখতেন তিনি?

Friday, May 1, 2020
Topic(s) of this poem: lamentation
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success